খােলা বাজার২৪।।শনিবার, ২৪ জুন, ২০১৭:আরব মুল্লুকে আল জাজিরা প্রতিষ্ঠা হবার আগে এধরনের প্রতিক্রিয়া ছিল না, কারণ তখন মিডিয়া কঠিনভাবে নিয়ন্ত্রিত হত। কিন্তু কাতারে আল জাজিরার কার্যক্রম শুরু হবার পর শক্তিশালী সাংবাদিকতা শুরু হয় যা প্রচলিত ধারণার বাইরেই ছিল। অন্যান্য আরব মিডিয়ার তুলনায় আল জাজিরা অনেক বেশি গভীর ও বিস্তৃত সাংবাদিকতা করছে ও মতামত তুলে ধরছে।
আরব বিশ্বের নেতারা কেন আল জাজিরাকে ঘৃণা করছেন তা বুঝতে হলে আপনাকে শরীয়া ও জীবন বুঝতে হবে। আল জাজিরায় প্রচারিত ‘কল ইন শো’ নামে একটি অনুষ্ঠানে মিসরের প্রখ্যাত আলেম ইউসুফ আল-কারযাভি সরাসরি ফোনালাপে জীবন জিজ্ঞাসার শরীয়ত ভিত্তিক বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকেন। এ অনুষ্টানটি কয়েক বছরের মধ্যে লাখ লাখ দর্শকের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ধর্মীয় নেতা হিসেবে পরিচিত ইউসুফ আল-কারযাভি মুসলিম ব্রাদার হুডের নেতা হিসেবে বিবেচিত। দর্শক যে কোনো ধরনের প্রশ্ন করতে পারেন এ ধরনের অনুষ্ঠানে। যেমন রোজা রেখে কি ধুমপান করা যাবে? আত্মঘাতী বোমা হামলার সময় কোনো ফিলিস্তিনি নারীর কি হিজাব পড়া বাধ্যতামূলক?
আল জাজিরা প্রতিষ্ঠিত হবার আগে এধরনের অনুষ্ঠান আরব বিশ্বের কোনো মিডিয়ায় অস্বাভাবিক ছিল। কারণ মিডিয়া কঠিনভাবে নিয়ন্ত্রিত হত। কিন্তু আল জাজিরা এ নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেয়ে অনেক খোলামেলা বিষয়ে, জীবনের প্রাত্যাহিক বিষয় ছাড়াও অনেক বিষয়ে তুলে ধরে। যাদের কথা মিডিয়া বলে না, সে সব মানুষের কথাও তুলে ধরে মিডিয়াটি। এর ফলে আল জাজিরা আরব বিশ্বের অনেক স্বৈরশাসকের অপছন্দের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আরব বসন্ত কিংবা মিসরে তাহরীর স্কয়ারের বিপ্লব থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের শাসকদের ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে আল জাজিরা যার ফলে সৌদি আরব, মিসর ও জর্ডানে এ মিডিয়ার প্রচারণা বন্ধ হয়ে যায় ও ইসরায়েলে তা বন্ধ করার দাবি উঠেছে। মিসরে আল জাজিরার সাংবাদিকদের কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছে।
একদিকে আল জাজিরা যেমন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় তেমনি শত্রুদেরও নজর কাড়ে মিডিয়াটি। আরব বিশ্বে স্বৈরশাসক বা রাজতন্ত্রের মত শাসন, বৈষম্য, শোষণ সহ বিশেষ করে সৌদি আরব ও মিসরের শাসকদের কাছে আল জাজিরা অনুষ্ঠানগুলো নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। তারা চাননা তাদের জনগণ এসব বিষয় নিয়ে আল জাজিরা অনুষ্ঠান দেখুক এবং তাদের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হোক। এসব দেশের হোটেলে আল জাজিরা টেলিভিশন প্রচার নিষিদ্ধ। আল জাজিরা হয়ে উঠেছে সেই সব মানুষের মিডিয়া যাদের কথা অন্য মিডিয়া বলে না।
সর্বশেষ কাতারের বিরুদ্ধে সৌদি নেতৃত্বে আরব দেশগুলো যখন সীমান্ত বন্ধ ও বিভিন্ন ধরনের অবরোধ দিয়ে বসেছে সেখানে আল জাজিরা বন্ধ করার দাবিটিও অন্যতম হয়ে দাঁড়িয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে অন্তত ৩৫০ মিলিয়ন বক্তা রয়েছে যারা মিডিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখে। ৫০ ও ৬০’এর দশকে রেডিও স্টেশনগুলো এধরনের শ্রোতা কিংবা বক্তাদের একটি নেটওয়ার্কে আনার চেষ্টা করে। যেমন মিসরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসের যিনি প্যান-আরব ধারণা পোষণ করতেন তিনি শাত-আল আরব রেডিও প্রতিষ্ঠা করেন এবং এ রেডিওটি এতই জনপ্রিয়তা পায় যে সৌদি আরব এ রেডিওর সম্প্রচারে বাধা সৃষ্টি করত।
৯০এর দশকে সৌদি রাজকীয় পরিবার আরব দৈনিকগুলো কিনতে শুরু করে এবং স্যাটেলাইট স্টেশন এমবিসি প্রতিষ্ঠা করে যার লক্ষ্য ছিল দর্শক ও শ্রোতাদের কাছে ব্যাপকভাবে পৌঁছে যাওয়া। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। যা হয় তা হচ্ছে কাতারের আমির আল জাজিরা প্রতিষ্ঠায় অঢেল বিনিয়োগ করেন। বিষয়টি আরব শাসকদের হতচকিত করে তোলে। একটি ভিন্ন দৃষ্টিকোন শুধু সম্প্রচার করছে না আল জাজিরা বরং সেই সঙ্গে ব্যাপক সাড়া জাগানোর সঙ্গে সঙ্গে আরব দেশগুলোর জনগণ এখন মুসলিম হিসেবে নিজেদের ভবিষ্যত ও পিছিয়ে পড়ার কারণ চিহ্নিত করতে শুরু করেছে যা স্বৈরতন্ত্র ও রাজতন্ত্রকে ভাবিয়ে তুলেছে। ফিলিস্তিনিদের ওপর গাজায় বা অন্যখানে যে রক্তাক্ত হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল, দখল করছে আরবভূমি এর ফুটেজ, প্রামাণ্য চিত্র ও বিশ্লেষণধর্মী অনুষ্ঠান আল জাজিরার মত সম্প্রচার করে না আরব মিডিয়াগুলো।
একই সঙ্গে ইসরায়েল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে যে শক্তিশালী মিডিয়া রয়েছে তার মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে সংবাদ বিশ্লেষণের আলোকে পাল্টা অনুষ্ঠান, টকশো ইত্যাদির আয়োজন করছে আল জাজিরা। কারণ এখনো আরব মিডিয়াগুলো নিয়ন্ত্রিত। ২০০৮ সালে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের সময় আল জাজিরার প্রতিবেদকরা যেভাবে সত্রিত সংবাদ পরিবেশন করেছে অন দি স্পট থেকে তার ধারে কাছেও ছিল না আরব মিডিয়াগুলো। একমাত্র আল জাজিরা গাজা থেকে লাইভ কাভারেজ করেছে। আল জাজিরার মত আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনের বক্তব্য প্রচার, ইরানের মতামত, যুক্তরাষ্ট্রে শীর্ষ রাজনৈতিক ও অর্থনীতিবিদদের অভিমত প্রচারের সাহস কিংবা যোগ্যতায় যথেষ্ট ঘাটতি আছে আরব মিডিয়াগুলোর। ডোনাল্ড রামসফিল্ড থেকে শুরু করে মার্কিন সামরিক শীর্ষ কর্তা, হোয়াইট হাউজ ও স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্রদের বক্তব্য তা ইরাক যুদ্ধ বা লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন সহ বিভিন্ন মুসলিম দেশের সর্বশেষ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বিশদ ব্যাখ্যার নিউজ ধারাবাহিকভাবে প্রচার করছে আল জাজিরা। এধরনের খবরের গুণগত মান স্বাভাবিকভাবে আল জাজিরাকে বাজার এনে দিয়েছে। ২০০১ সালে যেমন আল জাজিরা আরব দর্শকদের সর্বাধিক পছন্দের টেলিভিশন ছিল তেমনি ২০০৬ সালে আরব দেশগুলোর ৭৫ ভাগ মানুষের কাছে আর জাজিরাই পহেলা পছন্দের কাতারে ছিল।
এক পর্যায়ে আল জাজিরাকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে ভীতি ছড়ানোর অভিযোগ ওঠে। ২০১২ সালে চীন আল জাজিরা ইংলিশ’এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ফক্স নিউজ ও দি ইন্ডিপেন্ডডেন্ট অভিযোগ করে আল জাজিরা আরবি টেলিভিশন মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থন করে। ওয়াশিংটন ভিত্তিক গালফ এন্ড এনার্জি পলিসি প্রোগ্রামের পরিচালক সিমন হেন্ডারসন মনে করেন আল জাজিরা প্যান আরব মতবাদের ও ইসলামপন্থীদের সমর্থন দিয়ে থাকে। অবশ্য আল জাজিরা তা প্রত্যাখ্যান করে বলছে টেলিভিশনটি বন্ধ বা বাতিলের চেষ্টা এ অঞ্চলের মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা সৃষ্টি করা ছাড়া আর কিছুই না। আল জাজিরা ইংরেজি বিভাগের এডিটর গিলস ট্রেন্ডল ব্রিটিশ মিডিয়া টেলিগ্রাফকে বলেছেন, শীর্ষ পর্যায়ের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে অনেক কিছুই ঘটছে। কিন্তু আল জাজিরার পক্ষ থেকে বলতে পারি আমরা আমাদের কার্যক্রম নিয়ে আস্থা রাখি এবং প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি আমাদের কাজ ও সাংবাদিকতা অব্যাহত রাখব।(ঈষৎ সংক্ষেপিত ও পরিবর্তিত)