খােলা বাজার২৪।। সোমবার, ১৯ জুন, ২০১৭: আলু একটি অত্যন্ত মুখরোচক উদ্ভিজ্জ খাদ্য। এটি একটি সুষম ও পুষ্টিকর খাবারও। উচ্চ পুষ্টিমান এবং সহজে ফলানো ও সংরক্ষণ করা যায় বলে এটি বিশ্বের সর্বাপেক্ষা প্রচলিত সবজিগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং ভুট্টা, গম ও চালের পরে পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম খাদ্যশস্য। আলুর মধ্যে ভাতের তুলনায় প্রোটিন ও শর্করা কম থাকলেও অন্যান্য উপাদান, বিশেষ করে ফাইবার বা তন্তু, খনিজ লবণ (পটাসিয়াম) ও ভিটামিনের পরিমাণ বেশি। অন্যদিকে কেজি প্রতি আলুর দাম চালের চেয়ে কম। এজন্যই বোধ হয় আমাদের দেশে চালের দাম বাড়লে কিছু কিছু বিজ্ঞ রাজনীতিক অজান্তেই ভাতের বদলে জনগণকে আলু খাওয়ার পরামর্শ দেন। অবশ্য ভাতের বদলে না খেলেও আলু আমাদের দেশে একটি অত্যন্ত প্রচলিত ও জনপ্রিয় খাবার। ডায়েটিসিয়ানরাও ভাত ও আলুর মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য দেখেন না। তবে ভাত ও আলু দুটোরই সূচক উঁচু— যার অর্থ হচ্ছে দুটোই খাওয়ার খুব অল্প সময়ের মধ্যে রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। এজন্য দুটো খাবারের ব্যাপারেই ডায়াবেটিক রোগীদের সতর্ক থাকা দরকার।
একইসাথে অনেক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, ভাজা আলু খাওয়া একটি উচ্চ মৃত্যুঝুঁকি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। অতি সম্প্রতি American Joual of Clinical Nutrition এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে উত্তর আমেরিকার মানব স্বাস্থ্যের উপর ভাজা আলু খাওয়ার নানা নেতিবাচক দিক তুলে ধরা হয়েছে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, যারা সপ্তাহে ২/৩ বারের বেশি ভাজা আলু খায়, তাদের অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেশি। তবে আশার কথা, গত বৎসর একই জার্নালে প্রকাশিত সুইডিশ জনগণের উপর পরিচালিত অন্য একটি গবেষণায় জানা যায় যে, না-ভাজা আলু নিরাপদ। এর সঙ্গে হৃদরোগ হওয়ার ঝুঁকি সম্পর্কিত নয়।
গত বছর American Joual of Clinical Nutrition-এ প্রকাশিত আরেকটি পর্যবেক্ষণমূলক পরীক্ষায় না-ভাজা আলু খাওয়ার সাথে স্থূলতা (Obesity) ও টাইপ-২ ডায়াবেটিসের কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে উক্ত পরীক্ষায় এটা বলা হয়েছে যে, ভাজা আলু বা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খাওয়ার সাথে এ-দুটি বিষয়ের সম্পর্ক থাকতে পারে।
মোদ্দা কথা গবেষণালব্ধভাবে প্রমাণিত যে, ভাজা আলু খাওয়ার সাথে অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি, হৃদরোগ, স্থূলতা ও টাইপ-২ ডায়াবেটিসের যোগসূত্র আছে। আর মানুষ ইচ্ছে করলেই অথবা খাবারের অভ্যাস পরিবর্তন করে ভাতের বদলে আলু না ভেজে বিভিন্ন রকম সুস্বাদু খাবার তৈরি করে খাওয়ার অভ্যাস করতে পারে। স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য এটা জুতসই ও উপযোগী হতে পারে, বিশেষ করে যখন চালের দাম বেশি থাকে। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেই অধিকাংশ মানুষ ভাতের পরিবর্তে বেশি করে আলু খায়, বিশেষ করে আলু-ভর্তা জাতীয় খাবার।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের আধুনিকতা, আর্থ-সামাজিক উন্নতি, শিক্ষা, জ্ঞান ও অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত সচেতনতা বৃদ্ধি পেলেও এবং ভাজা আলু খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর জেনেও আমরা বড়রাও অহরহ ভাজা আলুর বিভিন্ন রকম খাবার খেয়ে যাচ্ছি এবং একই সাথে আমাদের বাচ্চাদেরও খাওয়াচ্ছি। এটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অভ্যাসের কারণে হচ্ছে। অন্যদিকে অল্প কিছু মানুষ এর নেতিবাচক ও খারাপ দিকগুলো জেনেও এটিকে তথাকথিত সামাজিক মর্যাদা ও স্মার্টনেসের সাথে গুলিয়ে ফেলছে। এসব ব্যাপারে সরকারের তরফ থেকেও গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
স্বাস্থ্য মহাপরিচালকের দপ্তরে অবস্থিত হেলথ প্রমোশন অ্যান্ড হেলথ এডুকেশন ইউনিটকে এব্যাপারে বিশেষ নজর ও গুরুত্ব দিতে হবে এবং ভাজা আলুসহ সব অস্বাস্থ্যকর খাবারের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। একই সঙ্গে কনজুমারস্ অ্যাসোসিয়েশন ও এনজিওগুলোকেও এব্যাপারে এগিয়ে এসে সরকারের উদ্যোগে সামিল হতে হবে।
প্রসঙ্গত আর একটি কথা না বলে পারছি না। আমাদের মাননীয় অর্থমন্ত্রী মহোদয় ও এনবিআর-এর চেয়ারম্যান ব্যাংকের ক্ষুদ্র আমানতদারীদের উপর আবগারী শুল্ক না বাড়িয়ে ও সঞ্চয়পত্রের সুদ না কমিয়ে বিড়ি-সিগারেট, মদ, বিলাস সামগ্রীসহ সর্বপ্রকার ভাজা ও প্রক্রিয়াজাত খাবারের উপর উচ্চহারে ভ্যাট বসাতে পারেন কিনা বিবেচনা করে দেখতে পারেন। এতে করে যেমন অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় হবে, তেমনি উচ্চ দামের কারণে ভাজা খাবার জনগণ কম খাবে, কম রোগে আক্রান্ত হবে ও কর্মক্ষম থাকবে। আর সরকারকেও চিকিৎসা বাবদ রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে জনগণের জন্য কম অর্থ খরচ করতে হবে। এটা হবে দেশ, সরকার ও জনগণ সবার জন্যই উইন-উইন অবস্থা।