খােলা বাজার২৪, শুক্রবার, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ : ইতিবাচক রাজনৈতিক ধারা অনুসরণ করে যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনে বিশেষ পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে দলটির হাইকমান্ড।
‘মানি না, মানব না’, অথবা ‘প্রত্যাখান’- এমন চিরাচরিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে সমঝোতাকেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। আর এ কারণেই ইসিকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান না করে রাজনৈতিক কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে দলটি। তাদের এমন ভূমিকাকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।
বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক জানান, রাজনৈতিক বিপরীতমুখিতা বা সংঘাত-জ্বালাও-পোড়াও থেকে বেরিয়ে সমঝোতার দিকেই গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার ওপর আবারও উদ্যোগ নেয়া হবে। পাশাপাশি নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের যে রূপরেখা দেয়া হবে সেখানেও প্রাধান্য পাবে সমঝোতার বিষয়টি।
নতুন কমিশন গঠনের পর স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ওই বৈঠকে নেতাদের মুখে ছিল সমঝোতার সুর। ইসিকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান না করে কৌশলী প্রতিক্রিয়া দেয়ার পরামর্শ দেন তারা। পরে জোটের বৈঠকেও নেতারা একই মনোভাব দেখান। আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে কিছু আপত্তি জানালেও অন্য কমিশনারদের ব্যাপারে তেমন অভিযোগ করা হয়নি। ইতিবাচক রাজনীতির ধারায় ফেরার অংশ হিসেবেই নতুন ইসিকে প্রত্যাখ্যান করে কোনো কর্মসূচি দেয়া হয়নি। বরং ইসিকে চাপে রেখে বিভিন্ন দাবি আদায়ের কথা ভাবছে দলটি।
জানতে চাইলে বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, বিএনপির সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে ইতিবাচক বা সমঝোতার ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে। সর্বশেষ ইসি গঠনের পরও তাদের আচরণ ইতিবাচক। প্রধান নির্বাচন কমিশনার সম্পর্কে গণমাধ্যমে নানা অভিযোগ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তারপরও রাষ্ট্রের অভিভাবক তাকে নিয়োগ দেয়ায় বিএনপি তা প্রত্যাখ্যান বা মানি না বলেনি।
তিনি বলেন, পারস্পপরিক সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা উচিত। বিএনপি সেই সমঝোতার দিকে এগোচ্ছে বলেই মনে হয়। তবে এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীন দলকেও এগিয়ে আসতে হবে। সমঝোতার ক্ষেত্রে সরকারের কিছুটা ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপি সব সময় ইতিবাচক রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। নানা প্রতিকূলতার পরও আমরা সংকট নিরসনে সরকারকে সংলাপ বা সমঝোতার আহ্বান জানিয়ে আসছি। কিন্তু সরকার তাতে সাড়া দিচ্ছে না। রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনে দলগুলোর মধ্যে আলাপ-আলোচনার বিকল্প নেই। ভবিষ্যতেও ইতিবাচক রাজনীতির ধারায় থাকবে বিএনপি। সংকট নিরসনে সমঝোতাকেই প্রাধান্য দেয়া হবে।
তিনি বলেন, বিএনপি সমঝোতার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে বলেই ইসি পুনর্গঠনে একটি রূপরেখা দিয়েছে। সব মহলেই তা প্রশংসিত হয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা ছিল দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দিয়ে ইসি পুনর্গঠন করা হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, একজন বিতর্কিত লোককে সিইসি করা হয়েছে। যেহেতু ইসি গঠন করা হয়ে গেছে। এখন দেখি তারা কিভাবে কাজ করেন।
ফখরুল বলেন, দলীয় আনুগত্য রয়েছে এমন একজন লোককে সিইসি করায় এখন নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যথাসময়ে সেই রূপরেখাও দেয়া হবে। বর্তমান বাস্তবতার আলোকেই তা তৈরি করা হচ্ছে।
বিএনপি নেতারা মনে করেন, বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ইসির ভূমিকার চেয়ে নির্বাচনকালীন সরকারের ভূমিকাই মুখ্য। তাই নতুন ইসিকে প্রত্যাখ্যান বা স্বাগত না জানিয়ে মাঝামাঝি অবস্থান নেয়া হয়েছে। তাদের কর্মকাণ্ডের দিকে সতর্ক নজর রাখা হবে। গাইবান্ধা উপনির্বাচন এবং কয়েকটি উপজেলা পরিষদ নির্বাচন দিয়ে নতুন কমিশন তাদের যাত্রা শুরু করবে। এসব নির্বাচনে ইসির ভূমিকা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে।
দলটির নেতারা মনে করেন, নতুন কমিশন সব দল বিশেষ করে বিএনপির আস্থা অর্জনে নানা উদ্যোগ নেবে। সিইসি নিয়ে দলের পক্ষ থেকে নানা অভিযোগ তোলায় তিনি কিছুটা মানসিক চাপেও থাকবেন। এই সুযোগকে কাজে লাগানোর পরিকল্পনাও রয়েছে। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও কমিশন শক্তিশালীকরণে বিএনপি যে রূপরেখা দিয়েছে সেখানে ১৩টি সুপারিশ ছিল। এসব দাবি আদায়ে নতুন কমিশনকে নানা চাপে রাখা হতে পারে। বিএনপির পক্ষ থেকে এসব সুপারিশের একটি কপি ইসির কাছে দেয়ার চিন্তাভাবনাও রয়েছে।
ইসিকে চাপে রাখার পাশাপাশি ইতিবাচক রাজনীতির প্রেক্ষাপট তৈরিতে রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার ওপর আবারও বিশেষ নজর দিচ্ছে দলটির হাইকমান্ড। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া এবং দেশের স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে শিগগিরই তাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করবেন দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। কোনো দল নয়, জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েই গড়ে তোলা হবে বৃহত্তর ঐক্য। আগামী নির্বাচনকে টার্গেট করে নয়, নির্বাচন-পরবর্তী সময়েও যেন ইতিবাচক রাজনীতির ধারা অব্যাহত থাকে সে লক্ষ্যেই নেয়া হচ্ছে এ উদ্যোগ।
গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত ও দেশের উন্নয়নের স্বার্থেই সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন প্রয়োজন। ইতিবাচক রাজনীতির ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার নিয়ে একটি সমঝোতায় আসা সম্ভব হবে বলে মনে করেন দলটির নেতারা। সে রকম প্রত্যাশা নিয়েই তারা কর্মপরিকল্পনা তৈরি করছেন।