Fri. Aug 8th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

22kখােলা বাজার২৪।। মঙ্গলবার, ১১ জুলাই, ২০১৭: রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল ছিল। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ বিরোধী দল থেকে আন্দোলন-সংগ্রামের হুমকি ছিল না। বিদেশে শ্রমিক গেছে অন্যবারের তুলনায় বেশি। বিদ্যুতের কিছুটা উন্নতি হয়েছে। এত ইতিবাচক পরিবেশের মধ্যেও সদ্যঃসমাপ্ত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে অর্থনীতির প্রধান চারটি সূচকে অবনতি হয়েছে। অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি প্রবাসী আয়ে ধস নেমেছে। আগের বছরের সঙ্গে তুলনা করলে আয় কমেছে ১৫ শতাংশ। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত এক কোটি প্রবাসী বাংলাদেশি বিগত অর্থবছরে যে পরিমাণ টাকা দেশে পাঠিয়েছে, তা গত পাঁচ অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। রপ্তানি আয়েও গতি ছিল না। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রপ্তানি আয় কম হয়েছে ৬ শতাংশের মতো। গত আট বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে। উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে যে পরিমাণ ঋণ সহযোগিতা পাওয়ার আশা করেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়, তাতেও বড় ধরনের ধস নেমেছে এ অর্থবছরে। অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

দেশের রপ্তানি পোশাক খাতের ওপর নির্ভরশীল। বিকল্প কোনো রপ্তানি খাত তৈরি হয়নি দেশে। পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়ছে না। এ কারণে রপ্তানিতে এগোতে পারছে না বাংলাদেশ। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে দীর্ঘদিন ধরেই এক ধরনের অস্থিরতা চলছে। তেলের দর কমতির দিকে। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশিরা এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে। এ ছাড়া ডলারের বিপরীতে টাকা শক্তিশালী হচ্ছে। এসব কারণে প্রবাসী আয় কমছে। গত বছর জুলাইয়ে রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পে সাময়িক স্থবিরতা দেখা দেয়। সে কারণে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এতে করে উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণ খরচ করতে পারেনি মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। এসব কারণেই এডিপি বাস্তবায়ন ও বিদেশি ঋণ খরচ কম হয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

রপ্তানি আয় কমেছে ৬% : রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ তথ্য বলছে, বিগত অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল তিন হাজার ৭০০ কোটি ডলার। কিন্তু রপ্তানি আয় হয়েছে তিন হাজার ৪৮৩ কোটি ডলার। আয় কম হয়েছে ২১৭ কোটি ডলার। এর মধ্যে পোশাক খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ০.২০ শতাংশ। তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন বলে গত রবিবার ইপিবি থেকে জানানো হয়। তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানিধসের পেছনে ব্যবসায়ীরা বলেছে, ডলারের বিপরীতে টাকা শক্তিশালী হওয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বের হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের কারণে বিগত অর্থবছরে পোশাক খাতে রপ্তানিতে ধস নেমেছে। রপ্তানিতে পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই বলে জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।

এডিপি বাস্তবায়ন সর্বনিম্ন : বিগত অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপি বাস্তবায়িত হয়েছে ৮৯ শতাংশ, যা গত আট বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে সর্বশেষ ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৯০ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়িত হয়েছিল; যদিও রাজধানীর শেরেবাংলানগরে নিজ দপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দাবি করেছেন, সদ্যঃসমাপ্ত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সর্বোচ্চ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়িত হয়েছে। তিনি বলেন, শতাংশের দিক থেকে কিছুটা কম মনে হলেও টাকার অঙ্কের দিক থেকে এটি সবচেয়ে বেশি বাস্তবায়ন। পরিকল্পনামন্ত্রী জানান, গত অর্থবছরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো ব্যয় করেছে মোট এক লাখ ছয় হাজার ৮২০ কোটি টাকা। অথচ এর আগের অর্থবছরে ব্যয় হয়েছিল ৮৭ হাজার ৬৭ কোটি টাকা। সে তুলনায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২৩ শতাংশ বেশি অর্থ ব্যয় হয়েছে। তিনি বলেন, গত বছর এডিপি যা ছিল, সংশোধিত এডিপি তা-ই রাখা হয়েছে। এডিপি সংশোধন করলে এবং বরাদ্দ কমানো হলে দেখা যেত এডিপি ৯৯ শতাংশ বাস্তবায়িত হতো। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘অর্থবছরের প্রথম দিকে ইট পাওয়া যায় না। বর্ষার কারণে কাজ শুরু করা যায় না। গত বছর হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার কারণে পদ্মা সেতুসহ সব মেগা প্রকল্প থেকেই বিদেশিরা চলে গিয়েছিল। বড় বড় প্রকল্পে কাজ পিছিয়ে গিয়েছিল। তবে পরবর্তী সময়ে আমি জাপান সফর করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত অর্থমন্ত্রীর জাপান সফরের মধ্য দিয়ে তাদের সব ধরনের শর্ত মেনে নেওয়া হলে তারা ফিরে আসে। এতে এডিপি বাস্তবায়নে কিছুটা মন্থর হয়। ’ যদিও ড. জাহিদের মতে, দেশের বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বাড়েনি। এক লাখ কোটি টাকা খরচ করতে যে ধরনের প্রশাসনিক সক্ষমতা থাকা দরকার, তা নেই। এ ছাড়া সরকার অনেক সংস্কার কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল; কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। এ কারণে এডিপি বাস্তাবায়নে গতি আসেনি।

প্রবাসীদের আয় ১৫% হ্রাস : বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত অর্থবছরে প্রবাসীরা এক হাজার ২৭৭ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে দেশে, যা বিগত পাঁচ অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছিল এক হাজার ৪৯৩ কোটি ডলার। এতে দেখা গেছে, বিগত অর্থবছরে এর আগের অর্থবছরের তুলনায় রেমিট্যান্স কমেছে ২১৬ কোটি ডলার বা ১৪.৪৭ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রেমিট্যান্স কমার পেছনে কিছু কারণ রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে দীর্ঘ অস্থিরতা ও তেলের দর পড়ায় বাংলাদেশের শ্রমিকদের আয় কমে গেছে। এতে তারা আগের মতো অর্থ পাঠাতে পারছে না। দীর্ঘদিন ধরে টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য কম থাকায় প্রবাসীরা আগের মতো অর্থ পাঠাচ্ছে না। ব্যাংকের তুলনায় খোলাবাজারে ডলারের মূল্য বেশি থাকায় ভিন্ন উপায়ে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে ঢুকছে। মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবস্থা ব্যবহার করে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা অবৈধ উপায়ে দ্রুত প্রবাসীর আত্মীয়স্বজনের কাছে রেমিট্যান্সের টাকা পৌঁছে দিচ্ছে।

বিদেশি ঋণ ৭৭ কোটি ডলার কম : বিগত অর্থবছরে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা থেকে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৭৭ কোটি ডলার কম পেয়েছে বাংলাদেশ। ৪১৭ কোটি ডলার ছাড় হওয়ার কথা ছিল। ছাড় হয়েছে ৩৪০ কোটি ডলার। এর আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থছাড় হয়েছিল ৩৫৬ কোটি ডলার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) হালনাগাদ প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে। কাঙ্ক্ষিত বিদেশি ঋণ না পাওয়ার পেছনে ইআরডির কর্মকর্তারা গত বছর হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার কথা উল্লেখ করেছেন। জঙ্গি হামলার কারণে জাপানিদের অর্থায়নে মাতারবাড়ী, মেট্রো রেল, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে তিনটি সেতুসহ বিদেশিদের অর্থায়নে বিভিন্ন প্রকল্পে স্থবিরতা দেখা দেয়। এ কারণে কাঙ্ক্ষিত অর্থছাড় হয়নি।

এসব বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমাদের রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে। শুধু পোশাক খাতের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না। আমরা উৎপাদন বাড়িয়ে পোশাক খাতকে চালানোর চেষ্টা করছি। ’ এ ছাড়া রেমিট্যান্স কম আসার পেছনে মধ্যপ্রাচ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি প্রবাসীদের অনিশ্চয়তাকে দায়ী করেন তিনি। আর এডিপি বাস্তবায়ন ও বিদেশি ঋণ খরচ করতে না পারার পেছনে বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোকে দুষলেন এই অর্থনীতিবিদ। কালের কণ্ঠ

অন্যরকম