
এই দুই দলের মধ্যে বিএনপির সর্বশেষ কাউন্সিল হয়েছে গত বছরের মার্চে। আর আওয়ামী লীগের কাউন্সিল হয়েছে অক্টোবরে। দুই দলের কমিটিই পরবর্তী তিন বছরের জন্য নির্বাচিত হয়েছে। ফলে ২০২০ সালের মধ্যে দুটি দল আর একটি করে কাউন্সিল করার সুযোগ পাবে। অর্থাৎ কমিটির বর্তমান আকার ঠিক থাকলে আওয়ামী লীগের আগামী কমিটিতে ২৭ জন নারী প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। আর বিএনপিতে থাকতে হবে ১৬৮ জন। অর্থাৎ বর্তমানে নারী প্রতিনিধিদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কমিটিতে আরও ১২ জনকে নিয়োগ দিতে হবে। আর বিএনপির কমিটিতে বর্তমানের ৬৪ জন ছাড়াও আরও ১০৪ জনকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বিএনপির ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে পঞ্চম কাউন্সিলের পর ঘোষিত ৩৮৬ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটির মধ্যে নারী ছিলেন ৪৬ জন। অর্থাৎ ১১ দশমিক ৯১ শতাংশ নারী নেতৃত্ব ছিল। কিন্তু ছয় বছর চার মাস পর অনুষ্ঠিত দলের ষষ্ঠ কাউন্সিলের পর ৫০২ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটির ৫০০ জনের নাম ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে নারী আছেন ৬৪ জন, শতাংশ হিসাবে যা দাঁড়ায় ১২ দশমিক ৮০। অর্থাৎ বিগত কমিটির তুলনায় নারী প্রতিনিধিত্ব দশমিক ৮৯ শতাংশ বেড়েছে। অপরদিকে আওয়ামী লীগের ১৯তম কাউন্সিলের পর গঠিত কেন্দ্রীয় কমিটিতে ১৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ, অর্থাৎ ১০ জন নারী ছিলেন। তিন বছর পর দলটির ২০তম কাউন্সিলে গঠিত কমিটিতে ১৫ জন নারী অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। অর্থাৎ বর্তমানে ঘোষিত ৭৪ সদস্যের কমিটিতে নারী আছে ২০ দশমিক ২৭ শতাংশ।
১৯ মার্চ ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন প্রাঙ্গণে বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে সমাপনী বক্তব্যে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘নারীদের রাজনীতিতে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা কমিটিতে নারী নেতৃত্ব বাড়াব। ২০২১ সালের মধ্যে আমরা এই সংখ্যা ৩০ ভাগে নিয়ে যাব।
বিএনপির সর্বশেষ ঘোষিত ১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটিতে একজন এবং ৭৩ সদস্যের উপদেষ্টা কাউন্সিলে ছয়জন নারী রয়েছেন। ১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটিতে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া একমাত্র নারী নেত্রী। গত কমিটিতে সারোয়ারি রহমান স্থায়ী কমিটিতে থাকলেও এবার তাকে সরিয়ে উপদেষ্টা কাউন্সিলে নেওয়া হয়েছে। ৭৩ সদস্যের উপদেষ্টা কাউন্সিলে সারোয়ারি ছাড়াও অধ্যাপক তাজমেরী ইসলাম, সাহিদা রফিক, রোজী কবির, তাহসিনা রুশদির লুনা ও আফরোজা খান রিতাকে রাখা হয়েছে। ৫০২ সদস্যের জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে ভাইস চেয়ারম্যান পদে রাবেয়া চৌধুরী, সেলিমা রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক পদে বিলকিস জাহান শিরিন, শামা ওবায়েদকে রাখা হয়েছে। ৫৪টি সম্পাদক পদের মধ্যে মহিলাবিষয়ক সম্পাদক হিসেবে নুরে আরা সাফা, প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক রাশেদা বেগম হীরা, স্বনির্ভরবিষয়ক সম্পাদক শিরিন সুলতানা এবং উপজাতীয়বিষয়ক সম্পাদক পদে ম্যা ম্যা চিংকে রাখা হয়েছে। গত কমিটিতে তিনটি সম্পাদকীয় পদে ছিলেন নারী।
এছাড়া এবারের কমিটিতে আন্তর্জাতিকবিষয়ক সহ-সম্পাদক অ্যাডভোকেট ফাহিমা মুন্নী, ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা, বেবী নাজনীন, সহ-শিক্ষাবিষয়ক পদে হেলেন জেরিন খান, ফরিদা মনি শহিদুল্লাহ, সহ-প্রান্তিক জনশক্তি উন্নয়নবিষয়ক সম্পাদক অর্পণা রায়, সহ-মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আফরোজা আব্বাস, সুলতানা আহমেদ, সহ-ত্রাণ ও পুনর্বাসনবিষয়ক সম্পাদক নেওয়াজ হালিমা আরলি, সহ-স্থানীয়বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আখতার, সহ-প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক রেহানা আক্তার রানু, সহ-স্বনির্ভরবিষয়ক সম্পাদক নিলুফার চৌধুরী মনি, সহ-তাঁতীবিষয়ক সম্পাদক রাবেয়া সিরাজ, সহ-মানবাধিকারবিষয়ক সম্পাদক সৈয়দা আসিফা আশরাফি পাপিয়া, সহ-নার্সেস ও স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক জাহানারা বেগম রয়েছেন।
৩১৩ জন নির্বাহী সদস্যের মধ্যে নারী আছেন ৪৩ জন। এরা হলেন- রেজিনা ইসলাম, বিলকিস ইসলাম, সাঈদা রহমান জ্যোৎস্না, রওশন আরা ফরিদ, লাভলী রহমান, কাজী হেনা, খালেদা পান্না, শাহিদা আখতার রীতা, নুরজাহান ইয়াসমীন, লায়লা বেগম, রহিমা সিকদার, লিটা বশির, মেহেরুন্নেসা হক, রাজিয়া আলী, খালেদা ইয়াসমীন, ইয়াসমীন আরা হক, ফেরদৌস ওয়াহিদা, শাহানা আখতার সানু, সাইমুম বেগম, হাসিনা আহমেদ, খালেদা রাব্বানী, সাহানা রহমান রানী, চমন আরা, নার্গিস আলী, জেবা খান, নাছিমা আক্তার কল্পনা, ফিরোজা বুলবুল কলি, রিনা পারভিন, আয়েশা সিদ্দিকী মনি, নুর জাহান মাহবুব, পিয়ারা মোস্তফা, ফরিদা ইয়াসমীন, সিমকী ইসলাম, আরিফা জেসমিন, অ্যাডভোকেট মুন্নী, রুখসানা খানম মিতু, সেলিমা রউফ চৌধুরী, এলিজা জামান, সাবেরা আলাউদ্দিন হেনা, রিজিয়া ইসলাম, নিপুন রায় চৌধুরী, রাবেয়া আলী ও তাহমিনা খান আওরঙ্গ।
এটা ঠিক যে, বিএনপিসহ উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আশানুরূপ নারী প্রতিনিধিত্ব নেই সত্য। তবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে দিকটি উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে চলেছে, তা হচ্ছে রাজনীতিতে নারীর ক্ষমতায়ন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা), জাতীয় সংসদের স্পিকার (শিরিন শারমিন চৌধুরী), বিরোধী দলীয় নেতা (রওশন এরশাদ) এবং প্রধান বিরোধী জোট নেতা (খালেদা জিয়া) হচ্ছেন নারী। নব্বইয়ের গণআন্দোলনের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগে রাজনীতিতে নারীর এই অব্যাহত ক্ষমতায়ন ঘটেছে। তবে এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, সবকটি নির্বাচনেই নারী ভোটারের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। নির্বাচন কমিশনের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৭৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে নারী ভোটার ছিল ১ কোটি ৪৩ লাখ ২৯ হাজার ১৪১। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে সেই ভোটারের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩ কোটি ৬৩ লাখ ১৫ হাজার ৬৮৪।
আন্তর্জাতিক পরিম-লে দেশের বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. রওনক জাহান তার ‘পলিটিক্যাল পার্টিজ ইন বাংলাদেশ’ গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, বিএনপিতে খালেদা জিয়ার ধারেকাছেও কোনো নেতা নেই। ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত বিএনপি চেয়ারম্যান পদে আসীন হন তিনজন। খালেদা জিয়া ১৯৮৪ সাল থেকে এ পদে রয়েছেন। নেতা নির্বাচন প্রক্রিয়া যেমনি হোক, আওয়ামী লীগ নিয়মিত কাউন্সিল আয়োজন করার মাধ্যমে দলীয় নেতৃত্ব বাছাই করে কিংবা কমিটি গঠন করে। কিন্তু বিএনপি নিয়মিতভাবে কোনো কাউন্সিল আয়োজন করেনি। দীর্ঘ ১৬ বছর পর ২০০৯ সালে বিএনপির পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিল এবং এরও প্রায় ছয় বছর পর ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিএনপি তার দলীয় চেয়ারপারসনের পদে নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করেছিল। কিন্তু কমিশন এ পদে আর কোনো প্রার্থী না পেয়ে পরবর্তী কাউন্সিলের আগ পর্যন্ত খালেদা জিয়াকে দলের চেয়ারপারসন পদে নির্বাচিত ঘোষণা করে। বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল তাদের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দলের মহাসচিব, জাতীয় স্থায়ী কমিটি ও জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্যদের নির্বাচিত করার ক্ষমতা দিয়ে দেয়। এসব কমিটির কোনো পদেই নির্বাচন হয়নি। নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের ‘ইনস্টিটিউলাইজেশন অব ডেমোক্রেসি ইন দ্য পলিটিক্যাল পার্টিজ ইন বাংলাদেশ : ডাজ কালচার মেটার’ শীর্ষক গবেষণায় তৃণমূল নেতাদের বয়ানে তুলে ধরা হয়েছে যে, বিএনপিতে এমন কোনো নেতা নেই যিনি সাহস করে দলের চেয়ারম্যান পদে খালেদা জিয়ার বিকল্প প্রার্থী হবেন। কারণ একে তো খালেদা জিয়া দলে ব্যাপক জনপ্রিয় এবং অন্যদিকে বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে কেউ প্রার্থী হতে চান না। এ রকম অবস্থা আওয়ামী লীগেও যে রয়েছে তাও রওনক জাহান তার গবেষণায় দেখিয়েছেন।