খােলা বাজার২৪।। শুক্রবার, ২৩ জুন, ২০১৭: বাঙালি সমাজে একটা কথা প্রচলিত, নারী কুড়িতে বুড়ি! আর বয়স ৩০ পার হলে তো কথার শেষ নেই। কেউ বলে মেয়ের বিয়ে হবে না। আবার কেউ বলে বিয়ে হলেও মা হতে পারবে না। চিন্তার ভাজ পড়ে মা-বাবার কপালে। এমন সংকট কাটাতে পরদিনই মেয়ে অহনার (ছদ্মনাম) বিয়ে দেন। তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মী অহনার আমেরিকা যাওয়ার প্রস্তুতি প্রায় চূড়ান্ত। কয়েক বছর সেখানে থাকলে ক্যারিয়ারেরও একলাফে উন্নতি ঘটবে। এমন পরিস্থিতেই সংকট সমাধানের সন্ধান পেয়েছেন অহনা। না, বিয়ে নয়, ডিম্বাণু সংরক্ষণ ডাক্তারি পরিভাষায় সোশ্যাল এগ ফ্রিজিং।
অহনাই শুধু নন, এর জ্বলন্ত উদাহরণ বিউটি কুইন ডায়না হেডেনও। ২০১৬ সালে ৪২ বছর বয়সে মা হন ডায়না। তবে তিনি ডিম্বাণু সংরক্ষণ করেছিলেন আট বছর আগে তখন তার বয়স ৩৪। কম বয়সে সংরক্ষণ করা সেই ডিম্বাণুর সাহায্যে চল্লিশ পেরিয়েও মা হতে সমস্যা হয়নি ডায়নার।
ডিম্বাণু সংরক্ষণ করে মা হওয়ার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে ভারতের কলকাতার নারীদের মধ্যে। নামকরা আইভিএফ বিশেষজ্ঞ অরিন্দম রথ জানান, গত কয়েক বছরে অন্তত নয়জন অবিবাহিত নারী তার আইভিএফ সেন্টারে এসে ডিম্বাণু সংরক্ষণ করেছেন।
তিনি আরও বলেন, ‘বলতে পারেন ডিম্বাণু সংরক্ষণ নারীদের একটা বিকল্প পছন্দ দিয়েছে। নিজের জীবন নিজের মতো করে বাঁচার পছন্দ। আমার এক বাঙালি ক্লায়েন্ট দেশ -বিদেশে ঘুরে বেড়ান কর্মসূত্রে। বিয়ে কবে করবেন সেটা ঠিক নেই, এ দিকে তিনি মা-ও হতে চান। তাই ডিম্বাণু সংরক্ষণ করে রেখেছেন।’
ডিম্বাণু সংরক্ষণ ব্যাপারটা ঠিক কী রকম, কেনই বা এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে? এমন প্রশ্নে অরিন্দম রথ জানিয়েছেন, একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর নারীদের ডিম্বাণুর সংখ্যা এবং মান দুটোই কমতে থাকে। তাই বেশি বয়সে বিয়ে করলে সন্তান ধারণে সমস্যা হয় অনেকেরই। ডিম্বাণুর সংখ্যা এবং মান ভালো থাকতে থাকতে যদি ডিম্বাণু সংরক্ষণ করা যায় তাহলে একটু বেশি বয়সে বিয়ে করলেও কৃত্রিম উপায়ে সেই ডিম্বাণু নিষেক করে সৃষ্ট ভ্রূণ গর্ভে স্থাপন (আইভিএফ ) করে যে কোনো নারী গর্ভবতী হতে পারেন।
কলকাতার আরেক আইভিএফ বিশেষজ্ঞ রোহিত ঘুটঘুটিয়া বলেন, ‘যে রকম লোকে ব্যাংকে টাকা জমিয়ে রাখে ভবিষ্যতের কথা ভেবে। এটাও অনেকটা তেমনই।’
ডিম্বাণু সংগ্রহের প্রাথমিক খরচ ১ লক্ষ ২০ হাজার থেকে দেড় লক্ষ টাকা। সংরক্ষণের বার্ষিক খরচ ১৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। ঘটনা হলো কয়েক বছর আগে পর্যন্তও নানা রোগে আক্রান্ত (বিশেষত, যাদের চিকিৎসায় কেমোথেরাপি প্রয়োজন) তারা বেছে নিতেন ডিম্বাণু সংরক্ষণের এই ব্যবস্থাকে। কিন্তু বিশ্বায়নের হাত ধরে নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নারীদের কোনো রোগজনিত কারণ না থাকলেও ডিম্বাণু সংরক্ষণের দিকে ঝুঁকছেন।
কলকাতার এগ ব্যাংকগুলোর হিসাব অনুযায়ী , তিরিশ-চল্লিশজন অবিবাহিতা নারী ইতোমধ্যেই বেছে নিয়েছেন এগ ফ্রিজিংকে।
চিকিৎসক অরিন্দম রথ বলেন, ‘ঋতুমতী যেকোনো নারীই পারেন। কিন্তু আমরা বলি ২৭ থেকে ৩৩ বছর বয়সটা এগ ফ্রিজিংয়ের জন্য আদর্শ। এর পর ডিম্বাণুর মান এবং সংখ্যা দুটোই কমে যায়।’
চিকিৎসকরা জানান, সংরক্ষিত ডিম্বাণু থেকে নিষেকের হার সাধারণ আইভিএফের থেকে সামান্য কম হলেও তা ভালোই৷
এই প্রক্রিয়ায় শারীরিক কষ্ট তেমন নয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। চিকিৎসক রোহিত ঘুটঘুটিয়ার জানান, ‘ডিম্বাণু সংগ্রহের আগে কিছু প্রয়োজনীয় মেডিক্যাল টেস্ট এবং ১২দিন ধরে কিছু আবশ্যিক ইঞ্জেকশন নিতে হয় ডিম্বাণু ফ্রিজ করাতে আগ্রহী নারীকে। শারীরিক খুব কষ্ট পোহাতে হয় না।’
চিকিৎসকরা জানান, তথ্যপ্রযুক্তি, বিমান সংস্থা, মার্কেটিংয়ের মতো পেশার পাশাপাশি নারী চিকিৎসকদের মধ্যেও ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে ডিম্বাণু সংরক্ষণের ভাবনা।
দিল্লি, মুম্বাইয়ের থেকে অনেকটা পিছিয়ে থাকলেও ধীর লয়ে স্বাবলম্বী হচ্ছে শহর কলকাতার ডিম্বাণু সংরক্ষণে উৎসাহী কেরিয়ার সচেতন নারীরা, এমনটাই মত কলকাতার আইভিএফ বিশেষজ্ঞদের।