খােলা বাজার২৪।। বুধবার ,১৪ জুন, ২০১৭: কাতার সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে বাংলাদেশের জ্বালানি খাত হোঁচট খেতে পারে। দেশে বিদ্যমান গ্যাস সংকটের ভবিষ্যৎ সমাধানে সরকার কাতার থেকে আনা লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাসের (এলএনজি) ওপর নির্ভরশীল হওয়ার যে পরিকল্পনা করেছে, তা চরম বাধাগ্রস্ত হবে।
প্রায় এক যুগ ধরে বাংলাদেশে গ্যাস সংকট চলছে। এ সংকট দিন-দিন প্রকট হচ্ছে। গ্যাস সংকটের কারণে অভ্যন্তরীণ তো বটেই, বিদেশি বিনিয়োগও চরম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শিল্প-বাণিজ্য, বিদ্যুৎ ও আবাসিকসহ সব খাত মিলিয়ে বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা প্রতিদিন ৩৫শ মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু সরবরাহ হচ্ছে ২৭শ মিলিয়ন ঘনফুট। সেই হিসাবে প্রতিদিন ৮শ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে। জ্বালানির ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে তাই ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানির বিকল্প দেখছে না সরকার।
ফলে সরকার গ্যাসের সংকট মেটাতে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। এলএনজি আমদানি করে সরবরাহের লক্ষ্যে এলএনজি টার্মিনাল, পাইপলাইন স্থাপনসহ নানা অবকাঠামো গড়ে তুলছে। এ অবস্থায় এলএনজি সরবরাহের অন্যতম উৎস মধ্যেপ্রাচ্যের দেশ কাতারকে ঘিরে সংকট তৈরি হওয়া বাংলাদেশের জন্য দুঃসংবাদই বটে।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, কাতার সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে অবশ্যই আমাদের পরিকল্পনায় ছেদ ঘটবে। তিনি বলেন, বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানির যে পরিকল্পনা সরকার করছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মধ্যেপ্রাচ্যের কাতার। কাতার সংকট দীর্ঘস্থায়ী হবে না বলেই আমাদের প্রত্যাশা।
বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমাদের পরিকল্পনায় কাতারের এলএনজি থাকলেও এখন আমরা বহুমুখী চিন্তা করব। আমাদের যে পরিমাণ এলএনজি দরকার তা কয়েকটি দেশ থেকে আনার উদ্যোগ নেব।
বিশ্বে এলএনজি বাজারের বড় অংশ দখল করে আছে কাতার। বিশ্বে এলএনজির বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ মধ্যপ্রাচ্যের এ ক্ষুদ্র দেশটি। ২০১৬ সালে প্রায় ৭ কোটি ৭২ লাখ টন এলএনজি রপ্তানি করেছে তারা। কাতারের এলএনজির বড় ক্রেতাদের অধিকাংশই এশিয়ার। জাপান ও চীনের পাশাপাশি ভারতও বিপুল পরিমাণ এলএনজি আমদানি করে দেশটি থেকে। ইন্টারন্যাশনাল গ্যাস ইউনিয়নের তথ্য অনুযায়ী, বিগত বছরে বিশ্বে মোট এলএনজির এক-তৃতীয়াংশ যোগান দিয়েছে কাতার।
এদিকে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান বিদেশি একটি গণমাধ্যমকে বলেছেন, কাতার সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে সে দেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাদের কাছ থেকে এলএনজি আমদানির কথা রয়েছে?সেটিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক সংকট যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তা হলে তা বাংলাদেশের জন্য শঙ্কার কারণ হবে?
প্রসঙ্গত এবারের বাজেটেও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত গ্যাস সংকট সমাধানের উপায় হিসেবে দেশের গ্যাস ক্ষেত্রগুলোতে কূপ খননের পাশাপাশি বিদেশ থেকে আমদানিকৃত এলএনজির কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, সুসংহত অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সরবরাহ সংকট উত্তরণের অন্যতম পূর্বশর্ত হলো বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অর্থবহ উন্নয়ন। আমাদের অন্যতম অগ্রাধিকার হচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তিনি বলেন, দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে দ্রুত এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনসহ অন্যান্য প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম সম্পন্ন করছি। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে এলএনজি আমদানির কার্যক্রম চলমান আছে। ২০১৮ সালের শেষ নাগাদ সব শিল্প প্রতিষ্ঠানে গ্যাস সরবরাহে আমরা সক্ষম হব।
এদিকে এলএনজি আমদানিকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটিও গঠন করেছে। এ কমিটি শুধু এলএনজি আমদানিতে নেওয়া বিভিন্ন প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নে কাজ করবে। এলএনজি আমদানিকে কেন্দ্র করে সরকার নানামুখী কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। কক্সবাজারের মহেশখালীতে একটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের জন্য মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির সঙ্গে ইতোমধ্যে চুক্তি করেছে সরকার। এর বাইরে পেট্রোবাংলা আরও দুটি স্থায়ী এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগ দুটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে পাওয়ারসেল একটি টার্মিনাল নির্মাণ করবে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) একটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করবে। ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানি সামিট পাওয়ার একটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেছে।
আমদানিকৃত এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিরাট পরিকল্পনাও রয়েছে সরকারের। এলএনজিভিত্তিক তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব এসেছে সরকারের কাছে। এর মধ্যে নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি খুলনায় ৭৫০ থেকে ৮৫০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করবে। দেশের বৃহৎ বেসরকারি কোম্পানি সামিট পাওয়ার ১৬৫০ মেগাওয়াটের এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছে। এমসিপি নামে অন্য একটি কোম্পানিও ৮৫০ মেগাওয়াটের এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে চায়। ভারতের রিলায়েন্স পাওয়ার বাংলাদেশে ৪ হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছে। এলএনজিকে কেন্দ্র করে এতসব পরিকল্পনার পর এর প্রধান উৎসদেশ কাতারকে নিয়ে সংকট তৈরি হওয়ায় এলএনজি আমদানিতে সমস্যা তৈরির পাশাপাশি দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে ঝুঁঁকিতে পড়তে পারে এলএনজি খাতে বিনিয়োগকারীরা।
ইতোমধ্যে এলএনজির কাঁচামাল আমদানি করতে কাতারের রাশগ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তিও করেছে পেট্রোবাংলা। ফলে কাতার সংকট দীর্ঘায়িত হলে এলএনজির উৎস নিয়ে বাংলাদেশ বিপাকে পড়তে পারে। আমাদের সময়