Wed. Apr 23rd, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

খােলা বাজার২৪।। সোমবার , ৫ জুন, ২০১৭: 28প্রতি বাজেট থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যে নানা ধরনের প্রভাব পড়ে। কোনো কোনো শিল্প খাত কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আবার কেউ লাভবান হন। এবারের বাজেট থেকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে নির্মাণ খাত। লাভবান হবে দেশীয় তথ্যপ্রযুক্তি খাত।
আমদানি শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক কিংবা মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট-সংক্রান্ত পরিবর্তনের কারণে রড, সিমেন্ট, পাথরসহ সব ধরনের নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়তে পারে, যা মেগা প্রকল্পসহ দেশের অবকাঠামো উন্নয়নকে আরও ব্যয়বহুল করে তুলতে পারে। অন্যদিকে সফটওয়্যার শিল্পের যেকোনো উৎপাদন ও সরবরাহকে ভ্যাটমুক্ত রাখা হয়েছে। দেশে মোবাইল ফোনসেট, কম্পিউটার, ল্যাপটপ তৈরির যন্ত্রাংশের আমদানি খরচ কমাতে শুল্কহার কমানো হয়েছে। আটটি সফটওয়্যার খাতকে কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, নির্মাণ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পণ্যে শুধু ভ্যাট থাকা উচিত। আমদানি শুল্ক, সম্পূরক শুল্কসহ সবকিছুই তুলে দেওয়া উচিত। দেশের অবকাঠামো উন্নয়নের স্বার্থে এটা করা উচিত। কিন্তু শুল্ক-কর রেখে দেওয়া হলো, এর মানে কি আমরা উন্নয়ন চাই না।
আহসান এইচ মনসুরের মতে, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে শুল্ক সুবিধা দেওয়া ঠিক আছে। এতে কর্মসংস্থান হবে। তবে বিভিন্ন পণ্যে ঢালাওভাবে সম্পূরক শুল্ক বসিয়ে স্থানীয় শিল্পকে প্রতিযোগিতাসক্ষম করতে দেওয়া হচ্ছে না। শুল্ক-কর কমিয়ে ওই শিল্প খাতকে প্রতিযোগিতাসক্ষম করতে দিলেই নিজের পায়ে দাঁড়াবে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, বছরের পর বছর স্থানীয় চিনিশিল্পকে সুরক্ষা দিয়ে কি লাভ হয়েছে? অন্য দেশের মানুষ যখন ৩৫-৪০ টাকায় এক কেজি চিনি খাচ্ছেন, আর আমরা খাচ্ছি ৬৫-৭০ টাকায়।
আন্তর্জাতিক আর্থিক নিরীক্ষা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রাইসওয়াটারহাউসকুপারস বাজেট প্রস্তাবগুলো বিশ্লেষণ করে বলেছে, স্থানীয় শিল্পে খাতভেদে ইতিবাচক ও নেতিবাচকÑদুই ধরনের প্রভাবই পড়তে পারে। ইতিবাচক প্রভাব পড়বে এমন খাতের মধ্যে অন্যতম হলো সিরামিকস, ব্যাটারি, তথ্যপ্রযুক্তি, এলপিজি সিলিন্ডার, দেশি রেফ্রিজারেটর, এসি। ফ্ল্যাট কেনাবেচায় ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসানো হলে আবাসন খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এ ছাড়া আমদানি পর্যায়ে আমদানি শুল্ক বা সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির কারণে বিদেশি সৌর প্যানেল, মোবাইল ফোনসেট, টেলিভিশন, পাদুকা, গাড়ির টায়ার, গুঁড়া সাবান, রংÑএসবের আমদানি খরচ বাড়বে।
নির্মাণ খাত
নির্মাণ খাতের অন্যতম কাঁচামাল সামগ্রী এমএস রড। এই রডে এখন সব মিলিয়ে টনপ্রতি ৯০০ টাকা ভ্যাট দিতে হয়। নতুন আইনের ফলে আমদানি কিংবা উৎপাদন থেকে শুরু করে সরবরাহ পর্যন্ত ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে। বর্তমান বাজারমূল্যে এক টন রডে ভ্যাট হবে সাড়ে ৭ হাজার টাকা। এতে ভোক্তার কাছে, অর্থাৎ নির্মাণস্থল পর্যন্ত পৌঁছাতেই খরচ বাড়বে সাড়ে ৬ হাজার টাকার বেশি।
এ ছাড়া কাঁচা লোহা কিংবা স্ক্র্যাপ থেকে রড তৈরির সময় ফেরো ম্যাঙ্গানিজ, ফেরো সিলিকন, ফেরো সিলিকো ম্যাঙ্গানিজসহ বিভিন্ন উপাদান লাগে। এবারের বাজেটে এই তিনটি পণ্যে আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ প্রত্যাহার করা হলেও আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ হারে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বসানো হয়েছে। এতে সার্বিকভাবে এসব পণ্য আমদানি খরচ বাড়বে, যা রড তৈরির খরচ আরও বাড়িয়ে দেবে।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অটো রি-রোলিং অ্যান্ড স্টিল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি মাসাদুল আলম বলেন, রডের কাঁচামালের দাম বাড়ছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বেড়েছে। এর ওপর ভ্যাট বাড়বে। সব মিলিয়ে রড ও ইস্পাত পণ্যের দাম ১০ হাজার টাকা বৃদ্ধির আশঙ্কা আছে।
এদিকে এরই মধ্যে বাজারে রডের দাম বেড়ে গেছে। রাজধানীর বিভিন্ন দোকানে টনপ্রতি রডের দাম দেড় থেকে ২ হাজার টাকা বেশি চাইছেন বিক্রেতারা। রামপুরার জেনারেল স্টিল হাউসের ব্যবস্থাপক তাজুল ইসলাম বলেন, গত শুক্রবার থেকে প্রতি টন রডের দাম ২ হাজার টাকা বেড়েছে। সরবরাহকারীরাই রডের দাম বাড়িয়েছে।
মাসাদুল আলম এ নিয়ে বলেন, ‘ভ্যাটের কারণে দাম বাড়ার আশঙ্কার কারণেই বাজারে এর প্রভাব পড়েছে। তা ছাড়া রড তৈরির জন্য স্ক্র্যাপ পাচ্ছি না। এর দামও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব কারণে রডের দাম বেড়েছে।’
এবার আসা যাক নির্মাণের আরেক প্রয়োজনীয় সামগ্রী সিমেন্ট। এই সিমেন্টের প্রধান কাঁচামাল ফ্লাই অ্যাশ। অর্থমন্ত্রী তাতে খরচ বাড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিলেন। ফ্ল্যাই অ্যাশ আমদানিতেও ১০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বসানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ভারত থেকে ফ্লাই অ্যাশ দিয়ে আমদানি করে অনেক উদ্যোক্তা সিমেন্ট কারখানা চালান। উল্লেখ্য, কোনো পণ্যের এসেস ভ্যালু বা শুল্কায়নযোগ্য মূল্যের ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বসিয়ে আমদানি শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক, ভ্যাটসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক শুল্ক-কর বসে।
রাস্তাঘাট, সেতু, ফ্লাইওভার, ভবনসহ বড় অবকাঠামো নির্মাণে অন্যতম উপাদান হলো পাথর। বড় বড় বোল্ডার ভেঙে এই পাথর তৈরি করা হয়। দেশের পাথরের চাহিদা মেটাতে ভারতের মেঘালয়, আসামসহ বিভিন্ন রাজ্য থেকে সারা বছরই শত শত টন বোল্ডার আমদানি করা হয়। আগামী ১ জুলাই থেকে বোল্ডার স্টোন ও স্যান্ডস স্টোন আমদানিতে যথাক্রমে ১৫ ও ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রক শুল্ক দিতে হবে।
সার্বিকভাবেই নির্মাণের তিনটি উপাদান রড, সিমেন্ট ও পাথরের দাম বাড়তে পারে। এতে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণের মতো মেগা প্রকল্পের খরচ বাড়িয়ে দিতে পারে। আর ব্যক্তি পর্যায়ে আবাসিক ভবনের খরচও বাড়বে।
তথ্যপ্রযুক্তি
প্রস্তাবিত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট থেকে দেশীয় তথ্যপ্রযুক্তি খাত সার্বিকভাবে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে। এ খাতে যেকোনো উৎপাদন ও সরবরাহ ভ্যাটমুক্ত রাখা হয়েছে। এতে দেশীয় উদ্যোক্তারা বেশি সুবিধা পাবেন। তথ্যপ্রযুক্তির আট ধরনের খাতকে ২০২৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো সাইবার নিরাপত্তা সেবা, সফটওয়্যার নির্মাণ, সফটওয়্যার বা অ্যাপ্লিকেশন কাস্টমাইজেশন, ওয়েবসাইট নির্মাণ, ওয়েবসাইট পরিচালনা, ডিজিটাল তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ, সফটওয়্যার টেস্ট ল্যাব সেবা, চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্র প্রতিলিপিকরণ (ওভারসিজ মেডিকেল ট্রান্সক্রিপশন) এবং রোবটনিয়ন্ত্রিত সেবা (রোবোটিক প্রসেস আউটসোর্সিং)।
এ ছাড়া দেশেই কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মুঠোফোনÑএসব পণ্যের উৎপাদনকে উৎসাহিত করতে এর যন্ত্রাংশ আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা হয়েছে। এগুলোর উৎপাদন খরচ ব্যাপকভাবে কমবে। মুঠোফোন আমদানিতে আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। ফলে মুঠোফোনের দেশীয় কোম্পানির আরও সুরক্ষা মিলবে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ছোট ছোট যন্ত্রাংশ যেমন মডেম, মেমোরি কার্ডসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশের ওপর আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে ১০ থেকে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। এর মানে হলো, সরকার চায় দেশেই এসব যন্ত্রাংশ উৎপাদিত হোক।
কৃষি ও পোলট্রি শিল্প
কৃষি খাতের বিদ্যমান সব ধরনের পণ্যের শুল্ক সুবিধা আগামী বছরেও অব্যাহত রাখা হয়েছে। দেশে কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপকরণের শুল্ক রেয়াত দেওয়া হয়েছে। ফলে দেশে কৃষিযন্ত্রের উৎপাদন খরচ কমবে। এই খাতটি বিকাশে সহায়তা পাবে।
অন্যদিকে দেশের সা¤প্রতিক সময়ে বিকাশমান পোলট্রি শিল্পের সুরক্ষা আরও বৃদ্ধি করেছেন অর্থমন্ত্রী। হাঁস-মুরগির খাবারের বেশির ভাগ চাহিদা অভ্যন্তরীণভাবে মেটানো হয়। আমদানি করা পোলট্রির খাবারের আমদানি শুল্ক ৫ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে।
মোটরসাইকেল
দেশের মোটরসাইকেল শিল্পকে উৎসাহ দিতে অনেক যন্ত্রাংশে শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়েছে। তবে এ সুবিধা পেতে হলে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) আবেদন করতে হবে। এনবিআর যাচাই করে অনুমোদন দিলে শুল্ক ছাড়ে যন্ত্রাংশ আমদানি করতে পারবে।
সিরামিক
সিরামিক শিল্পের বেশ কয়েকটি কাঁচামালে শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে সিরামিক শিল্প ট্যাল্ক, অ্যালুমিনা লাইনার ও ক্রুড মাইকা আগের চেয়ে ৫ শতাংশ কম আমদানি শুল্ক দিয়ে আমদানি করতে পারবে। এতে সিরামিক পণ্যের উৎপাদন খরচ কমবে। তবে টাইলস আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক ৬০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। এতে দেশীয় শিল্পকে আরেকটু প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়তে হবে।
ব্যাটারি শিল্প
দেশের ব্যাটারি শিল্পের তিনটি কাঁচামাল আমদানিতেও ৫ শতাংশ করে শুল্ক ছাড় দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। জিংক ক্যালটস, অ্যান্টিমোনি আর্টিকেলস, আর্সেনিক আমদানিতে খরচ কমলে ব্যাটারির উৎপাদন খরচ কমবে।