খােলা বাজার২৪।। বৃহস্পতিবার, ১৩ এপ্রিল ২০১৭: সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলায় জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নান, তাঁর সহযোগী শাহেদুল আলম বিপুল ও দেলোয়ার হোসেন রিপনের ফাঁসির রায় কার্যকর শেষে প্রত্যেকের গ্রামের বাড়িতে তাঁদের লাশ দাফন করা হয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার ভোর পৌনে ৬টার দিকে মুফতি হান্নানকে গোপালগঞ্জে, ভোর ৪টা ৩৫ মিনিটে শাহেদুল আলম বিপুলকে চাঁদপুরে এবং বুধবার দিবাগত রাত ১টা ৪০ মিনিটে দেলোয়ার হোসেন রিপনকে মৌলভীবাজারে দাফন করা হয়েছে।
এর আগে গাজীপুর ও সিলেট কারাগার থেকে তিন জঙ্গির লাশ বুঝে নেন তাদের স্বজনরা। পরে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে লাশগুলো গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়।
গোপালগঞ্জ থেকে মাহবুব হোসেন সারমাত জানান, কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে ভোর সোয়া ৫টার দিকে জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) নেতা মুফতি হান্নানের লাশ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছায়। লাশ বাড়িতে পৌঁছানোর পর মুফতি হান্নানের স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। বড় ভাই মাওলানা আলিউজ্জামান লাশ বুঝে নেন। এরপর ৫টা ৩৫ মিনিটে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে তাঁকে দাফন করা হয়।
জানাজায় মুফতি হান্নানের ছেলে নুরুল করিম, চাচতো ভাই ফরহাদ, ভাতিজা আবু রায়হান, পরিবারের লোকজনসহ প্রতিবেশীরা উপস্থিত ছিলেন। মুফতি হান্নানের বড় ভাই মাওলানা আলিউজ্জামান জানাজা পড়ান।
এ সময় কোটালীপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জিলাল হোসেন, নির্বাহী হাকিম মাহবুবুল হক, থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল ফারুক উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে, ফাঁসির দণ্ডাদেশ কার্যকর হওয়ার আগেই মুফতি হান্নানের বাড়িতে অবস্থান নেয় পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। প্রস্তুত রাখা হয় লাশ বহনের খাটিয়া, ভ্যানগাড়ি ও জানাজা পড়ানোর জন্য একজন মুন্সিকে।
পারিবারিক কবরস্থানে খোড়া হয় কবর। মুফতি হান্নানের বাড়ি হিরন গ্রামের প্রবেশ মুখে পুলিশ বিকেল থেকে চেকপোস্ট বসায়। বিকেলে স্থানীয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগ বিক্ষোভ মিছিল করে। ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পর ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীরা শহরে মিষ্টি বিতরণ করে উল্লাস করে।
কোটালীপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল ফারুক বলেন, পুলিশের পাহারায় মুফতি হান্নানের লাশ গ্রামের বাড়িতে আনা হয়। এরপর পরিবারের লোকজনকে লাশ বুঝিয়ে দেওয়া হয়। পরে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
চাঁদপুর থেকে হাবিবুর রহমান খান জানান, ভোর সাড়ে ৪টার দিকে জঙ্গি শাহেদুল আলম বিপুলের লাশ বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুটি গাড়ি চাঁদপুর সদর উপজেলার মেশাদী ইউনিয়নের বকশি গ্রামে তাঁর বাড়িতে পৌঁছায়। কারারক্ষীদের কাছ থেকে বিপুলের বাবা হেমায়েত উদ্দিন পাটওয়ারী লাশ বুঝে নেন।
পুলিশি প্রহরায় ভোর ৪টা ৩৫ মিনিটে বিপুলের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা পড়ান মধ্য তরপুরচণ্ডী আলী দাখিল মাদ্রাসার সহকারী সুপার মাওলানা হেলাল উদ্দিন পাটওয়ারী। জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
এ সময় মৈশাদী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান মানিক, কমিউনিটি পুলিশিংয়ের ইউনিয়ন সেক্রেটারি জাকির হোসেন বেপারী উপস্থিত ছিলেন।
এ ছাড়া সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উদয়ন দেওয়ান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফজাল হোসেন, পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান, সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওয়ালি উল্লাহ ওলি লাশ দাফন করা পর্যন্ত সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
মৌলভীবাজার থেকে এস এম উমেদ আলী জানান, ফাঁসি কার্যকরের পর রাতেই মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়নের কোনাগাঁও গ্রামের বাড়িতে জঙ্গি দেলোয়ার হোসেন রিপনের দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
এর আগে বুধবার রাত ১০টা ১ মিনিটে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে জঙ্গি দেলোয়ার হোসেন রিপনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। পরে রাত সোয়া ১২টায় পুলিশের দুটি গাড়িসহ লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স রিপনের গ্রামের বাড়িতে পৌঁছায়।
রাত ১টা ৪০ মিনিটে পুলিশ পাহারায় কোনাগাঁও ঈদগাহ মাঠে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। জানাজা পড়ান মাওলানা ইব্রাহিম।
কুলাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শামসুদোহা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এ সময় বাড়ির দুই কিলোমিটারের মধ্যে গণমাধ্যমকর্মীদের যেতে দেয়নি পুলিশ।
সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলার দায়ে গতকাল বুধবার রাত ১০টা ১ মিনিটে জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নান, তাঁর সহযোগী শাহেদুল আলম বিপুল ও দেলোয়ার হোসেন রিপনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রথম দুজনের এবং সিলেটে শেষেরজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
এর আগে কারাবিধি অনুসারে মুফতি আবদুল হান্নানের সঙ্গে সকালে প্রথম দফায় শেষ দেখা করেন তাঁর স্ত্রী, দুই মেয়ে ও বড় ভাই। পরে দুপুর ২টার দিকে একই মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত অপর দুই ভাইকে মুফতি হান্নানের সঙ্গে শেষ দেখা করার ব্যবস্থা করে কারা কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জ কারাগারে বন্দি মহিবুলকে কাশিমপুর কারাগারে আনা হয় এবং কাশিমপুর কারাগারের পার্ট ২-তে বন্দি অপর ছোট ভাই আনিছকে হাইসিকিউরিটি কারাগারে নিয়ে দেখা করানো হয়।
২০০৪ সালের ২১ মে সিলেটে হযরত শাহজালালের (রহ.) মাজার প্রাঙ্গণে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) কামাল উদ্দিন। এ ছাড়া হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান রুবেল আহমেদ ও হাবিল মিয়া। এ ঘটনায় আহত হন আনোয়ার চৌধুরী ও সিলেটের জেলা প্রশাসকসহ অন্তত ৪০ জন।
এই মামলার রায়ে ২০০৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের রায়ে হরকাতুল জিহাদের প্রধান মুফতি হান্নান, সাহেদুল আলম ওরফে বিপুল ও দেলোয়ার হোসেন রিপনের ফাঁসির দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। এই রায় আপিলেও বহাল থাকে।
আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া তিন আসামি রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করেন। তাঁদের আবেদন গত ১৯ মার্চ সর্বোচ্চ আদালতে খারিজ হয়ে যায়। এরপর প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন দণ্ডপ্রাপ্তরা। কিন্তু রাষ্ট্রপতি তাঁদের সেই আবেদন খারিজ করে দেন।