খােলা বাজার২৪।। সোমবার, ১লা মে ২০১৭ (সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার) : ১লা মে-মহান মে দিবস। এই দিবস শ্রমিকদের নায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামের এক ইতিহাস। এই ইতিহাস শ্রমিকদের মুক্তি অর্জন ও বিজয়ের এক ইতিহাস। এই মে দিবস শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক সংহতির একটা দিন। এই দিনটির সাথে বর্তমানে যুক্ত আছে বিশ্বের অসংখ্য শ্রমিক সংগঠন। বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই ১ লা মে-মে দিবস বা আর্ন্তজাতিক শ্রদিক দিবস হিসেবে পালন করা হয় এবং সরকারী ছুটিও থাকে। কিন্তু এই মে দিবসের পিছনে রয়েছে শ্রমিকদের এক মর্মন্তুদ কাহিনী।
আদিকাল থেকেই মানুষ বেঁচে থাকার জন্য, নিজের ভাগ্যকে সুপ্রসন্ন করার জন্য প্রকৃতির সঙ্গে শ্রম দিয়ে লড়াই করে টিকে থাকে। তারপর মানুষ ধীরে ধীরে শ্রমের পথে পা বাড়িয়ে এগুতো থাকে। আর এই শ্রম থেকেই সমাজে এক সময় ছিল দাস প্রথার প্রচলন। তারপর সেই দাসপ্রথা থেকেই শ্রমিক শ্রেণী সভ্যতার পথে অগ্রসর হয়েছে। আর এই সভ্যতার প্রতিটি ইমারত, দালান-কোঠা, স্থাপত্য, ইট, বালু, খোয়া, পাথরের সাথে একাকার হয়ে মিশে আছে শ্রমিকদের গতরের শ্রম ও ঘাম। শ্রমিকদের অবদানেই গড়ে উঠেছে আজকের আধুনিক সভ্যতা, আধুনিক নগর, আধুনিক জীবন-যাপন প্রনালী। আর এই শ্রমিক শ্রেণীদের আগে কাজ করতে হতো দৈনিক ১৪-১৮ ঘণ্টা। এভাবেই শ্রমিকরা সেই সময়ে প্রতিদিন কুলুর বলদের মতো খাটত। এরই মাঝে অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে ইংল্যা-ের সমাজবিজ্ঞানী ও সমাজ সংস্কারক রবার্ট ওয়েন সর্বপ্রথম শ্রমিকদের জন্য একটি তত্ত্ব প্রদান করেন। যে তত্ত্বটি ছিল-শ্রমিকদের জন্য দৈনিক ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৮ ঘণ্টা শ্রম, ৮ ঘণ্টা মনোরঞ্জন, ৮ ঘন্টা বিনোদনের। এই তত্ত্ব প্রদানের পর শ্রমিকদের যেন টনক নড়ল। কিন্তু শিল্প মালিকরা দ্রুত শিল্পায়ন আর বেশী মুনাফা লাভের লোভে শ্রমিকদের কাজের কোন নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিতে রাজি ছিলেন না। এমনকি তখনকার সময়ে শ্রমিকদের জন্য নির্দিষ্ট কোন ছুটির দিন পর্যন্ত ছিল না। এভাবেই শ্রমিকরা শোষণ-বঞ্চনার শিকার হয়ে আসছিল। ও দিকে শ্রমিকরাও ধীরে ধীরে সংগঠিত হতে থাকে। ইতিহাস থেকে জানা যায়-ভারত উপমহাদেশে শিল্প শ্রমিকদের প্রথম ধর্মঘট পালিত হয়েছিল নবগঠিত রেলওয়েতে। ১৮৬২ সালের এপ্রিল-মে মাসে হাওড়া স্টেশনে প্রায় ১২০০ রেল শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে এ ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করেছিল। (সুত্রঃ ভারতের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস, সুকোমল সেন, ৭৯ প্রষ্টা।) এই আন্দোলনের পর শ্রমিকরাও ধীরে ধীরে তাদের কাজের একটা নিদিষ্ট সময়ের ব্যাপারে (অর্থাৎ দৈনিক ৮ ঘণ্টা) আরো ঐক্য ও সংঘবদ্ধ হতে থাকে। শ্রমিকদের ক্রমাগত আন্দোলনের ফলে ১৮৮৪ সালের অক্টোবর মাসে আমেরিকার ফেডারেশন অব অর্গানাইজড ট্রেডস অ্যা- লেবার ইউনিয়ন একটা সময় বেঁধে দিয়েছিল ১ মে ১৮৮৬ সালের মধ্যে শ্রমিকদের ৮ ঘণ্টা শ্রমের বিষয়টিকে মানদ- হিসেবে বিবেচনা করতে। এর সর্মথনে ১লা মে ১৮৮৬ সালে আমেরিকায় হরতাল ও বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়। এই কর্মসূচির প্রথম তিনদিন মিছিল আর বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে শিকাগো শহরসহ পুরো আমেরিকা। পরেরদিন ৪ মে ঘটে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। এই দিন হালকা বৃষ্টি অপেক্ষা করে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি বিশাল মিছিল বের করে আন্দোলনরত শ্রমিকরা। এরপর হে মার্কট চত্বরে শুরু হয় নেতাকর্মীদের বক্তৃতা পর্ব। একাধারে বক্তৃতা চলে এবং বক্তৃতা চলাকালীন সময়ে শেষ বক্তা হিসেবে বক্তব্য দিতে আসেন আমেরিকার সমাজ সংস্কারক ও শ্রমিক নেতা স্যামুয়েল ফিন্ডেন। তখন সময় রাত সাড়ে দশটা। স্যামুয়েল ফিন্ডেন তার বক্তব্য শেষ করতে করতেই এগিয়ে আসে পুলিশ বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনী সভাস্থল ছেড়ে সবাইকে চলে যেতে বলে। এমনি সময়ে পুলিশের এগিয়ে আসা পথে ঘরে তৈরি একটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। বোমা বিস্ফোরিত হওয়ায় ঘটনাস্থলেই এক পুলিশ সদস্য নিহত হয়। আহত হয় আরো ৬৬ জন-যার মধ্যে ছয়জন পুলিশ সদস্য পরবর্তীতে মারা যায়। বোমা বিস্ফোরিত হওয়ার পর উভয়পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় শুরু হয় বলে পুলিশ দাবি করলেও ঐতিহাসিকদের মতে এ সময় পুলিশই শ্রমিকদের উপর গুলি ছোড়ে এবং নিজেদের গুলিতে তারা মারা যায়। গুলাগুলির এক পর্যায়ে মুহুর্তেই ফাঁকা হয়ে যায় আমেরিকার শিকাগোর হে র্মাকেট প্রাঙ্গন। রক্ত¯œাতের মাঝে বাস্তায় পরে থাকে শ্রমিকের লাশ। যদিও তখন বলা হয়েছে এতে নিহত হয়েছে চারজন শ্রমিক এবং আহত হয়েছে ৬০ জন। কিন্তু এর প্রকৃত সংখা ও প্রকৃত সত্য অনেকটাই আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। কিন্তু আড়ালে থাকে না সে সময়ে এই ঘটনার তথাকথিত বিচার কাজ। আন্দোলনকারী অনেক শ্রমিকদের সে সময় গ্রেফতার করা হয় এবং বিচারের মুখোমুখি করা হয়। বিচারে জুড়িবোর্ড আটজন আন্দোলনরত শ্রমিকদের মৃতুদ- প্রদানের পক্ষে মত দিলেও বিচারক সাতজনকে মৃত্যুদ- এবং একজনকে ১৫ বছরের কারাদন্ড প্রদান করেন। পরে উচ্চ আদালতও একই রায় বহাল রাখে। এরপর আমেরিকার অঙ্গরাজ্য ইলিনয়ের গর্ভনর রিচার্ড জেমস প্রতিবাদী শ্রমিক নেতা ফিলডেন এবং স্ত্রোয়ারের মৃত্যুদ- মওকুফ করে ১০ নভেম্বর ১৮৮৭ যাবজ্জীবন কারাদ- প্রদান করেন। তারপর বাকী পাঁজনের মৃত্যুর প্রহর গণনার দিন শুরু হয়। কিন্তÍু এ দিনই ঘটে আরেক বিষাদময় ঘটনা। মৃত্যুদ- সাজাপ্রাপ্ত পাঁচ জনের মধ্যে লিঞ্জ নামের এক বিপ্লবী শ্রমিক কৌশলে চুরুট বা মোটা সিগারেটের মতো দেখতে বিশেষ ধরনের হাতে তৈরি ব্লাস্টিং ক্যাপ (বোমা) সংগ্রহ করেন। চুরুটের মতোই তা মুখে পুরে তিনি তা বিস্ফোরণ ঘটান। আর এতে মুহুর্তেই লিঞ্জের মুখের অনেকাংশ আগলা হয়ে খসে পড়ে। কিন্তু এর পরেও লিঞ্জ ৬ ঘণ্টা বেঁচে ছিলেন-অতঃপর মারা যান। পরেরদিন ১১ নভেম্বর ১৮৮৭, বাকী চারজন বিপ্লবী শ্রমিক এঞ্জেল, ফিসার, পারসন্স ও স্পাইসকে নেওয়া হয় ফাঁসির মঞ্চে। ঐ বিপ্লবী চারজন শ্রমিক ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগুতে এগুতে শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে রচিত গণসংগীত ও বিপ্লবী গান গেয়ে যান। ফাঁসিতে ঝোলানোর ঠিক পূর্ব মুহুর্তে স্পাইস বলে যান, “এমন একদিন আসবে যেদিন আমাদের নীরবতা (মৃত্যু) তোমরা যে কণ্ঠ স্তব্ধ করতে চাও, তার চেয়েও শক্তিশালী হবে।”……..হয়ে যায় বিপ্লবী ঐ চারজন শ্রমিকের ফাঁসি কার্যকর। তাদের জীবন বৃথা যায় নি।
এর পর, ১৮৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকী উপলক্ষে ফ্রেডরিক অ্যাঙ্গেলসের নেতৃত্বে প্যারিসে দ্বিতীয় কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল প্রতিষ্ঠিত হয়। স্যোসালিস্ট লেবার ইন্টারন্যাশনালের সম্মেলনে জার্মান কমিউনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেটকিনের ঘোষণা অনুযায়ী ১৮৯০ সাল থেকে প্রতিবছর ১লা মে “মে দিবস” হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। এভাবেই আর্ন্তজাতিকভাবে ‘মে দিবস’ পালনের সূচনা হয়। আজ বিশ্বের অধিকাংশ দেশ ‘মে দিবস’ পালন করে এবং শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে গঠিত সংগঠন বা সংস্থাগুলোও ‘মে দিবস’ পালন করে। বাংলাদেশেও উদ্দীপনা-উৎসাহযোগে ‘মে দিবস’ পালন করা হয়। এ দিন সরকারী ছুটি ভোগ করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে আজও অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিকদের মুজুরী বৈষম্য দুর হয় নি। এখনও অনেক জায়গায় কর্মক্ষেত্রে পুরুষ ও নারী শ্রমিকদের পৃথক অবস্থানে রাখা হয়েছে। কিন্তু তারপরেও এই দেশে সরকার শ্রমিকদের একটা ন্যূনতম মুজুরি নির্ধারণ করে দিয়েছেন (যদিও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল), সরকারী চাকুরিজীবীদের বা সরকারী শ্রমিকদের বেতন প্রায় দ্বিগুন বৃদ্ধি করে দিয়েছেন। কিন্তু বেসরকারী চাকুরিজীবীদের বা বেসরকারী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে বেতন বৃদ্ধির বিষয়ে কিছুই করেন নি-যা দ্রব্রমূল্য উর্দ্ধগতির বাজারে অনেক বেশী বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। বেসরকারী চাকুরিতেও কিন্তু সরকারী চাকুরিজীবীদের মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়ে পাশ করা বা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যাক্তিবর্গ আছে-সেদিকে কর্তৃপক্ষের সু-দৃষ্টি রাখাই মনেহয় ভাল। কেননা, বেতন বৈষম্যের কারনে অনেক বেসরকারী চাকুরিজীবীরা চাপা অসন্তোষে আছে-তারা না পারতেছে কিছু বলতে, না পারতেছে সংসার চালাতে, মাঝামাঝি এক গ্যারাকলে পড়ে আছে। সরকারী বেতন বৃদ্ধির সাথে সাথে বাসাভাড়া থেকে শুরু করে কাঁচা বাজার-সব্জি সবখানেই দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। বেসরকারী চাকুরীজীবীরা বা বেসরকারী শ্রমিকরা কুলাতে পারছে না। তারাও তো অফিস-প্রতিষ্ঠানে সরকারী চাকুরিজীবীদের চেয়ে কম সময় দিচ্ছে না বরং আরো বেশী সময় দিচ্ছে। আজ এই শ্রমিক দিবসে কর্তৃপক্ষের সেদিকে দৃষ্টি দিলেই বেসরকারী চাকুরিজীবীদের বা বেসরকারী শ্রমিকদের জন্য ভাল হয়। আর মনেহয় এতেই মে দিবসের সাথে সংহতি প্রকাশ ও উৎসাহ-উদ্দীপনার ব্যাপকতা আরো বেড়ে যায়।
এই মে দিবস শ্রমিকদের অধিকার অর্জনের দিন, আর্ন্তজাতিক সংহতির দিন, বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের এক বিজয়ের দিন, ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ স্লোগানে নতুন সংগ্রামের জন্য তাদের শপত নেওয়ার দিন। অতএব, উপরের আলোচনার পেক্ষিতে এ কথা সহসাই বলা যায়, ১লা মে-শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের স্মরণীয় দিন।
লেখকঃ মোঃ মিজানুর রহমান-(সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার)