খােলা বাজার২৪, মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ : ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদদের স্মরণে ‘জাতীয় শহীদ দিবস’ ও ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে পালতি হচ্ছে নানা আনুষ্ঠানিকতায়।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে ভাষার দাবিতে ছাত্রদের মিছিল এবং মিছিলে আত্মাহুতির ঘটনা বাঙালি জাতির মধ্যে মুক্তির আলো দেখিয়েছিলো। সেদিন যারা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন, তারা স্বাধীনতা সংগ্রামের লাল সূর্যটাকে একেবারে স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
ভাষাসৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং গবেষকরা মনে করেন, একুশ বাঙালির জন্য মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর শক্তি দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ গবেষক শাহরিয়ার কবির বলেন, ভাষার জন্য একটি জাতি প্রাণ দিতে পারে এই ঘটনা পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আর নেই। তিনি বলেন, এই গৌরবের অংশীদার হয়েছে বিশ্ব। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা পেয়েছে।
এদিকে, রাষ্ট্রীয় আয়োজনে একুশের অনুষ্ঠানমালার সূচনা হয় রাত ১২টা ১ মিনিটে।
ঘড়ির কাটায় রাত ১২ টা ১ মিনিটে প্রথম প্রহরে রাষ্ট্রিয়ভাবে প্রথমে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও সরকারের তরফে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে নিয়ে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ এবং সভাপতিমন্ডলীর সদস্য সহ জ্যেষ্ঠ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
এরপর শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ও ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বি মিয়া।
একুশের প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে উপস্থিত হয়ে পুষ্পার্ঘ অর্পন করেন নরওয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বোরজ বেন্দে।
এরপর পর পুষ্পার্ঘ অর্পন করেন, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় সংসদের বিরোধী দল, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে ১৪ দল, তিন বাহিনীর প্রধানগণ, আইজিপি, র্যাবের ডিজি, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাইদ খোকন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনার, অ্যাটর্নি জেনারেল, ঢাবি উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা শহীদ বেদীতে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
এর পর সর্বস্তরের মানুষের জন্য খুলে দেয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার।
এদিকে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার একুশের প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর কথা থাকলেও শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত রাত ১২টা ৫০ মিনিটেও তিনি গুলশানের বাসভবন থেকে শহীদ মিনারের উদ্দেশে রওয়ানা হননি।
বাঙালি জাতির জন্য এই দিবসটি হচ্ছে চরম শোক ও বেদনার, অনদিকে মায়ের ভাষা বাংলার অধিকার আদায়ের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত।
১৯৫২ সালের এদিনে ‘বাংলাকে’ রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বাংলার (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ছাত্র ও যুব সমাজসহ সর্বস্তরের মানুষ সে সময়ের শাসকগোষ্ঠীর চোখ-রাঙ্গানি ও প্রশাসনের ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নেমে আসে।
মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে দুর্বার গতি পাকিস্তানি শাসকদের শংকিত করে তোলায় সেদিন ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিক গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। তাদের এই আত্মদান নিয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সরদার ফজলুল করিম তার ‘বায়ান্নরও আগে’ প্রবন্ধে লিখেছেন ‘বরকত সালামকে আমরা ভালবাসি। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা বরকত সালাম আমাদের ভালবাসে। ওরা আমাদের ভালবাসে বলেই ওদের জীবন দিয়ে আমাদের জীবন রক্ষা করেছে। ওরা আমাদের জীবনে অমৃতরসের স্পর্শ দিয়ে গেছে। সে রসে আমরা জনে জনে, প্রতিজনে এবং সমগ্রজনে সিক্ত। ’
গবেষকরা বলেন, ভাষা শহীদদের রক্তের বিনিময়ে বাঙালি জাতি সেদিন মায়ের ভাষার মর্যাদা অর্জনের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও পায় নব প্রেরণা। এরই পথ বেয়ে শুরু হয় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ।
পরবর্তী নয় মাস পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্যদিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে সংযোজিত হয় নতুন এক স্বাধীন সার্বভৌম দেশ- ‘বাংলাদেশ’। মাতৃভাষা আন্দোলনের ৬৫ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো) ১৯৯৯ সালে মহান একুশের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও গত কয়েক বছর ধরে দিবসটি পালিত হচ্ছে।
যথাযথভাবে দিবসটি পালনের জন্য ইতোমধ্যেই অমর একুশে পালনের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, আজিমপুর কবরস্থানসহ একুশের প্রভাতফেরী প্রদক্ষিণে এলাকায় বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, প্রণয়ন করা হয়েছে শহীদ মিনারে প্রবেশের রোডম্যাপ।
২১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ছুটির দিন। এদিন সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সকল সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি ভবনসমূহে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে।
শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ পৃথক বাণী প্রদান করেছেন।
২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র এবং বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো একুশের বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করবে। এছাড়াও দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দুদিনব্যাপী কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- রাত ১২টা ১ মিনিটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ, সকালে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় বঙ্গবন্ধু ভবনসহ সংগঠনের সকল শাখা কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ ও কালো পতাকা উত্তোলন। সকাল ৭টায় কালোব্যাজ ধারণ, প্রভাতফেরী সহকারে আজিমপুর কবরস্থানে শহীদদের কবরে ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও শ্রদ্ধা নিবেদন। এ ছাড়াও কাল ২২ ফেব্রুয়ারি বুধবার বিকাল ৩টায় রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটশন মিলতনায়তনে এ উপলক্ষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ।
শহীদ মিনার এলাকায় স্থাপন করা হয়েছে র্যাব ও পুলিশের একাধিক ওয়াচ টাওয়ার। পুরো এলাকায় টহল দিচ্ছে র্যাব ও পুলিশ। অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা নিজস্ব পোশাক ছাড়াও সাদা পোশাকে নজরদারি করছেন।