Thu. May 1st, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

13kখােলা বাজার২৪।। রবিবার, ১৬ এপ্রিল ২০১৭: ক্ষমতায় গেলে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার লক্ষ্য ঘোষণা করছে বিএনপি। এটিই মূলত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ‘ভিশন ২০৩০’ শিরোনামে নির্বাচনী ইশতেহার। গতকাল শনিবারও রাজধানীর ধানম-িতে দলের এক নেতার বাসায় এ নিয়ে বৈঠক হয়েছে। চূড়ান্ত অনুমোদনের পর এটি জনসমক্ষে তুলে ধরবেন চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। দলটির নেতারা বলছেন, চলতি মাসেই জনগণের সামনে অবস্থান পরিষ্কার করতেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এ বিষয়ে বলেন, ‘দেশ ও জনগণকে নিয়ে একটি পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে আমাদের। বিএনপি কী করতে চলেছে, সেটি জানাতে হবে। আমাদের ভিশনের মধ্যে সেগুলো থাকবে, তা আমরা জনগণের সামনে তুলে ধরব। ’ ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে ‘ভিশন-২০৩০’ আদলে ‘নির্বাচনী ইশতেহার’ হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। সে সময় তিনি বলেছিলেন, ‘আমি এতক্ষণ যা বললাম তা আমাদের ভিশন-২০৩০ এর সার কথা। এই ভিশনে বিস্তারিত পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন পদ্ধতির বিবরণ থাকবে। এই ভিশনের আলোকেই আগামীতে আমাদের দলের নির্বাচনী ইশতেহার রচিত হবে। ’ সেই আলোকে নতুনভাবে সংশোধন ও পরিমার্জন করা হয়েছে ইশতেহারে। এ নিয়ে কাজ করছেন দলের সিনিয়র নেতা, বুদ্ধিজীবী, পরিকল্পনাবিদ, গবেষক এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশায় কর্মরত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলটির এক নেতা জানান, গত সপ্তাহে ‘ভিশন ২০৩০’-এর খসড়াটি খালেদা জিয়ার কাছে দেওয়া হয়েছিল। তিনি তাতে কিছু সংশোধন করেন এবং দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনার পরামর্শ দেন। এর আলোকে গতকাল বিএনপির এক নেতার বাসায় বৈঠক করেন সংশ্লিষ্ট নেতারা। সেখানে উপস্থিত একজন জানান, মূলত ‘ভিশন ২০৩০’-এর সাবজেক্টগুলো কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে সেসব নিয়ে তাঁরা কথা বলেছেন। মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার লক্ষ্যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে গুরুত্ব দেওয়ার পয়েন্টটি গুলশান অফিস থেকে যুক্ত করতে বলা হয়েছে। ওই নেতা আরো জানান, এটি শিগগিরই চূড়ান্ত করে চেয়ারপারসনের হাতে দেওয়া হবে। পরে তা দলের নীতিনির্ধারণী ফোরামে তোলা হবে। সেখানে অনুমোদন হলে এটি জাতির সামনে তুলে ধরা হবে।
আমীর খসরু মাহমুদ বলেন, ‘আশা করছি, এ মাসের যেকোনো সময় চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশ করা হবে। দেশের এবং জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রত্যেকটি বিষয়, রাজনৈতিক ও বিষয়ভিত্তিক কাঠামো যেগুলো প্রতিনিয়ত জনগণকে স্পর্শ করে সেগুলো সম্পর্কে আমাদের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। এটা না করার কারণে আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে পরিষ্কার ধারণা তৈরি হচ্ছে না। ’
জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, ‘ভিশন ২০৩০’ নিয়ে কাজ চলছে। মূলত ‘নির্বাচনী ইশতেহার’ আকারের এই পরিকল্পনায় দল ক্ষমতায় গেলে কী করা হবে সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা থাকবে। এটি ঘষামাজার কাজ চলছে এখন। এরপর সেটি ম্যাডামের কাছে আসবে। ম্যাডাম সেটি চূড়ান্ত করে দিলে দিনক্ষণ ঠিক করে জাতির সামনে তুলে ধরা হবে।
বিএনপি সূত্র জানায় ইশতেহারে উল্লেখ রয়েছেÑসৃজনশীল উদ্যোগের মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা, প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা, জাতীয় সংসদকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করা, নতুন ধারার রাজনীতি প্রবর্তন, গণভোট, দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা, জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে একটি জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠা, জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনা, কারা দেশ পরিচালনা করবে তা নির্ধারণের অধিকার জনগণকে দেওয়াসহ নানা বিষয়।
নতুন ধারার রাজনীতি : বিএনপি নতুন ধারার রাজনীতি ও সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এ জন্য নতুন এক সামাজিক সমঝোতা বা চুক্তিতে উপনীত হতে উদ্যোগ নেওয়ার ঘোষণা দেবেন খালেদা জিয়া।
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য : এ ক্ষেত্রে তিনি বলেছেন, সা¤প্রতিক বছরগুলোর অভিজ্ঞতায় দেশবাসী গভীরভাবে উপলব্ধি করছে যে প্রধানমন্ত্রীর একক নির্বাহী ক্ষমতা সংসদীয় সরকারের আবরণে স্বৈরাচারী একনায়কতান্ত্রিক শাসনের জন্ম দিয়েছে। এর অবসানকল্পে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতার ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনা হবে।
দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ : খসড়ায় খালেদা বলেছেন, রাষ্ট্রের এককেন্দ্রিক চরিত্র অক্ষুণœ রেখে বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থা সংস্কারের অংশ হিসেবে বিভিন্ন স¤প্রদায়, প্রান্তিক গোষ্ঠী ও পেশার জ্ঞানীগুণী ও মেধাবী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হবে।
গণভোট : জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে জনগণের সম্মতি গ্রহণের পন্থা ‘রেফারেন্ডাম’ বা ‘গণভোট’ ব্যবস্থা সংবিধানে পুনঃপ্রবর্তন করার ঘোষণা দেবেন খালেদা জিয়া।
সমৃদ্ধ সমাজ : মহান মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা পূরণে বাংলাদেশের সকল ধর্মবিশ্বাসের মানুষ, পাহাড় ও সমতলসহ সকল অঞ্চলের মানুষ এবং প্রতিটি নৃগোষ্ঠীর মানুষের চিন্তা-চেতনা ও আশা-আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে একটি জনকল্যাণমূলক, সহিষ্ণু, শান্তিকামী ও সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তোলার কথা বলা হবে।
সুশাসন : তিনটি ‘গুড’ বা ‘সু’ অর্থাৎ থ্রিজির সমন্বয় ঘটাতে চায় বিএনপি। এই থ্রিজি হলো : গুড পলিসি, গুড গভর্ন্যান্স ও গুড গভর্নমেন্ট। অর্থাৎ সুনীতি, সুশাসন ও সু-সরকার। গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক সুশাসনের জন্য নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, আইন কমিশন ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মতো সাংবিধানিক ও আধাসাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতি, অনিয়ম ও দলীয়করণমুক্ত করার কথা বলা হবে।
মধ্যম আয়ের দেশ : পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ এবং মাথাপিছু আয় পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার ও এর জন্য বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ‘ডবল ডিজিটে’ উন্নীত করার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত উদ্যোগ নেওয়া হবে।
প্রশাসনকে গতিশীল : নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করে সততা, দক্ষতা, মেধা, যোগ্যতা, দেশপ্রেম ও বিচার ক্ষমতাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রশাসন, পুলিশসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যকারিতা নিশ্চিত করার কথা বলা হবে। সব কালা কানুন বাতিল করা হবে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- এবং আটক অবস্থায় দৈহিক-মানসিক নির্যাতনের অবসান ঘটানো হবে। আটকাবস্থায় মৃত্যুর প্রতিটি ঘটনার জন্য তদন্তের ব্যবস্থা থাকবে। উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের যোগ্যতা ও পদ্ধতিসংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করবে বিএনপি।
স্থানীয় সরকারে বাজেট বরাদ্দ : স্থানীয় সরকারের অনুকূলে সরকারি বরাদ্দের অপ্রতুলতা এবং বৈষম্য নিরসনে জাতীয় বাজেটের একটি অংশ বরাদ্দ এবং আইন দ্বারা গঠিত একটি স্বাধীন কমিশনের সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে বরাদ্দ অর্থ বণ্টনের ব্যবস্থা করা হবে।
ন্যায়পাল : দুর্নীতি দমনে কঠোর পদক্ষেপের পাশাপাশি আইন ও পদ্ধতিগত সংস্কার এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ন্যায়পালের পদ ও কার্যালয় সক্রিয় করবে দলটি।
জঙ্গি দমন : ভবিষ্যতে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ দমনে কঠোরতা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের সঙ্গে একযোগে কাজ করবে দলটি। বিএনপি মনে করে, সন্ত্রাসবাদ সব রাষ্ট্রের জন্যই হুমকির কারণ। এ কারণে বিএনপি বাংলাদেশের ভূখ-ের মধ্যে কোনো রকম সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা বরদাশত করবে না। বাংলাদেশের মাটি থেকে অন্য কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতাও মেনে নেবে না।
শিক্ষাব্যবস্থা : ‘শুধু ধনীদের জন্য শিক্ষা নয়’, দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত, মেয়েদের জন্য স্নাতক এবং ছেলেদের জন্য দশম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা, মেয়েদের শিক্ষা উপবৃত্তি কার্যক্রম স¤প্রসারিত করা হবে।
কৃষিব্যবস্থা : সুষম, নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করতে যথোপযুক্ত প্রণোদনার মাধ্যমে গোটা কৃষি খাতকে পুনর্বিন্যাস ও বিকশিত, কৃষিতে অনিরাপদ এবং ক্ষতিকর উপকরণ ব্যবহার বন্ধ, কৃষকদের জন্য শস্যবীমা চালু, অদক্ষ শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করা হবে।
আঞ্চলিক ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সহযোগিতা : জাতীয় স্বার্থ ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সহযোগিতা ও যোগাযোগ বাড়াতে কানেকটিভিটি স্থাপন, স¤প্রসারণ ও জোরদার করতে বলিষ্ঠ ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়া, কোনো রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ এবং অন্য কোনো রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য সমস্য সৃষ্টি না করা, বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বার্থের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া, প্রতিবেশী দেশসমূহের সঙ্গে সৎ প্রতিবেশীসুলভ সোহার্দ্য, বন্ধুত্ব ও আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার কথা বলা হবে।
এ ছাড়া পরিবেশদূষণ রোধ, জলবায়ু পরিবর্তন, দেশের অভ্যন্তরে প্রাপ্ত জ্বালানির সর্বোত্তম ব্যবহার, আবাসন খাতে বিদ্যমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত, ওয়াক্ফ সম্পত্তির পরিচালনা ও ব্যবহারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত, দেবোত্তর সম্পত্তিসমূহ হিন্দু শাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী পরিচালনার জন্য হিন্দু স¤প্রদায়ের সৎ ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করাসহ নতুন এক সামাজিক সমঝোতা বা চুক্তিতে উপনীত হতে বিএনপি উদ্যোগ নেবে বলে জানানো হবে।
পাশাপাশি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, বিভিন্ন দেশের মধ্যে চুক্তিসহ নতুন কিছু বিষয় সম্পর্কে বিএনপি তার অবস্থান পরিষ্কার করবে। কালের কণ্ঠ