খােলা বাজার২৪।। বুধবার, ২১ জুন, ২০১৭: কৃষি প্রধান জেলা নওগাঁ। কৃষি প্রধান হওয়ায় ধান উৎপাদনকে কেন্দ্র করে জেলায় প্রায় ১ হাজার ৮৮টি চালকল গড়ে উঠেছে। এছাড়াও দেশের সবচেয়ে বড় চালের মোকাম এটি।
আর এই চালকলগুলো থেকে প্রতি বছর উৎপাদিত ১৬ লাখ মেট্রিকটনের মধ্যে সারা দেশে ১২ লাখ মেট্রিকটন চাল সরবরাহ হয়ে থাকে। খাদ্য উদ্বৃত্ত জেলা হয়েও দফায় দফায় বাজারে চালের দাম বেড়েই চলছে। খোলা বাজারে চালের দাম বেশি হওয়ায় সরকারের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়নি ৭০ ভাগ চালকল মালিক।
এ ছাড়া চুক্তিবদ্ধ চালকল মালিকরা যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে চাল সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয় তাদের জামানত বাজেয়াপ্তের পাশাপাশি পরবর্তী দুই মৌসুম এবং যারা চুক্তি করেনি তাদের কাছ থেকে চার মৌসুম সরকার খাদ্য কিনবে না। এমন সিদ্ধান্তের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা মো. আব্দুস সালাম। অপরদিকে চালের দাম বৃদ্ধিকে বড় বড় ব্যবসায়ী মহল ও সিন্ডিকেটকে দায়ী করেছেন সুধীমহল।
খাদ্য বিভাগ এবার নওগাঁয় ৩৪ টাকা কেজি দরে ৪২ হাজার মেট্রিকটন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। ১ মে থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সংগ্রহ অভিযান চলবে। তাই ২০ মে’র মধ্যে ১ হাজার ৮৮ জন চালকল মালিককে চুক্তিবদ্ধ হতে আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে সংগ্রহের শুরুতেই খোলাবাজারে চালের দাম বেড়ে যায়। বাজার মূল্য বেশি হওয়ায় এবং প্রতি কেজিতে আড়াই থেকে ৩ টাকা লোকসান গুনতে হওয়ায় মিলাররা চুক্তি থেকে বিরত থাকেন। খাদ্য বিভাগ চুক্তিবদ্ধ হওয়ার জন্য সময় ৩১ মে পর্যন্ত বৃদ্ধি করে। দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ১হাজার ৮৮ জন চালকল মালিক চুক্তিবদ্ধ হলেও চাল দিচ্ছেন ৪০৫ জন। বাকী ৬৮৩ জনের বিরুদ্ধে খাদ্য বিভাগ ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
সরকার ৩৪ টাকা কেজি দরে চাল কিনছেন। কিন্তু খোলাবাজারে চালের দাম আরো বেশি। ধান কিনে চাল উৎপাদন করতে খরচ বেশি হচ্ছে। আর কম পুঁজির মিলারের পক্ষে এ লোকসান দিয়ে খাদ্য গুদামে চাল দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তাই মিলাররা চুক্তিবদ্ধ হননি। এছাড়া যারা চুক্তিবদ্ধ হয়ে লোকসান দিয়ে খাদ্য গুদামে চাল দিচ্ছেন তাদের লোকসান থেকে বাঁচাতে ইনসেনটি বোনাস দেয়া হলে ক্ষতি কিছুটা পুশিয়ে নেয়া সম্ভব হবে।
জেলায় বোরো মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৯৮ হাজার ৩৫০ হেক্টর। প্রাকৃতিক দূর্যোগ, ঝড়ো হাওয়া ও ফসলে নেকব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে অর্জিত হয়েছে ১ লাখ ৮৬ হাজার ৭৫০ হেক্টর। ফলে ফসলের বড় একটা অংশ ক্ষতি হয়। যার পরিমাণ প্রায় ৩৫০ হেক্টর। গত বছর বিঘা প্রতি ২২/২৪ মন ধান উৎপাদন হলেও এ বছর বিঘা প্রতি উৎপাদন হয়েছে প্রায় ২০ মণ। হেক্টর প্রতি ৪ দশমিক ১৭ মেট্রিকটন উৎপাদন হয়েছে। খাদ্য উদ্বৃত্ত জেলা হলেও হঠাৎ করে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় জাতীয় একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। আবার প্রতিযোগিতা করে ধান কেনায় চালের উৎপাদন খরচও বৃদ্ধি পেয়েছে।
আর এ সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে কৃষকের হাতে ধান না থাকা। বর্তমানে বড় বড় ব্যবসায়ী ও জোতদারের হাতে ধান জমা আছে। এছাড়া হাওর অঞ্চলে প্রাকৃতিক দূর্যোগকে ইস্যু হিসেবে নিয়ে কাজ করছেন ব্যবসায়ীক মহল বা একটি সিন্ডিকেট মহল। প্রতিযোগীতা করে বেশি দামে ধান কিনে চাল উৎপাদন করায় খরচ বেশি হওয়ায় চালের দাম বেশি বলে জানিয়েছেন চালকল মালিকরা।
অপরদিকে, খাদ্য গুদামে চাল না ঢুকায় শুয়ে বসে অলস সময় পার করছেন জেলা খাদ্য গুদাম সহ ১১টি উপজেলা ছয় শতাধিক শ্রমিক। কাজ না থাকায় সামনে ঈদকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তারা।
জেলার মহাদেবপুর উপজেলার চকগৌরি এলাকার মেসার্স সোনালি ও আল মদিনা চালকলের প্রোপাইটর আলহাজ্ব আব্দুল রহমান বুলু বলেন, খাদ্য বিভাগের মাধ্যমে সরকারকে এবার ২০০টন চাল দিচ্ছেন। প্রতিকেজিতে আড়াই টাকা লোকসান দিয়ে ইতোমধ্যে ১০০ টন চাল দিয়েছেন। কষ্ট করে হলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাকী চাল পরিশোধ করবেন। এতে তার প্রায় ৪/৫ লাখ টাকা লোকসান হবে। সরকার যদি ইনসেনটিপ বোনাস দেয় তাহলে কিছুটা ক্ষতি পুশিয়ে নেয়া সম্ভব।
মেসার্স ফারিহা রাইচ মিলের প্রোপাইটর শেখ ফরিদ বলেন, এবার খাদ্য বিভাগে ১৪ দশমিক ৩৭৫ মেট্রিকটন চাল চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। বর্তমান বাজার অনুসারে খাদ্য গুদামে চাল দিতে গেলে প্রায় ৮০/৮৫ হাজার টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে। গত বছর যাদের লোকসান হয়েছে তারা অনেকেই এখনো ক্ষতি পুশিয়ে উঠতে পারেনি। যার কারণে অনেকেই চুক্তিবদ্ধ হয়নি। গত বছর লোকসান দিয়ে চাল দিতে হয়েছে। এ বছরও মিলের লাইসেন্স ধরে রাখতে সরকারকে লোকসান দিয়েই চাল দিতে হচ্ছে।
আজিজ চাউল কলের মালিক মিলন হোসেন বলেন, তার হাসকিং মিলে গত বছর ৪৪ টনে ১লাখ ২০ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে। এ বছর ১৭ মেট্রিকটন বরাদ্দ হয়। বাজারে ধানের দাম দিন দিন বেড়েই চলেছে। যদি এবারও গুদামে চাল দিয় তাহলে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার টাকার মতো লোকসান হবে। আর খোলা বাজারে চাল বিক্রি করি তাহলে কিছুটা হলেও পুশিয়ে নেয়া যাবে।
নওগাঁ জেলা খাদ্য গুদাম শ্রমিক ইউনিয়ন সাধারন সম্পাদক মিঠু মন্ডল বলেন, এখানে ১০০ জন শ্রমিক কাজ করে। এ মওসুমে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত তিন হাজার টাকার কাজ হয়নি। পরিবার পরিজন নিয়ে সামনে ঈদ করাও কষ্ট হয়ে উঠবে।
শ্রমিক বেলাল হোসেন বলেন, গত বছর কাজের খুব চাপ ছিল। দিনে ৩০০-৪০০ টাকা আয় হতো। এ মওসুমে দিনে ৪০-৫০ টাকা আয় হয়। আবার কোনদিন খালি হাতেও বাড়িতে ফিরে যেতে হয়। বেশির ভাগ সময় শুয়ে বসেই কাটে।
নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপ-পরিচালক মনোজিত কুমার মল্লিক, প্রাকৃতিক দূর্যোগ, ঝড়ো হাওয়া ও নেকব্লাস্ট রোগের কারণে ফসলে একটা বড় অংশ ক্ষতি হয়। যার ফলে লক্ষমাত্রা অর্জিত হয়নি। খাদ্য উদ্বৃত্ত জেলা হয়েও হঠাৎ করে চালের দাম বৃদ্ধি পাওয়া একটি সিন্ডিকেট মহলেরও হাত আছে বলে মনে করছেন। আর এ সিন্ডিকেটের কারণে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে চলেছে। সরকার যদি দ্রুত এলসির মাধ্যমে চাল আমদানি করতে পারে তাহলে ধীরে ধীরে চালের বাজার স্বাভাবিক হবে।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা মো. আব্দুস সালাম বলেন, এবার ৪২ হাজার মেট্রিকটন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হলেও চুক্তিবদ্ধ হয় প্রায় আট হাজার মেট্রিকটন। সোমবার পর্যন্ত প্রায় চার হাজার মেট্রিকটন চাল সংগ্রহ হয়েছে। নির্ধারীত সময়ের (জুন) মধ্যে বাকী চাল সংগ্রহ হবে বলে আশা করছেন। আর বাজার মূল্য স্থিতিশীল থাকলে চুক্তিবদ্ধ চালকল মালিকদের মাধ্যমে পূর্ণবরাদ্দ দিয়ে বাঁকীটা সম্পন্ন করা হবে। তিনি আরো বলেন, চুক্তিবদ্ধ চালকল মালিকরা যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে চাল সরবরাহ করতে ব্যর্থ হলে তাদের জামানত বাজেয়াপ্তের পাশাপাশি পরবর্তী দুই মৌসুম এবং যারা চুক্তিবদ্ধ হয়নি তাদের ক্ষেত্রে আগামী দুই বছর বা চার মৌসুম সরকার তাদের কাছ থেকে কোন খাদ্য কিনবে না। এছাড়া পরবর্তীতে সরকার থেকে কোন নির্দেশনা আসলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।