খােলা বাজার২৪।। শনিবার , ১০জুন, ২০১৭: পরামর্শ না নিয়ে কমিটি গঠন, কমিটিতে স্থান পেলেও সিনিয়রিটি রক্ষা না হওয়া, আবার দলের জন্য ত্যাগ থাকলেও একেবারে কমিটিতেই স্থান না পাওয়ার অনলে পুড়ছে বিএনপি। এজন্য অনেক প্রবীণ নেতাকে দলের কাজে নিষ্ক্রিয় থাকতে দেখা যায়, কেউ কেউ আবার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে দল থেকে সপরিষদ পদত্যাগও করেছেন। কমিটি থেকে বাদ পড়ে অনেকে আবার দলের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে চলেছেন ‘আদা জল খেয়ে’। এতে সাংগঠনিকভাবে তেমন ‘ক্ষতি’ না হলেও দলের ‘ইমেজ’ সংকট দেখা দিয়েছে বলে তৃণমূল নেতাকর্মীরা মনে করেন।
স¤প্রতি দলের সাংগঠনিক পদ থেকে পদতাগ করেছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ারুল আজিম। সাংগঠনিক সম্পাদক পদের মতো দলের ওপরের স্তরের পদবিধারী এক নেতার পদত্যাগের পরেই বিএনপির ভেতরেই যে অনল জ্বলছে তা আবার প্রকাশ্য হয়ে পড়ল বলে অনেকেই মনে করেন। আনোয়ারুল আজিম ‘অগণতান্ত্রিকভাবে অখ্যাতদের’ নিয়ে কুমিল্লার লাকসাম উপজেলা ও পৌরসভা এবং মনোহরগঞ্জ উপজেলা যুবদল-ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণার প্রতিবাদে দল থেকে সরে পড়ার জন্যই পদত্যাগ করেছেন বলে জানিয়েছেন। তার সঙ্গে শতাধিক নেতাকর্মীও পদত্যাগ করেছেন বলে এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন কুমিল্লা-৯ (লাকসাম-মনোহরগঞ্জ) আসনের সাবেক এই এমপি।
আনোয়ারুল আজিম বলেন, সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিকভাবে স্থানীয় যুবদল ও ছাত্রদলের কমিটি করায় সেখানকার নেতাকর্মীরা হতাশ। বিষয়টি আমি কেন্দ্রকে জানিয়েছি। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাইনি বলে আমি গতকাল নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করে পত্র জমা দিয়েছি।
স¤প্রতি ঘোষণা করা এসব কমিটির সভাপতি-সম্পাদকসহ উল্লেখযোগ্য পদে দায়িত্ব পেয়েছেন কেন্দ্রীয় বিএনপির শিল্পবিষয়ক সম্পাদক ও লাকসাম উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবুল কালাম ওরফে চৈতি কালামের অনুসারীরা। কুমিল্লা-৯ (লাকসাম-মনোহরগঞ্জ) আসনে বিএনপির দলীয় মনোনয়ন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছিল আনোয়ারুল আজিম ও আবুল কালামের মধ্যে। তবে বিএনপির মূলধারার নিয়ন্ত্রণ ছিল আনোয়ারুল আজিমের হাতেই।
তবে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা মনে করেন, আনোয়ারুল আজিম দলের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থেকে হঠাৎ করে পদত্যাগ করা ঠিক হয়নি। এতে দলের তেমন কোনো ক্ষতি না হলেও ইমেজ সংকট দেখা দেবে। বিএনপির চেয়ারপার্সনের ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, খালেদা জিয়া আনোয়ারুল আজিমের পদত্যাগকে ভালোভাবে নেননি। দলের এই সংকটময় মুহূর্তে কমিটি গঠনের বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের দৃষ্টিগোচর করা যেত বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে একইদিন নিজের ফেইসবুক অ্যাকাউন্টের টাইম লাইনে খালেদা জিয়ার প্রতি খোলা চিঠি লিখেছেন দলের সাবেক সহ-প্রচার সম্পাদক মহিউদ্দিন খান মোহন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সহকারী প্রেস সচিব এই মোহন ‘দেশনেত্রীর প্রতি খোলা চিঠি’ শিরোনামে ওই স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘আপনি (খালেদা জিয়া) কি খেয়াল করেছেন, এ দেশের গণমানুষের প্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপির বর্তমান দুর্দশা কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে? আজ বিএনপি রাস্তায় বেরুতে ভয় পায়। কর্মসূচি দিলে নেতাকর্মীরা আসে না। কোনো ইস্যুতে কেন্দ্রীয় কোনো প্রতিবাদ কর্মসূচি নেয়া হয় না। এই তো সেদিন আপনার অফিস তল্লাশির প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি চাইল। কিন্তু সরকার দিল না। এর প্রতিবাদে কর্মসূচি দেয়া হলো মহানগরীর থানায় থানায় আর সারাদেশে জেলায় জেলায় বিক্ষোভ মিছিলের। কেন, ঢাকা মহানগর বিএনপি কি কেন্দ্রীয়ভাবে বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি দিতে পারত না? নাকি সেটার জন্যও তারা সরকারের অনুমতির অপেক্ষায় ছিল? যেদিন সোহরাওয়ার্দীতে সমাবেশের অনুমতি পাওয়া গেল না, সেদিন কেন্দ্রীয় নেতারা কেন সেখানে গেলেন না? সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, বিএনপি কি সরকারের একান্ত বাধ্যগত দলে পরিণত হয়েছে? সরকার অনুমতি দিলে দল রাজনীতি করবে, না হলে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে?’
উল্লেখ্য, পঞ্চম ও ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে বিএনপির যে কমিটি গঠিত হয়, তাতে মহিউদ্দিন খান মোহনকে রাখা হয়নি। এজন্য তিনি গত বছরের ১২ আগস্ট বিবৃতি দিয়ে দলের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেন। ওই সময় পর্যন্ত তিনি মুন্সীগঞ্জ জেলা বিএনপির উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
রাগে-লজ্জায়-অভিমানে নিজের নামের পাশ থেকে বিএনপি নেতা শব্দটি বাদ দিয়ে দিয়েছেন বিএনপি ‘ভাইস চেয়ারম্যান’ আবদুল্লাহ আল নোমান। আগেই ছেঁটে ফেলেছিলেন বিএনপির ‘ভাইস চেয়ারম্যান’ পদবি। সেই পদবির স্থলে লিখে আসছিলেন ‘বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা’ ও ‘সাবেক মন্ত্রী’। এবার সেই ‘নেতা’ শব্দটিও বাদ। যোগ করেছেন ‘কর্মী’ শব্দটি। কেন্দ্রীয় কমিটিতে কাক্সিক্ষত মূল্যায়ন না হওয়ায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলে প্রবীণ এই বিএনপি নেতা অন্য রকম এক প্রতিবাদের অংশ হিসেবে একের পর এক পদবি ছেঁটে ফেলছেন।
উল্লেখ্য, বর্তমান কমিটি গঠনের সময় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য পদ পাওয়ার আশা করলেও ভাইস চেয়ারম্যান পদেই বহাল রাখা হয় তাকে। এ নিয়ে চট্টগ্রামে তার অনুসারী বিএনপির নেতাকর্মীরা রীতিমতো আন্দোলন গড়ে তোলেন। এমনকি দল ছাড়ার কথাও ভাবেন নোমান। কিন্তু স্থায়ী কমিটির দুটি পদ খালি থাকায় শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শে ধৈর্য ধারণ করেন। দীর্ঘ সময় পরও হাইকমান্ড থেকে ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ায় এ রকম সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
জানতে চাইলে ‘ভাইস চেয়ারম্যান’ ও ‘কেন্দ্রীয় নেতা’ পদবিগুলো নানা কারণে নিজের জন্য বিব্রতকর বলে জানিয়েছেন আবদুল্লাহ আল নোমান। তিনি বলেন, আমি সব সময় নিজেকে কর্মী পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। দল আমাকে যথাযথ মূল্যায়ন না করলেও জনগণ ও বিএনপির সাধারণ নেতাকর্মীরা আমাকে ভালোবাসে। এটাই আমার বড় পাওয়া।
সবশেষ কাউন্সিলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান পদ পাওয়া শাহ মোয়াজ্জেম প্রত্যাশিত ‘স্থায়ী কমিটির সদস্য’ পদ না পেয়ে ছিলেন ক্ষুব্ধ। এতে তার অনুসারীরা হতাশ হয়। বেশিরভাগ সময় নিজেকে আড়াল করে রাখেন এ প্রবীণ রাজনীতিবিদ। সর্বশেষ ২৩ মার্চ সন্ধ্যায় বিএনপির প্রয়াত মহাসচিব কেএম ওবায়দুর রহমানের স্মরণসভায় বক্তা ছিলেন তিনি। সভায় বিএনপি মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতারা উপস্থিত ছিলেন। শাহ মোয়াজ্জেম কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য না দিয়েই রাজনীতিতে আর না থাকার কথা ঘোষণা দেন। তার এ ঘোষণায় ঝরে পড়েছে অভিমান।
এই প্রবীণ রাজনীতিক বললেন, বিএনপির কাউন্সিল হলো, কমিটি হলো, অনেকে অনেক পদ পেয়েছে। আমি সেসব নিয়ে কিছু বলতে চাই না। আজকে অনেকে এসেছেন, আমি কিছু বলব তা শুনবেন। কিন্তু আমি আজ রাজনীতি নিয়ে কিছু বলব না। আজকে এ মুহূর্ত থেকে আমি আর রাজনীতিতে থাকছি না।
সংস্কার ইস্যুকে কেন্দ্র করে দলের ভেতর বিভক্তির রেখা মোছা যায়নি এখনো। কিছু সংস্কারপন্থি নেতাকে দলীয় পদ-পদবি দেয়া হলেও অনেককে বসিয়ে রাখা হয়েছে ‘সাইডলাইনে’। এতে অনেক জায়গায় ‘যোগ্য’ নেতৃত্বের অভাব সৃষ্টি হয়েছে। স¤প্রতি জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের এক সময়কার ডাকসাইটে নেতা সানাউল হক নিরু তার ফেইসবুক ওয়ালে প্রশ্ন রেখে জানতে চেয়েছেন, এ দেশের সর্ববৃহৎ ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপিকে প্রতিনিয়ত আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে দেখে প্রায়ই খটকা লাগে, আসলে এ দলটি চলে কার নির্দেশে? এ দলের পরিচালক কে?
দার্শনিক থেলিসের এক বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন, ‘যে নিজেকে দমন করতে পারে না, সে নিজের জন্যও বিপজ্জনক এবং অন্য সবার জন্যও।’
এরপর তিনি তার স্ট্যাটাসে বলেন, ফালু, হারিস, খোকা, বাবর, আমান গংয়ের বিএনপি নিয়ন্ত্রণের মাজেজা কী! প্রায়শই মনে হয় নেত্রী এদের হাতের ক্রীড়নক কিংবা উনি এক এক সময় এক এক পরিচালকের হাতের খেলার পুতুল। এরা নব্য বিএনপি, কেউ শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জীবদ্দশায় বিএনপির রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়নি।
এজন্য দলের কেন্দ্রীয় কমিটির ৫০২ জনসহ চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা কমিটির আরো প্রায় ১০০ সদস্যের মধ্যে হাতেগোনা দু-চারজন ছাড়া তেমন কাউকেই এখন আর মাঠে-ঘাটে দেখা যায় না। মানবকণ্ঠ