Wed. Apr 30th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

untitled-35_261837 (1)

খােলা বাজার২৪, শুক্রবার, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭:  কোতোয়ালি থানার নোয়াপাড়ার বাসিন্দা সুজয় দাশকে এক চিকিৎসক তার দেওয়া প্রেসক্রিপশনে ‘অ্যাসমোলাক্স’ নামে একটি সিরাপ ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন। সুজয়ের বাবা ওষুধটি কিনতে গেলে স্থানীয় ফার্মেসি থেকে তাকে দেওয়া হয় ‘ওসমোলাক্স’ নামের আরেক সিরাপ। ‘ওসমোলাক্স’ কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে ডাক্তারের পরামর্শে ব্যবহার করা হয়। ওষুধ সেবনের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সুজয়ের পাতলা পায়খানা শুরু হয়। স্বজনরা ভয় পেয়ে যান। একপর্যায়ে তাকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওষুধ পরিবর্তনের বিষয়টি এক চিকিৎসকের নজরে আসে। তিনি তা রোগীর স্বজনদেরও জানান। তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়ায় রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন।

চিকিৎসকের হাতে লেখা প্রায় দুর্বোধ্য প্রেসক্রিপশনের কারণে প্রতিদিন এভাবে অনেক মানুষ বিড়ম্বনার শিকার হন। ভুক্তভোগী রোগী, স্বজন ও ওষুধ দোকানি অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চিকিৎসক হাতে লিখে যে প্রেসক্রিপশন দেন, তা পড়ে ৯০ শতাংশ সাধারণ মানুষ ও ফার্মেসির কর্মচারীরা বুঝতে পারেন না। এতে অনেক সময় ওষুধ পাল্টে যাচ্ছে; ব্যবহারের সময় ও ধরন নিয়েও বিপত্তি ঘটছে।

এমন পরিস্থিতিতে স্পষ্ট অক্ষরে ‘পড়ার উপযোগী করে’ চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশন লেখার নির্দেশনা দিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে আগামী ৩০ দিনের মধ্যে সার্কুলার জারির নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে রোগীর প্রেসক্রিপশনে ওষুধের জেনেরিক নাম লিখতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়েছে। স্বাস্থ্য সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ সাত বিবাদীকে চার সপ্তাহের মধ্যে এর জবাব দিতে হবে।

দুর্ভোগ: চিকিৎসকের হাতে লেখা প্রেসক্রিপশন নিয়ে প্রায়ই বিভ্রান্তি ও ভোগান্তিতে পড়তে হয় বলে জানালেন দেশের প্রধান সারির ওষুধ বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান লাজ ফার্মার পরিচালক সাকিব রহমান জয়। তিনি সমকালকে বলেন, ‘কয়েক দিন আগে চিকিৎসকের হাতে লেখা প্রেসক্রিপশন দেখে এক নামিদামি ফার্মেসির একজন বিক্রয় প্রতিনিধি ভুল ওষুধ দিয়েছিলেন। প্রেসক্রিপশনের লেখা বুঝতে না পেরে তিনি এনারক্সিলের পরিবর্তে এনটক্স দেন। এনারক্সিল ওষুধ রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে ব্যবহার করা হয়। এ ওষুধের পরিবর্তে তিনি এনটক্স নামে যে ওষুধ দিয়েছিলেন, তা ছিল মাল্টিভিটামিন। ‘এনটক্সের পরিবর্তে এনারক্সিল দেওয়া হলে রোগীর মারাত্মক সমস্যা হতো। এমনকি মৃত্যুও হতে পারত। বিশেষ করে হার্টের সমস্যা আছে- এমন রোগী এনারক্সিল ব্যবহার করলে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে তার মৃত্যু ঘটে।’

রাজধানীর বৃহত্তম ওষুধের বাজার মিটফোর্ডের ডি-লাইট ফার্মেসির বিক্রয় প্রতিনিধি নিখিল চন্দ্র শীল সমকালকে বলেন, ‘অনেক চিকিৎসকের হাতের লেখা জটিল হওয়ায় ওষুধের নাম বুঝতে সমস্যা হয়। তখন রোগী বা স্বজনদের কাছ থেকে রোগ সম্পর্কে জেনে ওষুধের নাম ধারণা করা হয়। এতেও বুঝতে না পারলে আমরা ওষুধ বিক্রি করি না। কেউ কেউ ভুল ওষুধও দিয়ে থাকে।’ তিনি বলেন, ‘চিকিৎসকের হাতে লেখা প্রেসক্রিপশন ছোট-বড় হরফে না লিখে শুধু বড় হরফে লিখলে পড়তে সহজ ও সুবিধা হয়। তবে কম্পিউটারে টাইপ করা প্রেসক্রিপশন লিখলে সবচেয়ে ভালো হয়।’ রাজধানীর কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা কম্পিউটারে টাইপ করা প্রেসক্রিপশন রোগীদের সরবরাহ করেন এবং এর ফলে সহজেই সঠিক ওষুধ দেওয়া যায় বলে জানান তিনি।

কয়েকজন ওষুধ বিক্রেতা সমকালকে জানান, চিকিৎসকের হাতের লেখায় অনেক সময় ইংরেজি ‘ইউ’কে ‘ডবি্লউ’, ‘ই’কে ‘এ’, ‘এল’কে ‘টি’ মনে হয়। এতে সমস্যা হয়।

‘ফার্মাসিস্ট ছাড়াই চলছে ফার্মেসি’: ওষুধ বিক্রেতাদের সংগঠন বাংলাদেশ কেমিস্টস অ্যান্ড ড্রাগিস্টস সমিতির সাবেক উপসচিব মনির হোসেন নিজের একটি ঘটনার উল্লেখ করে সমকালকে জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউরোলজি বিভাগের এক অধ্যাপকের অধীনে তিনি চিকিৎসা নিচ্ছেন। গত সপ্তাহে তার অস্ত্রোপচারের জন্য চিকিৎসক ওষুধ ও প্রয়োজনীয় কয়েকটি যন্ত্রপাতির নাম লিখে দেন। ৪০ বছরের বেশি সময় ওষুধসামগ্রীর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকার পরও মনির হোসেন ওই প্রেসক্রিপশনে চিকিৎসক কী লিখেছেন তা বুঝতে পারেননি। মিটফোর্ড হাসপাতালের কয়েকজন চিকিৎসককে ওই প্রেসক্রিপশন দেখানো হয়। তারাও তা পড়তে পারেননি। তিনি তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ওই চিকিৎসকের সহকারীকে দিয়ে ওষুধ ও যন্ত্রপাতি কেনার ব্যবস্থা করাবেন। প্রায় নব্বই ভাগ চিকিৎসকের হাতের লেখাই স্পষ্ট করে বোঝা যায় না বলে জানান তিনি।

মনির হোসেন বলেন, ‘ফার্মাসিস্ট ছাড়া ওষুধের দোকান চালানো বেআইনি। অথচ দেশের বেশিরভাগ ফার্মেসিতে বিক্রয় প্রতিনিধি অষ্টম শ্রেণি, এসএসসি কিংবা এইচএসসি পাস।’ স্বল্প শিক্ষিত বিক্রয়কর্মীরা অনেক সময় ইংরেজি ভালোভাবে বুঝতে পারেন না, এজন্যও সমস্যা হয় বলে জানান তিনি।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর জানাচ্ছে, দেশে বর্তমানে এক লাখ ২৩ হাজার ওষুধের দোকানের নিবন্ধন রয়েছে। এগুলো ছাড়াও প্রায় আট থেকে ১০ লাখ অনিবন্ধিত ওষুধের দোকান রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা। ফার্মাসিস্ট না থাকার পরও ওষুধের দোকান কীভাবে নিবন্ধিত হলো- এ প্রশ্নের জবাবে অধিদপ্তরের পরিচালক মোহাম্মদ রুহুল আমিন সমকালকে বলেন, ‘ফার্মাসিস্ট দেখেই ওষুধের দোকানগুলোর নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরে দেখা গেছে, নাম ব্যবহার করা হলেও দোকানে ফার্মাসিস্ট থাকছেন না। তাই নতুন করে ফার্মেসির নিবন্ধন দেওয়া বন্ধ রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে আদর্শ মডেল ফার্মেসি চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সারাদেশে মডেল ফার্মেসি চালু হলে মানুষের দুর্ভোগ কমবে।’

‘প্রচলিত রীতির পরিবর্তন প্রয়োজন’: বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব সমকালকে বলেন, ‘চিকিৎসকদের হাতের লেখা জটিল হওয়ার পাশাপাশি ফার্মেসির ওষুধ বিক্রয় প্রতিনিধিদের অদক্ষতার কারণে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। চিকিৎসকরা ইংরেজি ক্যাপিটাল লেটারে ব্যবস্থাপত্র লিখলে এবং ফার্মেসিতে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ বিক্রয় কর্মী নিয়োগ করার গেলে এই সমস্যা কমতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘চিকিৎসকদের দিয়ে ডিজিটাল পদ্ধতির বা কম্পিউটার টাইপ করা ব্যবস্থাপত্র লেখানো গেলে ভোগান্তি পুরোপুরি দূর হবে।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান সমকালকে বলেন, ‘চিকিৎসকের লেখা প্রেসক্রিপশন পড়তে সমস্যার কারণে রোগীকে ভুল ওষুধ দেওয়া হলে তা জীবন রক্ষার পরিবর্তে মানুষকে অসুস্থ করে ফেলতে পারে, তার মৃত্যুও ঘটতে পারে। তাই এ বিষয়ে চিকিৎসক ও ওষুধ বিক্রেতাদের সচেতনতা জরুরি।’ তিনি বলেন, ‘দেশের প্রায় সর্বর্ত্রই তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। এ অবস্থায় চিকিৎসককে প্রচলিত হাতে লেখা ব্যবস্থাপত্র থেকে বের করে আনা জরুরি। সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটারে টাইপ করা ব্যবস্থাপত্র চালু হতে পারে।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্রুত এ ব্যবস্থা চালু করা হবে বলে জানান উপাচার্য।

বিএমএর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. মাহমুদ হাসান সমকালকে বলেন, চিকিৎসকরা হাতের লেখা স্পষ্ট করে লিখলে সমস্যা দূর হবে। রাতারাতি সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে টাইপ করা ব্যবস্থাপত্র চালু করা সম্ভব নয়। তবে চালু করতে পারলে তা সবার জন্যই ভালো হবে।’

বিএমএর সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান উন্নত দেশগুলোর অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও মালয়েশিয়ার হাসপাতালগুলোতে প্রত্যেক রোগীর জন্য আইডি নম্বরসহ পৃথক ফাইল খোলা হয়। ওই ফাইলে রোগীর রোগসহ শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা লিপিবদ্ধ করা থাকে। তা ইন্টারনেটে ও কম্পিউটার সার্ভারে সংরক্ষণ করা হয়। রোগীর আইডি নম্বরে ক্লিক করলে তার রোগ-সংক্রান্ত পূর্ব-ইতিহাস বিস্তৃতভাবে জানা যায়।’ তিনি বলেন, ‘এ ধরনের প্রক্রিয়া চালু করতে এবং চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ডিজিটাল করতে বেশি সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এ বিষয়ে সরকার ও সরকারি হাসপাতালগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগী হতে হবে। তাহলে এটি চালু করা সম্ভব হবে, চিকিৎসা নিয়ে বিড়ম্বনাও কমবে।’

কয়েকটি ব্যতিক্রমী বেসরকারি প্রতিষ্ঠান: রাজধানীর ইউনাইটেড, অ্যাপোলো, স্কয়ার, বারডেম, ল্যাবএইডসহ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা রোগীদের কম্পিউটারে টাইপ করা ব্যবস্থাপত্র দেন। ওষুধ সেবনের নিয়মাবলিও স্পষ্টভাবে টাইপ করে বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা হয়। অ্যাপোলো হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. একিউএম রেজা সমকালকে বলেন, ‘হাতে লেখা ব্যবস্থাপত্র নিয়ে সমস্যা হয়, ফার্মেসির বিক্রয় প্রতিনিধি লেখা বুঝতে পারেন না। ভুল ওষুধ দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। এমন প্রেক্ষাপটে কয়েক বছর আগে অ্যাপেলো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হাতে লিখে ব্যবস্থাপত্র দেওয়া বন্ধ করে দেয়।’

কর্তৃপক্ষের বক্তব্য: বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) রেজিস্ট্রার ডা. জাহিদুল হক বসুনিয়া সমকালকে বলেন, ‘আদালতের নির্দেশনা আমাদের কাছে এখনও পেঁৗছায়নি।’ তবে কোনো কোনো চিকিৎসকের হাতে লেখা ব্যবস্থাপত্র পড়তে গিয়ে সমস্যা হয় বলে স্বীকার করেন তিনি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ সমকালকে জানান, আদালতের রুল জারির বিষয়ে শুনেছেন তিনি। তবে আদেশ এখনও হাতে পেঁৗছায়নি। আদেশ হাতে পাওয়ার পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।