Tue. Jun 17th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

খােলা বাজার২৪।। বুধবার, ১৫মার্চ ২০১৭: 30মিলন খন্দকার,গাইবান্ধা : নাম ফুয়াদ মিয়া ।বয়স ৮ বছর।জন্ম থেকেই সেরিব্রাল পালসি (সিপি) তে আক্রান্ত ছিল। সে হাটতে ও কথা বলতে পারতো না। প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র থেকে বিনামূল্যে সেবা নিয়ে এখন সে হাটতে ও কথা বলতে পারে।গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার হামিন্দপুর গ্রামে তার বাড়ী।

ফুয়াদের বাবা রেজাউল মিয়া জানান,ফুয়াদ জন্ম থেকেই হাটতে ও কথা বলতে পারতো না।অভাবের সংসার।ঢাকা কিংবা রংপুরের বড় ডাক্তারের কাছে যাওয়ার আমার সামর্থ নেই।তাই শিশু ফুয়াদ কে নিয়ে চিন্তায় পড়ে যাই।পরে সমাজ সেবার এক আপার মাধ্যমে ওই সেবা কেন্দ্রে ফুয়াদকে নিয়ে যাই। সেখানকার ডাক্তার প্রতিদিন সকালে ফুয়াদকে নিয়ে সেবা কেন্দ্রে যেতে বলে।বিনামুল্য প্রায় একবছর নানা ধরনের মেশিনের সাহায্য থেরাপি ও ওষুধ দেয়া হয়।এখন ফুয়াদ হাটতে ও কথা বলতে পারে।এবার সে স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে।
গাইবান্ধা-পলাশবাড়ী সড়কের এলজিইডি ভবনের সামনে প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রটি অবস্থিত। গাইবান্ধার বে-সরকারি ফিজিওথেরাপি সেন্টারগুলো যেখানে রোগীপ্রতি একবারের থেরাপি সেবা বাবদ ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা ফি নিয়ে থাকে, সেখানে এ কেন্দ্রে সকল সেবা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে।

জেলার সাতটি উপজেলা থেকে আসা বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে এখানে বিনামূল্যে সেবা দেয়া হয়।এই সেবা নিয়ে আজ অনেকেই যেমন অতিরিক্ত টাকা ব্যয় হওয়া থেকে সুবিধা পাচ্ছেন, তেমনি সেবার মান অনেক ভালো হওয়ায় প্রতিদিনই এখানে আগত প্রতিবন্ধী সেবা গ্রহীতার সংখ্যা বাড়ছে।

শিশু ফুয়াদের মতো গাইবান্ধার আরও অনেকে এখানে বিনামূল্যে থেরাপি সেবা নিয়ে ফিরেছেন তাদের স্বাভাবিক জীবনে। তারা ঠিকমত হাটা চলা ও দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে পারছেন।
গাইবান্ধা সদর উপজেলার তুলশিঘাট সংলগ্ন খামার টেঙ্গরজানী গ্রামের যুবক নাজমুল হক।বয়স কুড়ি বছর।তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্থ (প্যারালাইসিস) রোগে বিছানায় পড়ে ছিলেন।স্পষ্ট করে কথাও বলতে পারতেন না।তিনি জানান,বছর খানেক আগে আমার প্যারালাইসিস হয়।পায়খানা,প্রসাব,গোসল,খাওয়া,হাটা চলা সব অন্যের সাহায্য নিয়ে করতে হতো।ডাক্তার,কবিরাজ দিয়ে কোন ফল পাইনি।পরে প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র থেকে বিনামুল্য নিয়মিত থেরাপি নিয়ে আামি পুরো সুস্থ্য হয়ে উঠি।এখন আমি বাইসাইকেলও চালাইতে পারি।

নাজমুলের বাবা মোঃ নইজল হক বলেন, নাজমুল হটাৎ বিছানা থেকে পড়ে গিয়ে প্যারালাইসিস রোগে আক্রান্ত হয়। হুইল চেয়ার দিয়ে চলাফেরা করতে হতো।বড় বড় ডাক্তার কবিরাজের ওষুধ খেয়ে কাজ হয়নি।পরে সেবা কেন্দ্রের থেরাপি নিয়ে সে ভাল হয়।

প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠার পর থেকে গত পৌনে চার বছরে ২,৯২৭ জনকে ২৮,৭৬৯ বার ফিজিওথেরাপিসহ বিভিন্ন থেরাপি সেবা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও এই কেন্দ্র থেকে এখন পর্যন্ত ৫৮ জন শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে হুইল চেয়ার ও ৪৫ জন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে সাদাছড়ি দেয়া হয়েছে।

গাইবান্ধা শহরের ডিবি রোডের বাসিন্দা আলী আহম্মেদ রিজওয়ান। ৫৫ বছরে পা দিয়েছেন তিনি।তার বাবা হামিদ উদ্দিন অনেক আগেই মারা গেছেন। হঠাৎ প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হন।তিনি জানান,এই বয়সে বিছানায় পড়ে থাকা কত কষ্টের তা বুঝানো যাবেনা।আমার স্ত্রীও আগের মত আর জোড় দিয়ে কাজ করতে পারেন না।মেয়েদের বিয়ে হয়েছে।ছেলেরা ঢাকায় চাকরি করে।সেখানে পরিবার নিয়ে থাকেন তারা।প্রায় আটমাস হুইল চেয়ারে বসে অন্যের সাহায্য নিয়ে আমাকে চলতে হয়েছে। প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রে গিয়ে বিনামুল্যে থেরাপি সেবা নিয়ে এখন আমি নিজেই হাট,বাজার থেকে শুরু করে সব কাজ করতে পারছি।আমাকে আর অন্যের সাহায্য নিতে হয়না।

প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের জুলাই মাসে শহরের বনবিভাগ রোডে কেন্দ্রটি গড়ে উঠে।বর্তমানে এলজিইডি ভবন সংলগ্ন একটি ভাড়া বাড়িতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের আওতায় কেন্দ্রটি পরিচালিত হচ্ছে। এখানে ডিজিটাল ট্রাকশন মেশিন, ওয়াকস,বোবাত বেড,আলট্রা সাউন্ড থেরাপি, শর্টওয়েভ ডায়াথার্মি, সিপিএম, আইএফটি, টেন্স, আইআরআরসহ আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে বিনামূল্যে থেরাপি সেবা দেওয়া হয়।

প্রতিবন্ধী শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য রয়েছে অটিজম ও ¯œায়ুবিকাশজনিত প্রতিবন্ধী কর্ণার। এখানে রকিংহর্স, মিউজিক্যাল কিবোর্ড, কানেকটিভফোর, পাজল, এবাকাসসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতির মাধ্যমে অটিজম ও ¯œায়ুবিকাশজনিত প্রতিবন্ধী শিশুদের বুদ্ধিবিকাশে সহায়তা করা হয় এবং তাদের দৈনন্দিন কার্যক্রমে অভ্যস্ত করে তোলা হয়।

এই কেন্দ্রে একজন করে কনসালটেন্ট (ফিজিওথেরাপি) ও ক্লিনিক্যাল ফিজিওথেরাপিস্ট, দুইজন থেরাপি সহকারি, একজন করে টেকনিশিয়ান (শ্রবণ) ও টেকনিশিয়ান (দৃষ্টি) দ্বারা বিনামূল্যে থেরাপি সেবা দেওয়া হচ্ছে। এখানে শারীরিক, শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধী, দূর্ঘটনায় আঘাত পাওয়া, পক্ষাঘাতগ্রস্থ ব্যক্তিসহ সাধারণ ব্যথাজনিত রোগীরাও সেবা পাচ্ছেন। এছাড়াও এখানে রয়েছে চোখ ও কান পরীক্ষার ব্যবস্থা।

এই কেন্দ্রের কনসালট্যান্ট (ফিজিওথেরাপি) ডাঃ মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন,এখানে বিনামুল্যে যতœসহকারে রোগীদের সেবা দেওয়া হচ্ছে।ফলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা উপকৃত হওয়ায় প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।

জানতে চাইলে গাইবান্ধার প্রতিবন্ধী বিষয়ক কর্মকর্তা মোঃ মেহেদী হাসান বলেন, সারাদেশে এমন আরও ১০৩ টি প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সেবা প্রদান করছে। এখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেবা প্রদানের পাশাপাশি বিভিন্ন কারণে পক্ষাঘাতগ্রস্থ (প্যারালাইসিস) ব্যক্তিদেরও বিনামূল্যে সেবা প্রদান করা হয়ে থাকে।সেবার মান ভাল হওয়ায় অল্প সময়ে এই কেন্দটি প্রতিবন্ধীদের কাছে সুপরিচিতি লাভ করেছে।