Tue. Apr 22nd, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

13kখােলা বাজার২৪।। শনিবার, ১ জুলাই, ২০১৭: মেহেরপুরে আওয়ামী লীগে চলছে কোন্দল। তবে বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতে নিজেদের রক্ষায় এখন ঐক্যবদ্ধ বিএনপি। দল দুটির সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা এবং দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

আর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টির কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রয়েছে মাস কয়েক আগে জেলা কমিটি গঠন করার মধ্যে।

আর জামায়াতে ইসলামী প্রকাশ্যে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূূচি পালন না করলেও গোপনে দলীয় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। তবে এ বিষয়ে তাদের কেউ মুখ খুলতে রাজি হয়নি।

এদিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা গণসংযোগ শুরু করেছেন। বিএনপি কেন্দ্রীয়ভাবে সিদ্ধান্ত জানানোর আগে তাঁদের কেউ নির্বাচনী প্রচারে নেই। তবে দুটি দলই বলছে, যাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হবে তাঁর হয়েই অন্যরা কাজ করবেন।

আওয়ামী লীগে কোন্দল : মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের মধ্যে দুই ধারা। একটির নেতৃত্বে বর্তমান সভাপতি ও সংসদ সদস্য ফরহাদ হোসেন দোদুল। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন জেলার সহসভাপতি আব্দুস সামাদ বাবলু বিশ্বাস, সদর উপজেলার সাধারণ সমাদক বোরহানউদ্দিন চুন্নু, মুজিবনগর উপজেলা সভাপতি জিয়া উদ্দিন বিশ্বাস, সাধারণ সম্পাদক আমাম হোসেন মিলুসহ তাঁদের অনুসারীরা।

অন্য পক্ষের নেতৃত্বে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য জয়নাল আবেদীন। তাঁর সঙ্গে আছেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম রসুল, শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আক্কাস আলী, নবনির্বাচিত মেয়র মাহফুজুর রহমান রিটনসহ তাঁদের নেতাকর্মীরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন দলীয় নেতাকর্মী জানায়, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে বর্তমান এমপি ফরহাদ হোসেন দোদুল মনোনয়ন নিয়ে এসে দলীয় নেতাকর্মীদের সুসংগঠিত করতে না পারার কারণে দলের মধ্যে কোন্দল শুরু হয়েছে। পরে জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে সভাপতি পদ পাওয়ার পরও তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের সুসংগঠিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ২০ জন উপদেষ্টাসহ ৯১ সদস্যের জেলা কমিটিতে ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে নিজের পছন্দমতো লোকজনকে নিয়ে কমিটি গঠন করার পর থেকে কোন্দল আরো প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। বিএনপি ও ছাত্র মৈত্রী থেকে আওয়ামী লীগের জেলা কমিটিতে স্থান পেয়েছেন এমন কয়েকজন নেতাও রয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে থেকেও অনেকে পদ পাননি। পুরনো কমিটির অনেককেই নতুন কমিটিতে বাদ দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের নানা অভিযোগে দলের মধ্যে বিভক্তি দেখা দিয়েছে।

দলীয় নেতাকর্মীরা আরো জানায়, জেলা পরিষদ নির্বাচনে এমপি দলের মনোনীত প্রার্থীর বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ায় বিদ্রোহী প্রার্থী গোলাম রসুল চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। সবশেষ মেহেরপুর পৌরসভা নির্বাচনে কেন্দ্রের বিশেষ নির্দেশনায় দলীয় প্রার্থী মাহফুজুর রহমান রিটনের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিলেও তা ছিল কেবলই লোক দেখানো বলে মন্তব্য করেছেন অনেক নেতাকর্মী। কারণ এর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠান করা হলেও অন্য পক্ষের অনেক নেতাকমীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এমনকি দলের সাবেক সভাপতি জয়নাল আবেদীন ও সাধারণ সম্পাদক মিয়াজান আলীর বিরুদ্ধে বিষোদ্গারমূলক বক্তব্য দেওয়া হয়েছে।

জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক কমিটির শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক আব্দুল মান্নান বর্তমান কমিটিতে স্থান না পাওয়া নিয়ে আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমাদের মতো নেতাদের সান্ত্বনা দিতে হাইব্রিড নেতাদের বাদ দেওয়ার কথা বলা হয়। অথচ ওই হাইব্রিড নেতাদের নিয়ে কমিটি অনুমোদন করা হয়। ’ জেলা কমিটির সভাপতি সাধারণ সম্পাদককে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘ওনারা তো অথর্ব। কিভাবে দলকে একত্র করতে হয় তাঁরা তা জানেনই না। ’

শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আক্কাস আলী বলেন, সত্যিকার অর্থে দলে চরম কোন্দল বিরাজ করছে। ছাত্র মৈত্রীর নেতা শাশ্বত নিপ্পনকে করা হয়েছে উপপ্রচার সম্পাদক। বিএনপি নেতা জহুিরুল ইসলামকে করা হয়েছে শিল্পবিষয়ক সম্পাদক। দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে না থাকা আমিনুল ইসলাম খোকনকে করা হয়েছে দপ্তর সম্পাদক। অথচ আব্দুল মান্নানের মতো নেতাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আগের কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম পল্টু, গাংনী উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শফিকুল আলমের মতো ত্যাগী নেতাদেরও কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

আক্কাস আলী বলেন, এভাবে অনেক ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে জেলা কমিটি চালাচ্ছেন বর্তমান সভাপতি ফরহাদ হোসেন। জেলা পরিষদের নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী বাদ দিয়ে তিনি মুজিবনগর উপজেলা অওয়ামী লীগের সভাপতি জিয়াউদ্দিন বিশ্বাসকে সমর্থন করে দলীয় প্রার্থীকে হারালেন। কেন্দ্রের নির্দেশে পৌর নির্বাচনে সবাই একত্রিত হওয়ার অভিনয় করলেও যতটুক কাজ করার দরকার, তা তিনি করেননি।

আক্কাস আলী আরো বলেন, ‘এভাবে পকেট কমিটি নিয়ে রাজনীতি করলে রাজনীতিতে সফল হওয়া যায় না। বর্তমান সংসদ সদস্য নিজেই নিজের পায়ে কুড়াল মারছেন। ফলে আগামী সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার রাস্তা তিনি নিজেই বন্ধ করে ফেলছেন। ’

তবে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংসদ সদস্য ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘বর্তমানে দলে কোনো বিভক্তি নেই। যাদের দাওয়াত দেওয়া হয়নি তাঁরা তো কমিটিতে নেই। ’ তাঁদের কেন কমিটিতে রাখা হয়নি—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমাকে দলের নমিনেশন দিয়েছিলেন। তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ উপেক্ষা করেছেন, নির্বাচনে দলের জন্য কাজ করেননি এবং দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন, তাই রাখা হয়নি। আর কমিটিতে যাঁদের নিয়ে অন্য দলের প্রসঙ্গ টানা হয়েছে তাঁরা কখনোই অন্য কোনো দলের সদস্য পদেও ছিলেন না। ’

আগামী নির্বাচন নিয়ে ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘আমরা দলের পক্ষে প্রচারণায় নেমেছি। দল যাকে মনোনয়ন দেবে তার হয়েই সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করব। ’

তবে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ খালেকের মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা উপকমিটির সদস্য ও তরুণ নেতা এম এ এস ইমন বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটি বৃহত্ সংগঠন; যেখানে অনেক নেতৃত্বের সমন্বয় ঘটেছে। সেহেতু নেতৃত্বের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকাটা স্বাভাবিক। অনেক ক্ষেত্রে সেটা অন্তঃকলহে রূপ নেয়। তাঁর দাবি, বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগে কোনো গ্রুপিং বা অন্তর্দ্বন্দ্ব নেই। যেটা আছে সেটা হচ্ছে, নেতৃত্বের প্রতি ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। যেটুকু মতভেদ বা মতপার্থক্য আছে, সেটা কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সুষ্ঠু সমাধান করা সম্ভব।

ঐক্যবদ্ধ বিএনপি : ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে জেলা বিএনপির বর্তমান সভাপতি মাসুদ অরুণ এমপি হওয়ার পরে নানা বিষয় নিয়ে বিভেদ দেখা দিলে সহসভাপতি আনছারুল হকের নেতৃত্বে একটি পক্ষ পৃথক কার্যালয় বানায়। এর পর থেকে বিএনপি দুটি ধারায় বিভক্ত হয়। তখন থেকেই দলে বিভক্তি হলেও পর পর দুই বার ক্ষমতার বাইরে থেকে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে হামলা-মামলার শিকার হয় দুই পক্ষই।

সরকারবিরোধী বিভিন্ন আন্দোলন করতে গিয়ে জেলা বিএনপির সভাপতি মাসুদ অরুণ, সাধারণ সম্পাদক আমজাদ হোসেন, সহসভাপতি আনছারুল হক, জাভেদ মাসুদ মিল্টন, পৌর বিএনপির সভাপতিসহ অধিকাংশ নেতাই মামলার আসামি হয়েছেন। কারাবাসও করেছেন।

ফলে নিজেদের বাঁচার তাগিদেই কেন্দ্রের নির্দেশনায় এখন ঐক্যবদ্ধভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে বিএনপি। কমিটির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সব জেলা পর্যায়ের সব নেতাকেই অংশগ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে।

জেলা বিএনপির সভাপতি মাসুদ অরুণ বলেন, তাঁর নেতৃত্বে জেলা কমিটি গঠনের পর থেকে বিএনপির নেতাদের ঐক্যবদ্ধ করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এর আগে জেলা বিএনপির দুটি কার্যালয় ছিল। কেন্দ্রের নির্দেশনায় আমরা এখন একটি কার্যালয়ে একত্রিত হয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছি। এর পরও কিছু নেতার মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। ১৫১ সদস্যর পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়ে গেলে আর কারো কোনো ক্ষোভ থাকবে না। ’

তিনি দাবি করেন, ‘আগামী নির্বাচনে মেহেরপুরের জনগণ এবং বিএনপির নেতাকর্মীরা মাসুদ অরুণকে চায়। আমার বিশ্বাস, দল আমাকে মনোনয়ন দেবে। তার পরও কোনো কারণে যদি দল সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে তবে দলের স্বার্থে আমরা সেই সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব। ’

জেলা বিএনপির সহসভাপতি আনছারুল হক বলেন, ‘সরকারি দলের নিপীড়ন-নির্যাতন মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া উপায় নেই। মেহেরপুর জেলা বিএনপি ঐক্যবদ্ধভাবেই সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হবে। নির্বাচনে আমরা অনেকেই মনোনয়ন নেওয়ার চেষ্টা করব। দল যাকে দেবে আমরা সবাই তার হয়েই কাজ করব। ’কালের কন্ঠ