খােলা বাজার২৪।। শনিবার, ২৯ এপ্রিল ২০১৭: বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশে প্রায় ৭০০ নদী জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। নদীসমূহের মধ্যে আন্তর্জাতিক নদী ৫৭ টি-যার ৫৪ টি-ই ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, ২ টি বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবেশ করেছে এবং ১ টি মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে আর বাকী নদীগুলো বাংলাদেশে উৎপত্তিলাভ করে বাংলাদেশেই শেষ হয়েছে বা বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। প্রধান প্রধান নদী পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমা, তিস্তা, ধরলার মাধ্যমে বেশিরভাগ প্রবাহিত পানিই ভারত থেকে বাংলাদেশে আসে। বৃহত্তম নদী গঙ্গা বা পদ্মা, বহ্মপুত্র ও মেঘনার মোট ক্যাচমেন্ট এরিয়া হল ১৭ লক্ষ বর্গকিলোমিটার। এর পুরোটাই ১ লক্ষ ৪৭ হাজার বর্গমাইল আয়তনের বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়। এসব পানি যদি ধরে রাখা যেত তাহলে বাংলাদেশ প্রায় ১০০০ সেন্টিমিটার পানির নিচে থাকত।
আজ এই পানি নিয়েই ভারত-বাংলাদেশ টানাপোড়েন। বর্ষার সময় নদীগুলো দিয়ে অবাধে জলধারা বয়। কিন্তু শুস্ক মৌসুমে ভারত পানি আটকে রাখে। ফলে বাংলাদেশ তখন মরুভূমিতে পরিণত হয়। এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে কৃষি-ক্ষেতের উপর অপরদিকে জলবায়ুর উপর তো বটেই। ভারতের এ পানি নিয়ে দ্বন্দ ব্রিটিশ আমল থেকেই। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর থেকেই ভারত নদীর পানি সেচ ও বিদ্যুৎ কাজে লাগানোর জন্য মহাপরিকল্পনা শুরু করে। ফলে তৎকালীন ১৯৬০ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু অববাহিকা চুক্তি হয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানীদের সাথে আমাদের যুদ্ধ শুরু হলে ভারত একদিকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করে অন্যদিকে গঙ্গায় বাধ নির্মাণ করতে থাকে। তারপর বাংলাদেশ স্বাধীনের পর ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ ও ভারত সরকার প্রধান শেখ হাসিনা ও দেবগৌড়ের মধ্যে গঙ্গা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়- যার ফলাফল ভারতই ভোগ করে। সম্প্রতি এ চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে। গঙ্গার পর আসে ৩৬৬ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তার কথা এবং এই তিস্তার পানি নিয়ে আশির দশক থেকে আলোচনা শুরু-যা প্রায় তিনদশক ধরে আজ অবধি চলছে কোন সমাধান বা সুরাহা হচ্ছে না। ভারত ধীরে ধীরে আরো জোরালোভাবে তিস্তা থেকে পানি নিয়েই নিচ্ছে। ২০১০ সালে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে তৎকালীন ভারত সরকারের (কংগ্রেসের মনোমোহন সরকার) ১৫ বছর মেয়াদী তিস্তা চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দোহাই দিয়ে তখন ভারত তা করেন নি। তখনকার সময়ে (যদিও চুক্তি স্বাক্ষর হয় নি) সিদ্ধান্ত ছিল উভয় দেশ ৫০% করে পানি পাবে। পরে আবার সিদ্ধান্ত হয় নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ধরে রাখার জন্য ২০% পানি থাকবে। বাকী ৮০% পানির মধ্যে বাংলাদেশ ৩৭% পাবে আর ভারত ৪৩% পাবে। এভাবেই চুক্তির খসড়া করা হয়েছিল। কিন্তু চুক্তি তো স্বাক্ষর হয় না-ই বরং ভারত ধীরে ধীরে তাদের আখের গোছাতে থাকে। ২০১০ সালের আগেই ভারত তিস্তা নদীতে সিকিম অংশে ২০০৯ সালে প্রায় ৯ হাজার কোটি রুপি ব্যয়ে ‘তিস্তা হাইড্রোলিক প্রজেক্ট’ নামে একটি প্রকল্প শুরু করে এবং যার মাধ্যমে তিস্তার পানি অন্যাত্র নিয়ে তারা কাজে লাগায়। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং ও কালিম্পং এলাকায় তিস্তার লো ড্যাম্প নামে একপি প্রজেক্ট করে-যার মাধ্যমে তারা পানি নিয়ে সেচ কার্য চালায়। এসব জায়গা থেকে ভারত পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ার পরও পানি বাংলাদেশে আসত। কিন্তু ভারত থেমে নেই। পানি বাংলাদেশে প্রবেশের আগেই ভারত তাদের অংশ গজলডোবা নামক স্থানে একটি প্রজেক্ট স্থাপন করছে এবং সেখান থেকে তারা পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। ফলে ভারত তাদের ইচ্ছামত বাংলাদেশে যখন প্রয়োজন নেই অর্থাৎ বর্ষা মৌসুম তখন পানি ছেড়ে বন্যায় মারছে আবার যখন বাংলাদেশে পানি প্রয়োজন অর্থাৎ শুস্ক মৌসুম তখন পানি প্রত্যাহার করে নিয়ে মরুভূমিতে পরিনত করছে। ভারতের তিস্তা নদীর ডালিয়া পয়েন্টের পানি আগ্রাসনের একটি চিত্র নি¤েœ উল্লেখ করা হলো। ১৯৭৩-৮৫ সময়ে গড় পানি প্রবাহ জানুয়ারী মাসের প্রথম ১০ দিন ছিল ৭০১০ কিউসেক, মাঝের ১০ দিনে ছিল ৬০১০ কিউসেক এবং শেষের ১০ দিনে ছিল ৫৬৬৮ কিউসেক। আর এ বছরেই অর্থাৎ ২০১৭ সালের জানুয়ারী মাসেই সেখানে গড় পানি প্রবাহ প্রথম ১০ দিন ২৩৮৪ কিউসেক, মাঝের ১০ দিন ১৭৬০ কিউসেক এবং শেষের ১০ দিন ১১৯০ কিউসেক। অতএব, দেখাই যাচ্ছে ভারত তিস্তা নদীতে তাদের ব্যারেজ প্রকল্প স্থাপনের আগে অর্থাৎ ১৯৭৩-৮৫ সময় পানি প্রবাহ ছিল বাংলাদেশের চাষাবাদ ও জলবায়ুর জন্য বেশ ভাল। কিন্তু ভারত ব্যারেজ প্রকল্প নির্মাণের ফলে বর্তমানে যে পানি প্রবাহ তা চাষের উপযোগী নয় বললেই চলে। কেননা, নীলফামারী জেলার বৃহৎ তিস্তা সেচ প্রকল্পের অধীন নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলায় ১২ টি উপজেলায় প্রায় ৬০ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে সেচ দিতে প্রতিদিন প্রায় ৩৫০০ কিউসেক পানির প্রয়োজন কিন্তু চলতি (২০১৭) জানুয়ারী মাসে বাংলাদেশ সেখানে পানি পায় ১১৯০ কিউসেক-যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। ভারত যে বাংলাদেশের উজানমুখে নদী থেকে পানি প্রত্যহার করে নিচ্ছে বা নেয় বা ভবিষ্যতে নিবে তার প্রমাণ বিদেশী একটি পত্রিকার প্রতিবেদনেও ফুটে উঠেছে। ২০১৬ সালের ১৮ মে ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় vidhi Doshi একটি সংবাদে বলেন, “ভারত সরকার ভারতের ৩০ টি নদীর মধ্যে সংযোগ খাল খনন করতে চাচ্ছে এক নদী থেকে পানি অরেক নদীতে নেওয়ার জন্য।”
ভারত যে তিস্তা নদী থেকে তার পানি অব্যহতভাবে প্রত্যাহার করে নেয় তার আরও ওকটি উদাহরণ নি¤েœ দেওয়া হল। বাংলাদেশ বর্ষা মৌসুমের পানি ধরে রেখে ৯১ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে নব্বয়ের দশকে এক হাজার কোটি টাকা ব্যায়ে তিস্তা সেচ প্রকল্প চালু করে। ভারতের কৌশল বুঝে ক্রমাগত পানি তুলে নেওয়ার ফলে ৯১ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ তো দুরের কথা তার অর্ধেক জমিতেও বর্তমানে সেচ দেওয়া যায় না। ২০১৭ সালের মার্চ পর্যন্ত প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
ভারত যে পর্যায়ক্রমে নদী থেকে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে তার আর একটি উদাহরণ পানির নায্য হিস্যা স্বাধীনতার পাঁচ দশকেও বাংলাদেশ না পাওয়া। আর এভাবে ভারত পানি প্রত্যাহার করে নিলে আগামী ৩০ বছরে বাংলাদেশের প্রায় ৬০ ভাগ মরুভূমিতে পরিণত হবে। তখন বাংলাদেশের পরিস্থিতি কি হবে ভাবা যায়। এরই মাঝে ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে সরকার প্রধান শেখ হাসিনা তার বহরসহ ভারত সফর করে এলেন। প্রতিরক্ষা সহযোগিতা-সমঝোতাসহ প্রায় তিন ডজন (জনশ্রুতি রয়েছে- সবগুলো চুক্তিই না-কি ভারতের স্বার্থে) চুক্তি করে এলেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে নিজ হাতে রান্নাও করে এলেন। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের চাওয়া-পাওয়ার বা অন্যতম আকাঙ্খার তিস্তা নদীর পানি-সে সম্পর্কে কিছুই করে এলেন না। বরং দেশে ফিরে এসে সংবাদ সম্মেলনে তিঁনি বললেন, “আমি কিছু চাইতে যাইনি। আমি বন্ধুত্ব চেয়েছি। ভারতের কাছে কোনও দেনা-পাওনার জন্য যাইনি, ¯্রফে বন্ধুত্ব চাইতে গিয়েছিলাম, বন্ধুত্ব পেয়েছি। দেশের মানুষের জন্য সম্মান বয়ে আনতে পেরেছি এটাই এই সফরের সবচেয়ে বড় অর্জন।” (সুত্র-দৈনিক ইনকিলাব, ১২ এপ্রিল ২০১৭)
ভারত তাহলে আগে কি ছিল বাংলাদেশের ? বন্ধু ছিল না। ভারত ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাও করেছিল আবার অপরদিকে গঙ্গা নদীতে সুযোগমত বাধও দিয়েছিল। এমনই তো ছিল বন্ধুত্ব। আবার স্বাধীনতার পর থেকেই ভারত সুযোগ বুঝে প্রায় সবগুলো নদীতে বাধ দেওয়া বা ব্যারেজ প্রকল্প নির্মানের ফলে বাংলাদেশ আজ তার নায্য পানি হিস্যা পাচ্ছে না তো বটেই বরং তা ধীরে ধীরে কমছে। বন্ধুর প্রতি ভারতের পানি অস্ত্র নীতির কারণে তিস্তা নদীর নায্য পানি বাংলাদেশ না পাওয়ায় উত্তরাঞ্চলের লক্ষ লক্ষ হেক্টর জমিতে কৃষক ভালভাবে ধান, পাট, গম, আলু, সরিষা, তিসি, যব, ভূট্টাসহ অন্যান্য ফসল চাষাবাদ করতে পারছে না। সেই তিস্তার পানি চুক্তি না করে এটা কেমন বন্ধুত্ব হলো। সফর শেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কেমন বন্ধুত্বের কথা বললেন। তিস্তা নদীর পানি নিয়ে শুধু আশ্বাস ছাড়া আর তো কিছুই আনতে পারলেন না। তাহলে ভারতের সাথে বাংলাদেশের এটা কেমন বন্ধুত্ব অর্জন-বাংলাদেশকে জল না দিয়ে শুকিয়ে মারার বন্ধুত্ব। বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের দাবি তিস্তা নদীর পানি চুক্তি না করে বরং ভারত তাদের এক মুখ্যমন্ত্রীর মাধ্যমে তোর্সা, ধরলা, জলঢাকাসহ চারটি নদীর পানি চুক্তির প্রস্তাব দিয়ে দিলেন। বাংলাদেশের প্রতি ভারত কৌশলে পানি অস্ত্র ব্যবহার করতেছে-এটা কি রকম বন্ধুত্বের নিদর্শন। বাংলাদেশের গবেষক, সুধী-সমাজ, সচেতন নাগরিকসহ আপামর জনসাধারণের তিস্তার পানি বিষয়ে-বন্ধুত্ব কতোটুকু-এটা এখনই ভাবার বিষয় এবং এর ভবিষ্যত কি তাও ভাবতে হবে। ভারতের এই পানি আগ্রাসনের বিষয়ে বাংলাদেশের দেশ-প্রেমিক জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে সোচ্চার না হলে ভবিষ্যৎ…………………………….।
লেখকঃ মোঃ মিজানুর রহমান-সাংবাদিক, কবি ও কলামিস্ট।