Thu. Apr 24th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

খােলা বাজার২৪।। বৃহস্পতিবার , ৮ জুন, ২০১৭: 2মিয়ানমারে হারাকা আল ইয়াক্বিন নামে বিচ্ছিন্নতাবাদী একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ সে দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশকেও অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। নতুন এ গোষ্ঠী গত বছরের ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ওপর হামলা চালায়।
ব্রাসেলসভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ গত বছরের ডিসেম্বরে ‘মিয়ানমার: এ নিউ মুসলিম ইনসারজেন্সি ইন রাখাইন স্টেট’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, হারাকা আল ইয়াক্বিনের সদস্যরা অত্যন্ত চৌকস ও গেরিলা যুদ্ধে পারদর্শী। এর নেতৃত্বে আছেন ২০ জন সৌদিপ্রবাসী রোহিঙ্গা। তাঁদের প্রায় সবাই গত দুই বছরে একাধিকবার বাংলাদেশে এসেছেন। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে পাকিস্তানের দৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে। ভারতেও তাদের যোগাযোগ রয়েছে।
ঢাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তাঁরা কোনো কিছু জানেন না বলে জানিয়েছেন। তবে টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় সব শরণার্থী শিবিরেই দলটির সমর্থক রয়েছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটিজ স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) রিসার্চ ফেলো শাফকাত মুনীর এ প্রসঙ্গে বলেন, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন একটি গোষ্ঠীর উত্থান বাংলাদেশের জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণ হতে পারে। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের মানুষের সহানুভূতিকে কাজে লাগিয়ে দেশের ভেতরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। হারাকা আল ইয়াক্বিনের সঙ্গে এ-দেশীয় অন্য জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো কোনো যোগাযোগ করছে কি না, সে ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া প্রয়োজন।
ঢাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহনীর একজন কর্মকর্তা বলেন, গত বছরের ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডুতে বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) চেকপোস্টে হামলার পর ভিডিও প্রকাশ করে দায় স্বীকার করে হারাকা আল ইয়াক্বিন। তার আগ পর্যন্ত সংগঠনটি সম্পর্কে রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলিমরাও জানতেন না।
মাস পাঁচেক আগে রাখাইনের শিলখালি থেকে টেকনাফে আসা মোহাম্মদ বেলাল নামের এক শরণার্থী বলেন, তাঁরা হারাকা আল ইয়াক্বিন নামে সংগঠনের কথা শুনেছেন বিজিপি চেকপোস্টে হামলার পর। তবে সেই সময়ের আগে-পরে তাঁদের গ্রামে অপরিচিত কিছু লোক এসেছিলেন। গ্রামবাসীও স্বেচ্ছায় তাঁদের খাবার ও আশ্রয় দেন।
শরণার্থী ক্যাম্পের বাসিন্দারা জানান, হামলার দুই দিন পর ১১ অক্টোবর প্রথম ভিডিও প্রকাশ করা হয়। ভিডিওতে যাঁকে কথা বলতে দেখা যায় তাঁর নাম আতা উল্লাহ ওরফে আমির আবু আমর ওরফে আবু আমর জুনুনি। মিয়ানমার সরকার তাঁকে হাফিজ তোহার নামে চিহ্নিত করেছে। এই আতা উল্লাহ রাখাইনের উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন। সেখান থেকে পাকিস্তান হয়ে সৌদি আরব চলে যান। ২০১২ সালে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের পর তিনি সৌদি আরব ছেড়ে চলে যান। ধারণা করা হয়, তিনি পাকিস্তানে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ভিডিওতে তাঁকে কক্সবাজারের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে শোনা গেছে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ ও বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, ৯ অক্টোবর হামলার আগে বাংলাদেশের কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির থেকে অন্তত ২০০ শরণার্থী রাখাইনে যান। ক্রাইসিস গ্রুপ এই গোষ্ঠীর ছয়জনের সাক্ষাৎকার নেয়। তাঁদের চারজন ছিলেন উত্তর মংডুতে ও দুজন মিয়ানমারের বাইরে।
জানতে চাইলে টেকনাফে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের অধিনায়ক লে. কর্নেল এস এম আরিফুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের শরণার্থী শিবির থেকে রাখাইনের মংডুতে গিয়ে হামলা চালানোর খবর তাদের কাছে নেই। তবে সংগঠনটির নেতা আতা উল্লাহর প্রচুর সমর্থক বাংলাদেশে আছেন বলে তিনি শুনেছেন।
অধিনায়ক বলেন, বেশ কিছুদিন আগে উখিয়ার অনিবন্ধিত ক্যাম্পে ২০-২৫ জন তরুণকে কারাতে প্রশিক্ষণ নিতে দেখা গেছে। পরে সেই প্রশিক্ষণ বন্ধ করে নজরদারি বাড়ানো হয়। বাংলাদেশের স্পষ্ট অবস্থান হলো, এই ভূখ- ব্যবহার করে কেউ যেন অন্য কোনো দেশের ভূখ-ে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে না পারে।
ক্যাম্পে অবস্থানরত একাধিক সূত্র জানিয়েছে, কক্সবাজারের নয়াপাড়া শরণার্থী শিবিরের সি ব্লকে বসবাসরত এক ব্যক্তি টেকনাফে হারাকা আল ইয়াক্বিনের পক্ষে সদস্য সংগ্রহ করছেন। ওই ব্যক্তির বাবা প্রায় দুই যুগ আগে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে বাংলাদেশে আসেন। পরে পাকিস্তান হয়ে সৌদি আরবে চলে যান। এর বাইরেও বালুখালি ও কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের কমপক্ষে পাঁচজনের নাম শোনা গেছে, যাঁরা একইভাবে সদস্য সংগ্রহ করছেন।
কীভাবে সদস্য সংগ্রহ করা হয় জানতে চাইলে কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের এক দলনেতা (ক্যাম্পের দলনেতা মাজি নামে পরিচিত) বলেন, তাঁরা প্রথমে একজনকে দলে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানান। পরে তাঁকে দিয়ে নতুন একজনকে যুক্ত করেন। টেকনাফের পাহাড়ে স¤প্রতি ২০ থেকে ২৫ জনের একটি দল প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বলে তিনি স্বীকার করেন।
২ থেকে ৬ জুন পর্যন্ত কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালি ও কুতুপালং এবং টেকনাফের লেদা ক্যাম্পের শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্যাম্পের বাসিন্দারা নতুন এই গোষ্ঠীটিকে সমর্থন দিচ্ছেন। তাঁরা ‘আল এক্বিন’ নামে গ্রুপটিকে চেনেন। তাঁদের দাবি, ওই গোষ্ঠীতে তাঁদের সন্তানেরা রয়েছে। তারা ‘মুক্তিযুদ্ধ’ করছে। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির থেকেও প্রয়োজনে রাখাইনে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাওয়ার জন্য কিছু তরুণ প্রস্তুত আছে বলে তাঁরা জানান।
হারাকা আল ইয়াক্বিনের সদস্যরা অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ কোথা থেকে পাচ্ছে, জানতে চাইলে প্রায় কেউই মুখ খোলেননি। তবে পালংখালি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আবছার বলেন, বনরক্ষীদের কেউ কেউ প্রশিক্ষণরত অবস্থায় হারাকা আল ইয়াক্বিনের সদস্যদের দেখেছেন।
এর আগে সেপ্টেম্বর ২০১৫তে কক্সবাজারের টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের তইঙ্গা পাহাড়ে ২০ থেকে ২৫ জনের সশস্ত্র সন্ত্রাসী দল অবস্থান করছে এমন খবর ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোগে মাইকে ঘোষণা করা হয়। হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সৈয়দ হোসেন বলেন, জুমচাষিরা মুখোশ ও অস্ত্রধারীদের দেখতে পেয়ে তাঁকে খবর দেয়। পরে পুলিশ গিয়ে তাদের পায়নি।
জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার মো. ইকবাল বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর ওপর তাঁদের সার্বক্ষণিক নজরদারি আছে। কখনো সন্দেহ করার মতো কিছু তাঁদের চোখে পড়েনি।
পুলিশ জানায়, বিদেশ থেকে মসজিদ-মাদ্রাসার জন্য টাকা এনে বাংলাদেশের ভেতরে মিয়ানমারের জঙ্গি সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টার অভিযোগে ইমাম মুসলিম ইসলামিক সেন্টারের অধ্যক্ষ সালাহুল ইসলাম, মৌলভি সৈয়দ করিম, মো. ইব্রাহিম ও মো. আলীর বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে করা মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
আশির দশকের উগ্রবাদী সংগঠন আরএসওকে এখনো চোরাগোপ্তা হামলার জন্য দায়ী করে থাকে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সাবেক এক আরএসও নেতা বাংলাদেশে প্রায় ২০০ তরুণকে হারাকা আল ইয়াক্বিনের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। প্রথম আলো