Thu. May 1st, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

16kখােলা বাজার২৪।। শনিবার, ১১ মার্চ ২০১৭: বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির সঙ্গে সম্পৃক্ত ১১ দেশের অন্তত ৬৪ নাগরিক ও পাঁচটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য না পাওয়ার কারণে তদন্ত কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। সম্পৃক্ত ওই ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে তথ্য চেয়ে সংশ্লিষ্ট দেশকে চিঠিও দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। বারবার তাগাদার পরও এসব দেশ থেকে তাদের বিষয়ে কোনো তথ্য না পাওয়ায় রিজার্ভ চুরির মামলার তদন্ত ‘কার্যত’ আটকে গেছে। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সিআইডি সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শাহ আলম বলেন, রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ অংশে তদন্ত প্রায় শেষ। বিভিন্ন দেশের যেসব নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ততা মিলেছে, তাদের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো তদন্ত করে তথ্য দিলেই পুরো তদন্ত শেষ হবে। বিদেশি সম্পৃক্তদের বিষয়ে কিছু তথ্য পেলেও তা পূর্ণাঙ্গ নয়। পুরো তথ্য পেতে কত দিন লাগবে, সেটাও বলা যাচ্ছে না।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে থাকা বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির ঘটনা ঘটে। এর প্রায় ৩৯ দিন পর ১৫ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে পাঁচটি সুইফট বার্তার মাধ্যমে ১০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অবৈধভাবে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে জানিয়ে মতিঝিল থানায় মামলা করা হয়।
কয়েক দিনের মধ্যেই ওই মামলার এক বছর পূর্ণ হবে। তবে তদন্ত সংস্থা সিআইডি ওই ঘটনায় এখনও জড়িত কাউকে আইনের আওতায় নিতে পারেনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বলেন, রিজার্ভ চুরির ঘটনায় মামলা হয়েছে। পুরো বিষয়টি সিআইডি তদন্ত করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে তাদের চাহিদা অনুযায়ী তথ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। যারা ঘটনায় দায়ী, তদন্ত সংস্থা নিশ্চয়ই তাদের আইনের আওতায় নেবে।
তদন্ত দলে থাকা সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মীর্জা আবদুল্লাহেল বাকী বলেন, তদন্ত প্রায় শেষ। ঘটনায় জড়িত বিদেশিদের প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করে তাদের বিষয়ে তথ্য জানতে কয়েকটি দেশে চিঠি দেওয়া হয়েছে। যেসব বিদেশিকে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাদের বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেলে দ্রুততম সময়ে চাঞ্চল্যকর ওই ঘটনায় মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া যাবে। কিন্তু তথ্য না পাওয়ায় তদন্ত শেষ করা যাচ্ছে না।
প্রায় এক বছরেও ঘটনায় জড়িত চিহ্নিত কেউ গ্রেফতার না হওয়ার বিষয়ে সিআইডির তদন্ত-সংশ্লিষ্ট দু’জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দেশের অভ্যন্তরে যারা জড়িত, তাদের নজরদারির মধ্যেই রাখা হয়েছে। তাদের আইনের আওতায় নেওয়া সময়ের ব্যাপার। তবে সিআইডি চাইছে, পুরো তদন্ত প্রক্রিয়া শেষ করতে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত বিদেশি, যাদের চিহ্নিত করা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট দেশগুলো সে অভিযোগ খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছে। তারা তা করলেই এ দেশে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা সহজ হবে। তখন পুরো ঘটনার অকাট্য প্রমাণও সিআইডির হাতে থাকবে। তদন্ত সংস্থা সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চায়।
সিআইডি সূত্রে জানা যায়, রিজার্ভ চুরিতে দেশি-বিদেশি ৭৯ জনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে ব্যাংক কর্মকর্তা, অর্থ গ্রহণকারী, অর্থ বহনকারী ও সুবিধাভোগী রয়েছেন। বিদেশিদের মধ্যে ২৫ বিদেশির চুরির প্রক্রিয়া ও ৩৯ বিদেশির পরোক্ষ সম্পৃক্ততা মিলেছে। ঘটনায় সম্পৃক্ততা মিলেছে পাঁচ বিদেশি প্রতিষ্ঠানেরও। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকেরও ১৩ কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা ও তিন কর্মকর্তার অবহেলার তথ্য পাওয়া গেছে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেন, ফিলিপাইন, শ্রীলংকা, জাপান, ম্যাকাও, হংকং, চীনসহ ১১টি দেশের নাগরিকের তথ্য চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে ফিলিপাইনের অন্তত ৩০, চীনের ২৩ জন রয়েছেন। অন্য ১১ জন নাগরিক নয়টি দেশের। এ ছাড়া ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশন (আরসিবিসি), একটি ক্যাসিনো, একটি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান, একটি হোটেল ও শ্রীলংকার একটি বেসরকারি সংস্থার কাছেও চিঠি দিয়ে তথ্য চাওয়া হয়েছে।
সিআইডি সূত্রে জানা যায়, দেশ-বিদেশে তদন্ত ও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সংস্থার সহায়তায় যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে, তাদের মধ্যে চীনের বংশোদ্ভূত ফিলিপাইনের নাগরিক কিম অং, মায়া সান্তোস দেগুইতো, ফ্রান্সিসকো ত্রুজ, জেসি ক্রিস্টোফার, উইলিয়াম সো গো, সান্তোস ভেরগারাসহ ৩০ জন। এ ছাড়া চীনের নাগরিকদের মধ্যে ডিংস ঝিজে ও সুহুইয়া এবং শ্রীলংকার শালিকা গোমেজ পেরেরা, শিরানি ধাম্মার্কি ফার্নান্দো, সানজেবা টিসা বান্দারা, ডন প্রসাদ রোহিতা, কুরাইয়ারাচ্চি ও নিশান্থা নালাকের সম্পৃক্ততা উঠে এসেছে সিআইডির তদন্তে।
রিজার্ভ থেকে চুরি যাওয়া অর্থের মধ্যে আট কোটি ১০ লাখ ডলার প্রবেশ করে ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনে। এর মধ্যে আরসিবিসিতে খোলা এনরিকো তিয়োদরো ভাসকুয়েজ নামের এক ব্যক্তির অ্যাকাউন্টে যায় দুই কোটি ৫০ লাখ ডলার। ঋণ পরিশোধের নামে এ অর্থ যায় তার অ্যাকাউন্টে। জেসি ক্রিস্টোফারের নামে খোলা আরেকটি অ্যাকাউন্টে যায় তিন কোটি ডলার। এ ছাড়া পরামর্শক ফির নামে ফ্রান্সিসকো ত্রুজের অ্যাকাউন্টে যায় ৬০ লাখ ডলার। সান্তোস ভেরগারা নামের একজনের অ্যাকাউন্টে যায় এক কোটি ৯০ লাখ ডলার।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, রিজার্ভ চুরির ঘটনায় সরকার গঠিত কমিটির তদন্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের বেশ কয়েকজনের নাম বেরিয়ে এসেছে। সিআইডিও এখন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদেই সংশ্লিষ্টদের নাম উঠে এসেছে।
সিআইডি কর্মকর্তারা বলেন, তদন্ত করে বিদেশি নাগরিক বা প্রতিষ্ঠানকে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশ চাইলেই তাদের জিজ্ঞাসাবাদ বা গ্রেফতার করতে পারে না। এ জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। তা ছাড়া সংশ্লিষ্ট দেশগুলোও অন্য কোনো দেশের অভিযোগের ভিত্তিতে নিজেদের নাগরিককে আটক করতে পারে না। এ জন্য চিঠিতে ওই সব ব্যক্তির বিষয়ে তদন্ত করার অনুরোধ করা হয়েছে। সিআইডি মূলত ওই তদন্তের তথ্যই চায়। এ জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমেও চিঠির জবাব পাওয়ার চেষ্টা চলছে।
রিজার্ভ চুরির নানা পর্যায়ে চিহ্নিত হওয়া বিদেশিদের বাংলাদেশে এনে বিচার করা সম্ভব হবে কি-না জানতে চাইলে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, ঘটনায় যেসব বিদেশি নাগরিকের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাদের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশকে জানানো হয়েছেথ এসব নাগরিক বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরিতে জড়িত। তদন্তপূর্বক তাদের আইনের আওতায় নেওয়ার অনুরোধও করা হয়েছে। এখন সংশ্লিষ্ট দেশটি যদি তার নাগরিকের বিষয়ে তদন্ত করে অপরাধের সত্যতা পায় এবং তাকে আইনের আওতায় নেয়, তাহলেই তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে।
তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, চুরি হওয়া রিজার্ভ থেকে এরই মধ্যে চীনা বংশোদ্ভূত একজন ফিলিপিনোর কাছ থেকে আদায় হয়েছে ১৫ মিলিয়ন ডলার। ব্যাংক অব সেন্ট্রাল ফিলিপিন (বিসিপি) আইনি জটিলতা দেখিয়ে ২০ মিলিয়ন ডলার ফ্রিজ করে রেখেছে। এখন পর্যন্ত ৩০ মিলিয়ন ডলারের কোনো ব্যাংকিং চ্যানেল খুঁজে পাওয়া যায়নি। এসব অর্থের চ্যানেল খুঁজতেই চিহ্নিত বিদেশিদের বিষয়ে তথ্য প্রয়োজন।
১৫ মিলিয়ন ফেরত দেওয়া ফিলিপিনের নাগরিক কিম অংয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন এমন একজন সিআইডি কর্মকর্তা বলেন, রিজার্ভ সরিয়ে নেওয়ার এক মিনিটের কম সময়ে বড় একটা অংশ ওই ব্যক্তির অ্যাকাউন্টে চলে যায়। তিনি তা স্বীকার করে বলেছেন, এটা কারও রিজার্ভ কি-না, তা তার জানা নেই। পূর্বপরিচিত ব্যক্তি তার ঋণ শোধ করেছেন। এটা তোমাদের (বাংলাদেশ রিজার্ভ) হলে নিয়ে যাও। এ কথা বলেই ওই ব্যক্তি দুই দফায় ১৫ মিলিয়ন ডলার ফেরত দেন বলে জানান ওই সিআইডি কর্মকর্তা। সমকাল