খােলা বাজার২৪, শনিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭: মো. আবু তাহের। অবসরপ্রাপ্ত বিজিবি (তৎকালীন বিজিপি) সদস্য। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক বীর মুক্তিযোদ্ধা। জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে দেশকে শত্রু মুক্ত করেছেন। তার মতো অসংখ্য বীর মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বপূর্ণ অবদানেই স্বাধীন হয় দেশ। বিশ্ব মানচিত্রে স্বীকৃতি লাভ করে স্বাধীন বাংলাদেশের। কিন্তু দীর্ঘ ৪৫ বছর শেষেও এখনো মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি তিনি।
দীর্ঘ ৪৫ বছর তিনি অনেক চেষ্টা করেছেন একটু সম্মানের জন্য, স্বীকৃতির জন্য। আপেক্ষ নিয়েই কাটছে তার এইসব দিনরাত্রি। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের ঘোষণায় এখন জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দেখছেনে একটু আশার আলো।
বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্থানীয় পর্যায়ে চলছে উপজেলা ভিত্তিক মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া । এর অংশ হিসেবে গত ২৯ জানুয়ারি নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই অনুষ্ঠিত হয়। এতে মুক্তিযুদ্ধকালীন অনেক তথ্য উপাত্ত ও প্রয়োজনীয় প্রত্যয়নপত্র সমূহ নিয়ে অংশ নেন আবু তাহের। সেখানেও তাঁর মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতিকে উপক্ষো করা হয়েছে।
নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার পাঁচগাঁও বাজার সংলগ্ন নুর মোহাম্মদ বাড়ীর নুর মোহাম্মদের ছেলে মো. আবু তাহের। বয়স ৬৭ বছর। বর্তমানে অবসর জীবন পার করছেন।
আবু তাহের আক্ষেপ করে বলেন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযদ্ধের সময় আমি বোর্ডার গার্ড (বিজিপি) এ কর্মরত ছিলাম। যুদ্ধের একেবারে প্রথম দিক থেকেই আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিই। সেই সময় আমি কমান্ডার ক্যাপ্টেন মোতাবেল, সুবেদার বিআর চৌধুরী, সুবেদার নসিবুর রহমান, ইএমসি’র ভিএম নায়েক আবদুল মালেক, কোয়ার্টার মাষ্টার ল্যান্স নায়েক হাফিজ উল্যাহ চৌধুরী এবং ভারতীয় কমান্ডার ক্যাপ্টেন রাও গ্রুপের একজন সহযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধ করি। আমরা সবাই ক্যাপ্টেন মোতাবেলের নির্দেশে সুবেদার নসিবুর রহমানের নেতৃত্বে শ্রীপুরে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিই। পাক আর্মির হেডকোয়ার্টার সালুটিকা থেকে প্রায় গোলাবর্ষণ করা হতো। কিন্তু আমাদের অনেকের সশস্ত্র ট্রেনিং না থাকায় আমরা মুখোমুখি হতে না পেরে একপর্যায়ে সুবেদার নসিবুর রহমানের নেতৃত্বে ভারতে ট্রেনিং করতে চলে যাই।
ভারতে আমাদের ২০ জনকে সশস্ত্র ট্রেনিং দেওয়া হয়। সেখানে আরো ছিলেন, নৌবাহিনী পিটি অফিসার ল্যান্স নায়েক খালেক, ইপিআর এর ইলেকট্রিশিয়ান নায়েক মফিজ, সিপাহী সবুজ, সিপাহী আবদুল মন্নান, আর্মি সহকারী ওবিএম ড্রাইভার মো. আবু তাহের, ড্রাইভার আকবর, স্টুডেন্ট রিজবি লিয়াকত শফি, আনসারের শফি সহ অনেকে। ভারতের ডাওকির সংলগ্ন চিলং ফোটিং নামক স্থানে আমাদের ট্রেনিং দেন ভারতীয় ট্রেনিং কমান্ডার মেজর ডিসুম্বারি, সুবেদার বইলাম সিং, ল্যান্স নায়েক কান্সি সহ ৫ জন অফিসার।
তিনি আরো বলেন, ভারতে দুই মাস ট্রেনিং শেষে আমাদের সবাইকে গাড়িতে করে ইন্ডিয়ান আর্মি ট্রেনিং স্কুল চিলংয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কর্নেল শওকত ও একজন ল্যাফটেন্ট সহ ভারতীয় কমান্ডাররা আমাদের সাথে সাক্ষাত করেন। সেখানের সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমাদেরকে ১০ জন করে দুই দলে বিভক্ত করে দেশে পাঠানো হয়। নৌবাহিনীর একজন পিটি অফিসারের নেতৃত্বে একটি দল ময়মনসিংহের টিলাখালীতে অবস্থান নেয়। অপরদিকে আমাদের দলটি পাথরঘাটার চেলাতে অবস্থান নিই। সেখানে নদীতে অবস্থান নেওয়ার পর বাঁশতলা মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ক্যাপ্টেন হেলাল মোরশেদ ও সুবেদার আবদুর রবের নেতৃত্বে আমরা যুদ্ধ শুরু করি। চাতক মুক্ত হওয়ার পর কর্নেল শওকত, ক্যাপ্টেন হেলাল মোরশেদ, সুবদার আবদুর রব ও শওকতের পরিবারসহ স্পীডবোর্ডের সাহায্যে আমরা চাতক চলে আসি।
চাতকে দুই সপ্তাহ থাকার পর আমি এক মাসের ছুটিতে বাড়ীতে চলে আসি। ছুটি শেষে পুনরায় চাতকে গিয়ে দেখি আমাদের ইউনিট অন্যত্র চলে গেছে। পরে আমাদের বোর্ডসহ তিন ব্যাটেলিয়ানকে সিলেট অঞ্চলে বুঝিয়া দিয়ে যান। পরে আমি তিন ব্যাটেলিয়ান থেকে চিত্ররঞ্জন দত্তের সীলযুক্ত রিলিজ অর্ডার নিয়ে খাদিনশী আড়ী সেক্টর হেডকোয়ার্টারের আদেশে খাদননগর ১২ ব্যাটেলিয়ানে যোগদান করি। কিন্তু ওই চিত্ররঞ্জন দত্ত কাগজটি জমা দেওয়ার পর আমার কাছে অবশিষ্ট আর কোনো কাগজপত্র ছিলো না। আমি যখন যুদ্ধ করি তখনকার ক্যাপ্টেন হেলাল মোরশেদ বর্তমানে মুক্তবাহিনী সংসদের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন। ওনার পরামর্শে অনলাইনে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির জন্য আবেদন করি।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখা যোদ্ধা আবু তাহের এখন জীবনে শেষ প্রান্তে এসে শুধুমাত্র সম্মানের জন্য মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেতে চান। এটাই এখন তার জীবনের একমাত্র চাওয়া। প্রকৃত যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে তিনি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি চান। এজন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।