খােলা বাজার২৪।। শনিবার, ২৫ মার্চ ২০১৭: সাথী ফসলের বিপুল সমারোহের মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে নাটোরের কৃষি। সাথী ফসলের চাষাবাদের মাধ্যমে একই সময়ে একাধিক ফসলের চাষাবাদ হচ্ছে, কৃষকদের ঘরে যাচ্ছে বাড়তি মুনাফা।
নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে জেলার ১১ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে একই সাথে একই সময়ে দুই ফসল অর্থাৎ সাথী ফসলের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ১০ হাজার ৬৫০ হেক্টরে আখের সাথে মসুর বা ধনিয়া এবং ৭শ’ হেক্টরে রসুনের সাথে তরমুজ বা বাঙ্গি। এছাড়াও মসুর ডালের সাথে ক্ষিরা কিংবা মসুর ডালের সাথে বাঙ্গি অথবা মিষ্টি কুমড়ার আবাদি জমিও চোখে পড়ছে। নাটোর সদর উপজেলার ছাতনী এলাকার কৃষক আলেক উদ্দিনের দেড় বিঘা জমিতে কৃষি বিভাগ সাথী ফসলের প্রদর্শনী খামার স্থাপন করেছে। অক্টোবর-নভেম্বর মাসে আখের চারা রোপণের পরপরই তিনি জমিতে মসুর ডালের বীজ ছিটিয়ে দেন। সারা বছর ধরে জমিতে থাকা আখের গাছের সাথে পরিপক্ক মসুর ডাল ঘরে উঠেছে। বিঘাতে ফলন পাওয়া গেছে ৪ মণ করে- যার বাজার মূল্য অন্তত ১০ হাজার টাকা। তিনি বলেন, মসুরের বিক্রয়লব্ধ টাকা দিয়েই আখের বীজসহ জমির সারা বছরের ব্যয় নির্বাহ সম্ভব। হাড়িগাছা এলাকার কৃষক আব্দুর রাজ্জাক আখের জমিতে মসুর লাগিয়ে গড়ে সাড়ে ৩ মণ করে ডাল পেয়েছেন।
উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা নীরেন্দ্রনাথ সরকার বলেন, সা¤প্রতিক সময়ে দিন ও রাতের তাপমাত্রার ব্যাপক ব্যবধানের কারণে আখের জমিতে মসুরের ফলন কিছুটা কম হলেও আখের ফলনে কোন কমতি হবে না। এসব জমি থেকে কৃষকরা বিঘা প্রতি ২০০ মণের অধিক আখ বিক্রি করে সমুদয় অর্থই মুনাফা হিসেবে পাবেন। কয়েক বছর ধরে সাথী ফসল চাষাবাদের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ নাটোর সদরের পূর্ব হাগুড়িয়া গ্রামের আব্দুল করিম মৃধা এবার ৫ হেক্টর জমিতে মসুর ডালের সাথে ক্ষিরা, বাঙ্গি ও মিষ্টি কুমড়া চাষ করেছেন। এই জমি থেকে দেড়শ’ মণ মসুর ডাল পাওয়া গেছে। ৫০ মণ ক্ষিরা ইতোমধ্যে বাজারে বিক্রি হয়েছে। মিষ্টি কুমড়ার ফুল ও ফল আসতে শুরু করেছে। তিনি বলেন, সাথী ফসল চাষাবাদে একই সময়ে জমি থেকে বাড়তি আয় হচ্ছে। একই এলাকার কৃষক খলিলুর রহমান মসুরের জমি থেকে বিঘা প্রতি দেড়শ’ পিস বাঙ্গি পাবেন বলে আশাবাদী। রোজার মধ্যে ইফতারিতে আদরণীয় এই ফলের প্রতিটির পাইকারী বাজার দর হবে অন্তত ১০ টাকা।
নাটোর সদরে আখের জমিতে রকমারি সাথী ফসলের আধিক্য থাকলেও চলনবিল এলাকার গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রাম উপজেলায় রসুনের সাথে সাথী ফসল হিসেবে তরমুজ বা বাঙ্গি চাষাবাদ হয়েছে ব্যাপকভাবে। চলনবিল এলাকার প্লাবিত এসব জমিতে বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার পর নরম মাটিতে রসুনের কোয়া বোনা হয়। প্রায় দুই মাস পরে ওই একই জমিতে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে তরমুজ বা বাঙ্গির বীজ রোপণ করা হয়। বর্তমানে জমি থেকে রসুন ওঠা শুরু হয়েছে। এরপর চৈত্রের শেষার্ধ থেকে তরমুজ ও বাঙ্গি উঠতে শুরু করবে। গুরুদাসপুর উপজেলার সিধুলী গ্রামের কৃষক নান্নু মিয়া ২০০৯ সালে তার দুই বিঘা জমিতে প্রথম রসুনের সাথে তরমুজ আবাদ করেন। কৃষি বিভাগের পরামর্শ ও তত্ত্বাবধানে নান্নু মিয়া প্রতি বিঘাতে রসুন থেকে মুনাফা পেয়েছিলেন ২৪ হাজার টাকা। অন্যদিকে, তরমুজ থেকে বাড়তি মুনাফা আসে ১৪ হাজার টাকা। নান্নু মিয়ার পরীক্ষামূলক সাথী ফসলের চাষাবাদে অর্জিত মুনাফা দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেন এলাকার কৃষকরা। গত বছর উদবাড়িয়া এলাকার কৃষক তহিদুল মিয়া চার বিঘা জমিতে রসুনের সাথে তরমুজ আবাদ করে দুই লক্ষ টাকা মুনাফা করেছেন। গুরুদাসপুর উপজেলার সিধুলী, বিন্নাবাড়ী, ধারাবারিষা গ্রামে চলছে উৎসবের আমেজ। জমি থেকে সদ্য উঠতে থাকা রসুনের স্তুপ বাড়ির আঙিনায় পরিচর্যায় ব্যস্ত কৃষক বধুরা। আর জমিতে ডালপালা হয়ে ছড়িয়ে পড়া তরমুজের গাছ পরিচর্যায় ব্যস্ত কৃষকরা। সিধুলী গ্রামের কৃষক বধু শাহনাজ খাতুন জানান, এই সময়টা বাড়ির সবাই মিলে কাজ করি, জমি থেকে রসুন ঘরে তুলি। একই এলাকার কৃষক ফরহাদ হোসেন চলতি বছর তিন বিঘা জমিতে রসুনের সাথে তরমুজ আবাদ করেছেন। বিঘা প্রতি গড়ে ২৫ মণ করে রসুনের উৎপাদন হয়েছে জানিয়ে ফরহাদ হোসেন বলেন, প্রতি বিঘায় ৪৫০টি গর্তের প্রতিটিতে দু’টি করে তরমুজের চারা লাগানো আছে। রসুন উঠার পর এখন একটি সেচ ও পরিচর্যার পর তরমুজ উঠা শুরু হবে। তিনি বলেন, তরমুজ চাষে বিঘা প্রতি মোট খরচ প্রায় পাঁচ হাজার টাকা। আর তরমুজ বিক্রি করে গড়ে ২৫ হাজার টাকা আয় আসে। সিধুলী ব¬কের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মিলন কুমার গুহ বলেন, সাথী ফসল চাষাবাদে ফলনের কোন কমতি হয় না, বরং জমিতে শস্য বিন্যাস অর্থাৎ প্রতি বছর একই শস্য চাষাবাদ না করে শস্য পরিবর্তন করা হলে বরং বাড়তি ফলন পাওয়া যায়।
নাটোর কৃষি স¤প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, শস্য উৎপাদনে বৈচিত্র্যকরণ আনতে কৃষি বিভাগ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে কৃষকদের নিয়মিত প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ সেবা দেয়া হচ্ছে। এর সুফল হিসেবে জেলায় সাথী ফসল চাষাবাদের বিস্তার ঘটছে।