Wed. Jun 18th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

খােলা বাজার২৪, বুধবার, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭:  35একটি মোবাইল ছিনতাইয়ের ঘটনায় ছিনতাইকারীদের ফেলে যাওয়া ৬টি গুলিসহ একটি ম্যাগজিনের সুত্রধরে ৫২ দিন পর এমপি লিটন হত্যার মূলরহস্য উদঘাটন করা হয়েছে। এমন কি হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত পিস্তল, পিস্তলের ম্যাগাজিন, শর্টগানের কভার ও ১০টি গুলির খোসা, মোবাইল সিমসহ একটি মোটরসাইকেল উদ্ধার উদ্ধার করেছে পুলিশ।

এদিকে এঘটনার মূল নায়ক সাবেক এমপি কর্ণেল (অব.) ডা. আব্দুল কাদেরকে বুধবার ১০ দিনের পুলিশ রিমান্ডে দিয়েছেন আদালত।

লিটনকে হত্যার মুল পরিকল্পনাকারী ও অর্থ যোগানদাতা ছিলেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক এমপি কর্ণেল (অব.) ডা. আব্দুল কাদের খাঁন। তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে এই নৃসংশ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছেন।

বুধবার সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে গাইবান্ধা জেলা পুলিশ সুপার অফিস চত্বরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের রংপুর রেঞ্জের ডিইজি খন্দকার গোলাম ফারুক এসব কথা বলেন।

তিনি আরো বলেন, লিটনকে সরিয়ে দিতে পারলেই কর্নেল কাদের আবারো এমপি নির্বাচিত হবেন। এই আকাংখা ও লোভ থেকেই এমপি লিটনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন তিনি। কিন্তু উপ-নির্বাচনে তার দল জাতীয় পার্টি থেকে ব্যরিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে মনোনয়ন দেওয়ায় তাকেও হত্যার পরিকল্পনা করে আসছিলেন।

ডিইজি খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, লিটন হত্যাকা-ের পর থেকে পারিবারিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এবং জামাত-শিবিরের টার্গেটসহ নানাদিক নিয়ে তদন্ত ও গ্রেফতার অভিযান চালিয়ে আসছিলো পুলিশ।

কিন্তু গত ১ ডিসেম্বর দিবাগত রাত সাড়ে ১২ টারদিকে গাইবান্ধা- সুন্দরগঞ্জ সড়কের ধোপাডাঙ্গার নয়া বাজার এলাকায় একটি মোবাইল ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ওই সময় ছিনতাইকারীরা ওই এলাকায় ৬টি গুলিসহ একটি ম্যাগজিনের ফেলে রেখে যায়। এই সুত্রধরে সুন্দরগঞ্জ থানা পুলিশ কাদের খাঁনের লাইসেন্সকৃত পিস্তল ও গুলি থানায় জমা চান।

সুন্দরগঞ্জ থানার ওসি মো. আতিয়ার রহমান জানান, কিন্তু কাদের খান মোট চল্লিশ রাউন্ড গুলির মধ্যে মাত্র ১০ রাউন্ড থানায় জমা দেন। বাকী গুলির কোন সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি। এছাড়া লিটন হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত গুলির সাথে তার পিস্তলের গুলির মিল পাওয়া য়ায়। ফলে ওই ছিতনাইকারীদের খোজা শুরু হয়। বের হতে থাকে লিটন হত্যাকান্ডের মূল রহস্য।

তিনি আরো জানান, মঙ্গলবার ভোর রাতে জেলা শহরের ব্রিজ রোড় এলাকা থেকে ওই ছিনতাইকাজে অংশ নেয়া কর্নেল কাদেরের দুর সস্পর্কের ভাগ্নে ও তার বাড়ীর তত্তাবধায়ক শাহীন মিয়া (২৩) ও কাজের লোক রাসেদুল ইসলাম ওরফে মেহেদী হাসান (২২) এবং তার গাড়ীর চালক আব্দুল হান্নানকে (২৭) আটক করা হয়। পুলিশের কাছে তারা এই হত্যাকান্ডের বর্ণনা দেন। পরে তাদের স্বীকারোক্তি মোতাবেক সাবেক এমপি কর্ণেল (অব.) ডা. আব্দুল কাদের খাঁনকে মঙ্গলবার বিকেলে বগুড়া জেলা শহরের গরীব শাহ ক্লিনিক সংলগ্ন বাসা থেকে তাকে আটক করা হয়। পরে ওইদিন রাতেই সাড়ে ৯টার দিকে বগুড়া থেকে কাদের খাঁনকে পুলিশভ্যানে করে গাইবান্ধা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়।

ওসি বলেন, পরে বুধবার দুপুর ১২টায় ১০ দিনের রিমা- চেয়ে গাইবান্ধা আদালতে কাদের খাঁনকে হাজির করা হয়। আদালতের বিচারক অতিরিক্ত চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মইনুল হাসান ইউসুব শুনানি শেষে তার ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

কর্নেল কাদেরের দুর সস্পর্কের ভাগ্নে ও তার বাড়ীর তত্তাবধায়ক শাহীন মিয়া সুন্দরগঞ্জ উপজেলার উত্তর সমস কবিরাজটারী গ্রামের ওসমান গনি ভুট্টুর ছেলে। কাজের লোক রাসেদুল ইসলাম ওরফে মেহেদী হাসান একই গ্রামের আব্দুল করিমের ছেলে। গাড়ীর চালক আব্দুল হান্নান বগুড়ার শাহজাহানপুর উপজেলার কামারপাড়া আব্দুর রহমান প্রামানিকের ছেলে। কাদেরের ঘনিষ্টজন হিসাবে পরিচিত আব্দুল হান্নান দীর্ঘ ৮ বছর থেকে তার গাড়ীর চালক হিসাবে কর্মরত আছেন।

ওসি বলেন, হতদরিদ্র পরিবারের রিক্সা চালক মেহেদি প্রলোভনে পরে এই চক্রে জড়িয়ে পরে। কাদের এই কিলারদেরকে এ পর্যন্ত ৩ লাখ টাকা দিয়েছেন। এমপি হওয়ার পর তাদেরকে আরো অনেক কিছু করে দেওয়ার প্রলোভন দেখান। এছাড়া প্রায় এক বছর থেকে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার আইন শৃংখলা পরিস্থিতি অবনতি ঘটাতে কর্নেল কাদের তার লোক দিয়ে ছিনতাই, মন্দিরের মুর্তি ভাংচুরসহ একের পর এক নানা অপকর্ম ঘটান। এবং সুযোগ খুজতে থাকেন এমপি লিটনকে গুলি করে হত্যা করার।

তিনি আরো বলেন, এমপি লিটনকে মেহেদি নিজেই পর পর ৫টি গুলি ছুড়েছে বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে।

সংবাদ সম্মেলনে ডিইজি খন্দকার গোলাম ফারুক আরো জানান, কর্ণেল কাদের খাঁনের গাড়ী চালক আবদুল হান্নান হত্যাকা-ে কিলারদের পালিয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতা করেন। হত্যাকা-ে তার ভাগ্নে কাম ও বাড়ীর তত্তাবধায়ক শাহীন মিয়া (২৩) ও রাসেদুল ইসলাম ওরফে মেহেদী হাসানসহ চারজন অংশ নেয়। এরমধ্যে রানা নামে একজন পলাতক রয়েছে। তাকেও গ্রেফতারে তৎপর রয়েছে পুলিশ। তিনি জানান, হত্যাকা-ে ব্যবহৃত পিস্তল, পিস্তলের ম্যাগাজিন, শর্টগানের কভার ও ১০টি গুলির খোসা, হেলমেট, ক্যাপ, মোবাইল সিম পুলিশ উদ্ধার করেছে। এছাড়া তিনটি মোটরসাইকেলের মধ্যে একটি উদ্ধার করা হয়। এছাড়া হত্যাকা-ের ঘটনায় আরও কোন পরিকল্পনাকারী বা আরো কেউ জড়িত আছে কিনা তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে।

তিনি আরো জানান, লিটনকে হত্যার জন্য গত এক বছর ধরে তিনি নানাভাবে পরিকল্পনা করে আসছিলেন। এছাড়া হত্যাকা-ে অংশ নেওয়া কিলারদের বিভিন্ন প্রলোভন দিয়ে গত ছয় মাস থেকে কর্নেল কাদের নিজেই গাইবান্ধা ও বগুড়ার বিভিন্ন স্থানে তাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।

আটক কর্ণেল (অব.) ডা. আবদুল কাদের খাঁন গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি। তিনি সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ছাপরহাটি ইউনিয়নের পশ্চিম ছাপরহাটি (খাঁনপাড়া) গ্রামের মৃত্যু নয়ান খাঁনের ছেলে। তিনি পরিবার নিয়ে বগুড়া জেলা শহরের গরীব শাহ ক্লিনিকের চার তলা ভবনের উপর তলায় বসবাস করতেন।

এসময় পুলিশ সুপার মো. আশরাফুল ইসলাম অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ফারুক আহম্মেদ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এ সার্কেল) রবিউল ইসলামসহ পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া সংবাদ সম্মেলনে লিটনের স্ত্রী সৈয়দ খুরশিদ জাহান স্মৃতি, বোন তাহমিদা বুলবুল কাকুলীসহ জেলা আ.লীগের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

উল্লেখ্য, সুন্দরগঞ্জ থানার ওসি মো. আতিয়ার রহমান জানান, লিটন হত্যাকা-ের সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগে সুন্দরগঞ্জ উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে জামায়াত-শিবির, বিএনপির নেতাকর্মীসহ অন্যদের মধ্য থেকে দেড়শতাধিক জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আটকদের মধ্যে থেকে সুন্দরগঞ্জের আওয়ামীলীগ নেতা ও সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আহসান হাবীব মাসুদ, জামায়াতের অর্থের যোগানদাতা হাজী ফরিদ উদ্দিন, শিবির ক্যাডার আশরাফুল ইসলাম, জহিরুল ইসলামসহ ২৩ জনকে ওই হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কারাগারে পাঠানো হয়।

প্রসঙ্গত, গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সুন্দরগঞ্জের নিজ বাড়িতে দুর্বৃত্তদের গুলিতে গুরুতর আহত হন। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তাকে আশংকাজনক অবস্থায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে রাত সাড়ে ৭টায় চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।