খােলা বাজার২৪।। শুক্রবার, ৩১ মার্চ ২০১৭: একের পর এক অভিযানে শীর্ষ নেতারা মারা যাওয়া বা ধরা পড়ায় এক রকম দিশাহারা অবস্থায় মাঠের প্রশিক্ষিত জঙ্গিরা। তারা অবস্থান নেয় ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের অন্তত ১০টি জেলায় গোপন আস্তানায়। সেখানেই মজুদ করা হয় অস্ত্র, বোমা ও বিস্ফোরকের। কিন্তু নির্দেশদাতা নেতা না থাকায় ‘করণীয়’ ঠিক করতে পারছে না জঙ্গিরা। তার ওপর আবার ওই সব গোপন ডেরাও আর গোপন থাকছে না; প্রায়ই অভিযানের মুখে তছনছ হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় দিশাহারা জঙ্গিরা যে যার মতো করে মজুদ অস্ত্র-বোমা-বিস্ফোরকের ‘শেষ ব্যবহার’ হিসেবে আত্মঘাতী হামলার ‘মহড়া’ শুরু করেছে। আর এ কারণেই দেশে হঠাৎ করে জঙ্গি তৎপরতা বেড়ে গেছে বলে দৃশ্যমান হচ্ছে। এসব তথ্য-বিশ্লেষণ জানা গেছে সা¤প্রতিক জঙ্গি হামলা ও অভিযানের তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘অদৃশ্য মহল’ থেকে জঙ্গিদের বড় ধরনের আত্মঘাতী হামলার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, এমন আলামত মিলছে। এ কারণে এখন শক্তিশালী বোমা পাওয়া যাচ্ছে। এসব ঘটনা আশঙ্কা তৈরি করছে। নতুন কৌশলের জঙ্গি কর্মকা- প্রতিরোধ করতে অভিযানের পাশাপাশি বিস্ফোরক সংগ্রহ এবং নতুন জঙ্গি সদস্য সংগ্রহের পথগুলো বন্ধ করা জরুরি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলছেন, জঙ্গিদের আস্তানা নিয়ে দেশবাসীর উৎকণ্ঠার কারণ নেই। তিনি বুধবার বলেন, ‘দেশের ১৬ কোটি মানুষ জঙ্গিবাদ পছন্দ করে না, ঘৃণা করে। তারা (জঙ্গি) অল্প কয়জন কী করবে? এ দেশে জঙ্গিবাদ থাকতে দেওয়া হবে না। জঙ্গিদের নির্মূলের কাজ চলছে। আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জঙ্গিদের গোপন আস্তানায় পৌঁছে যাচ্ছে। একের পর এক সফল অভিযান চলছে। ’
পলাতকরাই নেপথ্যে : পুলিশের কাউন্টার টোররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের এক কর্মকর্তা পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এখন পর্যন্ত নব্য জেএমবির ১৪ জঙ্গির পলাতক থাকার তথ্য রয়েছে তাঁদের কাছে। তারাই মূলত নব্য জেএমবির নতুন সদস্যদের সংগঠিত করেছে এবং প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এ কারণে তামিমসহ শীর্ষ জঙ্গিরা নিহত হলেও নব্য জেএমবি নিষ্ক্রিয় হয়নি। পলাতকদের মধ্যে আছেÑবাশারুজ্জামান ওরফে আবুল বাসার ওরফে চকোলেট, রাশেদ ওরফে র্যাশ, সোহেল মাহফুজ, ছোট মিজান, আব্দুস সামাদ ওরফে আরিফ ওরফে মামু, মামুনুর রশীদ রিপন ওরফে মামুন, শরিফুল ইসলাম খালিদ, হাদীসুর রহমান সাগর, সারোয়ার, ইকবাল, মানিক, বাদল, জুনায়েদ খান ও আজাদুল কবিরাজ।
সিটিটিসির আরেকটি সূত্র জানায়, গত ৭ মার্চ কুমিল্লার চান্দিনায় বাসে পুলিশের তল্লাশির সময় ধরা পড়ে ইমতিয়াজ অমি ওরফে আজওয়াদ ও মাহমুদ হাসান নামের দুই জঙ্গি। তাদের জিজ্ঞাসাবাদেই চট্টগ্রামের মিরসরাই, সীতাকু-, সিলেটের শিববাড়ী, মৌলভীবাজার এবং সর্বশেষ কুমিল্লার জঙ্গি আস্তানার সূত্র পায় পুলিশ।
জঙ্গিরা পুলিশকে জানিয়েছে, পলাতক জঙ্গিরা নতুন সদস্যদের প্রশিক্ষিত করে তুলেছে। দেশের পাঁচটি অঞ্চলে কমপক্ষে ২৫ জন প্রশিক্ষিত সদস্য আছে। তাদের অনুসারী হয়ে উঠছে আরো অর্ধশত তরুণ। চট্টগ্রামের সীতাকু- থেকে গ্রেপ্তারকৃত দম্পতি জসিম ও আর্জিনা পুলিশকে জানিয়েছে, তাদের আস্তানায় আত্মীয় পরিচয়ে তরুণ জঙ্গিরা থেকেছিল। তাদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ঢাকার মিরপুর থেকে নিখোঁজ হওয়া তরুণ আয়াদ আল হাসান ও আহমেদ রাফিদ হাসানের। এরা আত্মঘাতী হওয়ার জন্য বের হয়েছে। রাজধানীর বিমানবন্দরের কাছে বিস্ফোরণে নিহত যুবক আয়াদ বলে ধারণা পুলিশের।
সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা একটির পর একটি সূত্র ধরে অনুসন্ধান করছি। এর সূত্র ধরে মৌলভীবাজারের বাড়িতে জঙ্গিদের অবস্থানের তথ্য পাই। সীতাকু-ের অভিযানে যে ধরনের আইইডি (ই¤েপ্রাভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) পাওয়া গিয়েছিল, মৌলবীবাজারের আইইডিগুলোও একই রকম। অবিস্ফোরিত যে বোমা পাওয়া গেছে, সেগুলোর সঙ্গে বিমানবন্দরের ঘটনায় পাওয়া বোমার মিল রয়েছে। ’
বিস্ফোরক-বোমার ‘ভয়ংকর মজুদ’ : সিটিটিসি সূত্র জানায়, নব্য জেএমবির পলাতকদের মধ্যে কয়েকজন বোমার কারিগর আছে। তারা দেশে ও বাইরে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। পরে জঙ্গি ডেরায় থাকা প্রতিটি সদস্যকে বোমা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার দুই জঙ্গির জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, সিলেটের সীমান্ত এলাকা, যশোর ও ঝিনাইদহে বিস্ফোরক মজুদ করেছে নব্য জেএমবি। এ ছাড়া খুলনা, কুমিল্লা, নোয়াখালী, গাইবান্ধা, বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চলেও আছে কিছু জঙ্গির অবস্থান। গোপন আস্তানায় জড়ো করা বিস্ফোরকের বেশির ভাগই স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা। বেশ কিছু বিস্ফোরক এসেছে সীমান্ত এলাকা পার হয়ে। এমন তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় ব্লক রেড দিচ্ছে পুলিশ।
সূত্র জানায়, স¤প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া নব্য জেএমবির অস্ত্র-বিস্ফোরক সরবরাহকারী বড় মিজানও পুলিশকে একই রকম তথ্য দেয়। সে জানায়, বোমা বিশেষজ্ঞ সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজ, হাদিসুর রহমান সাগর ও মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজানসহ কয়েকজন আইইডি তৈরি করতে পারদর্শী। তারা বেশ কয়েকজনকে এই প্রশিক্ষণ দিয়েছে। জঙ্গিরা শেষ অস্ত্র হিসেবে আত্মঘাতী বোমা হামলা করছে বলেও জানায় বড় মিজান।
সিটিটিসি ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) ও বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের প্রধান ছানোয়ার হোসেন বলেন, এখন জঙ্গিদের কাছে যেসব বোমা দেখা যাচ্ছে সেগুলো বড় ধরনের আইইডি। এগুলো শক্তিশালী। চট্টগ্রামে চার-পাঁচ কেজির বোমা দেখা যায়। ঢাকায় আরো বড়। সিলেটে বিশেষ ধরনের বোমা ছিল। আগে নব্য জেএমবি মূলত সীমান্তের ওপার থেকে কারখানায় তৈরি ডেটোনেটর, পাওয়ার জেলসহ বিস্ফোরক নিয়ে আসত। এই কাজে যুক্ত প্রায় সবাইকে ধরা হয়েছে। ফলে এখন জঙ্গিরা দেশীয় বাজার থেকে সচরাচর পাওয়া যায় এমন রাসায়নিক, বিস্ফোরকসহ অন্যান্য উপাদান সংগ্রহ করছে।
একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, নব্য জেএমবির আত্মঘাতী জঙ্গিদের বর্তমান কৌশলও জেনেছেন জঙ্গিবিরোধী তৎপরতায় জড়িত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। তামিম চৌধুরীর হাত ধরে সংগঠিত হয়ে ওঠা নব্য জেএমবির সদস্যদের মগজ ধোলাই করে ‘শহীদ হওয়ার’ জন্য গড়ে তোলা হয়েছে। যারা নব্য জেএমবির ফাঁদে পা দিয়ে ঘর ছেড়েছে তাদের মধ্যে বেশ কিছু জঙ্গিকে দেশের বাইরে পাঠানো হয়েছে। যারা দেশে আছে তাদেরও হামলার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। গত এক বছরে বেশ কয়েকজন শীর্ষনেতা নিহত হওয়ায় তাদের কিছু হামলার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। অন্য নেতারা পরবর্তী সময়ে জঙ্গিদের আত্মঘাতী হওয়ার প্রশিক্ষণ দেয়। কিন্তু কুমিল্লায় দুই জঙ্গি, বড় মিজান, রাজীব গান্ধী ও সীতাকু-ের দুই জঙ্গি ধরা পড়ায় নতুন কৌশল জেনে যায় পুলিশ ও গোয়েন্দারা।
উৎস বন্ধের তাগিদ বিশেষজ্ঞদের : নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ বলেন, ‘জঙ্গিরা এখন অভিযানের কারণে কোণঠাসা হয়ে আত্মঘাতী হওয়ার কৌশল নিয়েছে। তাদের এই কৌশলের হাতিয়ার হচ্ছে মগজ ধোলাই করা তরুণ-তরুণী এবং বিস্ফোরক। আমি মনে করি এসব আর বেশি নেই। তবে বন্ধ করতে হবে। তা না হলে তারা আতঙ্ক তৈরি করার চেষ্টা করেই যাবে। ’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বলেন, ‘আত্মঘাতী জঙ্গি রিক্রুটমেন্ট বন্ধ করতে হবে। এ জন্য বিভিন্ন পর্যায় থেকে কাজ করতে হবে। নতুন সদস্য আর বিস্ফোরক না পেলে জঙ্গিরা সফল হতে পারবে না। ’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের রিসার্চ ফেলো সাফকাত মুনীর বলেন, জঙ্গিবাদের হুমকি কখনোই থেমে থাকে না। তা পরিবর্তনশীল। এখনকার ঘটনার কারণে নতুনভাবে হুমকি বিশ্লেষণ করা উচিত। কী ধরনের বিস্ফোরক মজুদ আছে এবং নতুন নেতৃত্বে কারা আছে তা বের করাও প্রয়োজন। বেশ কয়েক মাস স্থবির থাকার পর জঙ্গিরা কিন্তু ফের সক্রিয় হয়েছে। ফলে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে জঙ্গি বিষয়ে তদন্ত হওয়া জরুরি। ’ কালের কণ্ঠ