Wed. Apr 23rd, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

খােলা বাজার২৪।। শনিবার, ৮ জুলাই, ২০১৭:  3সিলেট বিভাগের তিন জেলায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলেও উত্তরাঞ্চলের দুই জেলায় শত শত গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও ধরলা নদীর পানি কোথাও কোথাও বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন নদী তীরের বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে ভাঙনের ব্যাপকতা বাড়ছে। এদিকে সুরমা-কুশিয়ারা পাড়ের লাখো মানুষ এখনো পানিবন্দি হয়ে আছেন। গ্রামে গ্রামে বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। পর্যাপ্ত ত্রাণও পাচ্ছেন না তারা।

কুড়িগ্রাম জেলায় ব্রহ্মপুত্র ও ধরলা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় প্লাবিত হয়ে পড়েছে নদ-নদী তীরবর্তী চর ও দ্বীপ চরের শতাধিক গ্রাম। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে চিলমারী, উলিপুর ও সদর উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের প্রায় লক্ষাধিক মানুষ। গ্রামীণ কাঁচা সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় এসব এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। এসব এলাকার মানুষজন নৌকা ও কলাগাছের ভেলায় যাতায়াত করছে।

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার কাচিচর ও পিপুলবাড়ী, ঝুনকারচর কমিউনিটি ক্লিনিকের চারদিকে পানি উঠায় চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে। তবে রোগীদের নৌকায় করে আনা-নেওয়া করা হচ্ছে।

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শফিকুল ইসলাম জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি ১৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১৬ সেন্টিমিটার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সেতু পয়েন্টে ধরলার পানি ৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে।

গত কয়েক দিন ধরে যমুনা নদীর পানি ব্যাপক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় নদীর পানি ৮ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে শুক্রবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত শহরাবাড়ি ঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। উপজেলার যমুনা পাড়ের ভান্ডারবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বেলাল হোসেন শ্যামল বলেন, পানি বৃদ্ধি পেয়ে যমুনা নদীর কুল উপচে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের অভ্যন্তরে (পূর্ব পাশে) মাধবডাঙ্গা, ভুতবাড়ি, পুকুরিয়া, কৈয়াগাড়ি, বানিয়াজান, শিমুলবাড়ি, রাধানগর, বৈশাখী ও শহড়াবাড়ি গ্রামের বাড়িঘর ডুবে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ২ হাজার পরিবার। অনেক পরিবার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে।

গত কয়েকদিনের বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি ১৪ সে. মি. বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৫ সে.মি উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী চন্দ্র শেখর জানান, জেলার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত করতোয়া, ঘাঘট ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।

এদিকে ফুলছড়ি উপজেলার উত্তর উড়িয়া, কাতলামারী ও নামাপাড়া এলাকায় গত এক সপ্তাহে নদী ভাঙনের শিকার হয়েছে অন্তত ৫০টি পরিবার। পরিবারগুলো বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে। এখন পর্যন্ত তাদেরকে কোন প্রকার ত্রাণ সহায়তা প্রদান করা হয়নি। এছাড়া কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের বালাসীঘাট ও কাইয়ারহাট এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বাড়িঘর জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। অপরদিকে গত ৮ বছরেও গাইবান্ধা অংশে ৭৮ কি.মি. ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সংস্কার না করায় এর ঝুঁকিপূর্ণ অংশগুলো ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন নদী তীরবর্তী ও চরাঞ্চলের লোকজন।

পদ্মা-যমুনায় অব্যাহত পানি বৃদ্ধিতে উপজেলার বিভিন্ন সিকস্তি ও পয়স্তি এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। তীব্র স্রোত ও সৃষ্ট ঢেউয়ের কারণে ব্যস্ততম পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ও আরিচা-কাজিরহাট নৌপথে ফেরি,লঞ্চ ও নৌকা চলাচল মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে।

স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তারা জানান, যমুনার পানি আরিচা পয়েন্টে গতকাল শুক্রবার ৮ দশমিক ৩৩ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানিবৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় উপজেলার নিম্নাঞ্চল দ্রুত প্লাবিত হয়ে কাঁচামরিচ, শাক-সবজিসহ নানা ফসলের ক্ষতি হচ্ছে।

পাহাড়ি ঢলে গত কয়েক দিন ধরে জেলার ৮ উপজেলা জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ,ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর, বিশ্বনাথ ও কোমপানীগঞ্জ, মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা, জুড়ি, কুলাউড়া, রাজনগর ও মৌলভীবজার সদর এবং সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক, জগন্নাথপুর ও দোয়রাবাজার উপজেলা বন্যা কবলিত হয়ে আছে। এই তিন জেলার ১৬ উপজেলার চারদিকে এখনো বন্যার পানি থৈ-থৈ করছে। বন্যা কবলিত ৫ লক্ষাধিক লোক অনাহারে-অর্ধাহারে আছেন। তারা প্রতিক্ষণ অপেক্ষায় কখন পানি নামবে।

তবে সিলেট অঞ্চলের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড শুক্রবার বেলা ৩ টায় জানায়, পানি কমলেও কানাইঘাটে সুরমা বিপদসীমার ৪৯ সে.মি, অমলসিদে কুশিয়ারা ১দশমিক ৪১ সে.মি ও শেওলায় ৬৪ সে.মি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

এবারের বন্যায় মৌলভীবাজার জেলায় বেশি ক্ষতি হয়েছে। ‘সেই মার্চ থেকে শুরু হওয়া বন্যা এখন পর্যন্ত চলছে,’ মন্তব্য করে জেলা প্রশাসক মো.তোফায়েল ইসলাম গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, জেলার ৫ টি উপজেলার ৩ লাখ ১০ হাজার মানুষ বন্যা কবলিত।’ তিনি জানান, এ পর্যন্ত বন্যা দুর্গতদের মধ্যে ৯২৫ টন জিআর চাল, ৩৬ লাখ টাকা নগদ ও ২ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার (৫কেজি চাল ও চিড়া,লবণ) সহ বিভিন্ন ধরণের ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসক জানান, দুটি পৌরসভাসহ জেলার ৩৫টি ইউপি’র ৩৫০ টি গ্রামের মানুষ এখন পানিবন্দি রয়েছে।

এদিকে বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ কমছে না। বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পানিতে ডুবে যাওয়ায় তা বন্ধ রাখা হয়েছে। তাছাড়া বন্যা কবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি আর খাদ্য সংকটের ফলে বাড়ছে হাহাকার। অনাহারে-অর্ধাহারে দিন যাপন করছে দুর্গত পরিবারগুলো। যদিও প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- পর্যাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে তবে তা পরিমাণে কম বলে জানান এলাকাবাসী।

সরেজমিনে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার গয়াসি গ্রামে দেখা গেছে, একটি নৌকা ত্রাণ নিয়ে এলে সেখানে ত্রাণ নিতে ভিড় লেগে যায়। উপজেলার হাকালুকি হাওর পাড়ের গ্রাম বাঘমারা গ্রামের বাসিন্দা রমজান আলী জানান, খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট রয়েছে সেখানে। তাছাড়া সরকারি ভাবে যেসব ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

জেলা বন্যা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জানা যায়, সিলেট জেলার আট উপজেলার ৫৬ টি ইউনিয়নের ৪৬৬ গ্রাম বন্যাকবলিত হয়েছে। এসব এলাকার ১৭ হাজার ৮৫৮ পরিবারের ১ লাখ ৩৮ হাজার ৭৫৫ জন লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাছাড়া ৪ হাজার ৪৯১ টি ঘরবাড়ি বন্যায় ক্ষতি হয়েছে। ৪ হাজার ৩৩০ হেক্টর আউশ ধান ও আমনের বীজতলাসহ ফসলি জমি তলিয়ে গেছে।

সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শহীদুল ইসলাম চৌধুরী জানান, এ পর্যন্ত ২৭৫ মেট্রিক টন ত্রাণ ও ৪ লাখ ৫৫ হাজার নগদ টাকা ও শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।