খােলা বাজার২৪।। রবিবার, ১৬ জুলাই, ২০১৭: একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেড় বছরের একটি কর্মপরিকল্পনা বা রোডম্যাপ প্রকাশ করল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আজ বেলা সাড়ে ১১টায় সংবাদ সম্মেলনে ওই রোডম্যাপ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করার কথা। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি পাঁচ সদস্যের নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের পাঁচ মাসের মাথায় এই নির্বাচনী রোডম্যাপ প্রকাশ করা হলো। সবার মতামতের ভিত্তিতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেওয়ার লক্ষ্যে এ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে বলে জানিয়েছে নির্বাচন আয়োজনকারী সাংবিধানিক সংস্থাটি। এ নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করে জন-আকাঙ্ক্ষা পূরণে অন্যতম সাতটি বিষয়ে রাজনৈতিক দলসহ অন্য স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সংলাপ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সে হিসেবে আগামী ৩১ জুলাই সংলাপ শুরু করবে ইসি। আর অক্টোবর পর্যন্ত ধাপে ধাপে সুশীলসমাজ, গণমাধ্যম, পর্যবেক্ষক সংস্থা, সাবেক সিইসি-ইসি, নারী নেত্রী ও রাজনৈতিক দলের মতামত নেওয়া হবে। তবে ইসির সংলাপে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) বিষয়টি আলোচ্য সূচিতে না থাকায় আগামী একাদশ সংসদে ইভিএম ব্যবহার করার সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন ইসির কর্মকর্তারা। ইসি সচিবালয় জানিয়েছে, আজ সকালে নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট সম্মেলনকক্ষে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার প্রধান অতিথি থাকবেন। বিশেষ অতিথি থাকবেন নির্বাচন কমিশনাররা। ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রোডম্যাপে জুলাই থেকে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আইন সংস্কারের পরিকল্পনা রাখা হয়েছে। জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সংলাপ ও নভেম্বরে সংলাপের সুপারিশমালার খসড়া তৈরি এবং ডিসেম্বরে সুপারিশমালা চূড়ান্ত করা হবে। জুলাই-আগস্ট থেকে শুরু করে ডিসেম্বরের মধ্যে সংসদীয় আসনের সীমানার চূড়ান্ত গেজেট প্রকাশ। ২৫ জুলাই থেকে ভোটার হালনাগাদ শুরু করে আগামী ৩১ জানুয়ারি চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা এবং আগামী বছরের জুনের মধ্যে ৩০০ আসনের ভোটার তালিকা মুদ্রণ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে আগামী নির্বাচনের জন্য সম্ভাব্য ভোট কেন্দ্র নির্ধারণের সময়সূচি নির্ধারণ করা হয়েছে ২০১৮ সালের জুনে। জুলাইয়ে খসড়া প্রকাশ, আগস্টে দাবি-আপত্তি নিষ্পত্তির পরিকল্পনা রয়েছে ইসির। আর ভোট গ্রহণের ৩৫ দিন আগে কমিশন তা গেজেট আকারে প্রকাশ করবে। আর আগামী অক্টোবরের মধ্যে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের শর্তাদি পালন করছে কিনা সে বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করবে ইসি। আগামী বছরের জানুয়ারিতে সে অনুযায়ী তাদের নিবন্ধন বহাল রাখার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। এর আগে চলতি বছরের অক্টোবরে নতুন দলের নিবন্ধনের জন্য দরখাস্ত আহ্বান করবে ইসি। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে নতুন দলের নিবন্ধন চূড়ান্ত করা হবে।
ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০১৮ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি একাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে ডিসেম্বরের শেষে অথবা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে নির্বাচন কমিশন। ভোটের জন্য প্রস্তুত থাকতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ইসির মাঠ কর্মকর্তাদের। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি। এ কর্মযজ্ঞ এগিয়ে নিতে চার নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে আলাদা চারটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারির আগের ৯০ দিনের মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেছেন, আগামী সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত কর্মপরিকল্পনা ইসি চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। সবকিছু যাচাই-বাছাই করে তা বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে। রবিবার (আজ) সিইসি তা উন্মোচন করবেন। আনুষ্ঠানিক এ রোডম্যাপ ধরেই কাজ বাস্তবায়ন হবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে। এ কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে সবার কাছে ইসির সব কাজ তুলে ধরা হবে। তাদের মতামত নিয়ে সবার অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা হবে, বলেন তিনি। ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের গেজেট প্রকাশের সময় নির্দিষ্ট করে দেওয়া, রাজধানীর মতো বড় শহরের আসন সীমিত করে নির্দিষ্ট করে দেওয়া, আরপিও-সীমানা নির্ধারণ অধ্যাদেশ বাংলায় রূপান্তরের প্রস্তাবও থাকছে কর্মপরিকল্পনায়। ইসি কর্মকর্তারা জানান, সংলাপে শেষ মুহূর্তে নারী সংগঠনের নেত্রীদের সঙ্গে বসার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ৩১ জুলাই থেকে অক্টোবর নাগাদ এ সংলাপে পর্যায়ক্রমে নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম, রাজনৈতিক দল, নির্বাচন পর্যবেক্ষক, নারী সংগঠনের নেত্রী ও নির্বাচন পরিচালনা বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানানো হবে। দশম সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয় ২০১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি। সে ক্ষেত্রে ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারির আগের ৯০ দিনের মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচনের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কর্মপরিকল্পনায় বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন নির্ধারিত সময়ে সংসদ নির্বাচন করতে দৃঢ়তার সঙ্গে ও সুচিন্তিত পন্থায় এগিয়ে যাচ্ছে। দেশবাসী একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অপেক্ষায় রয়েছেন। সার্বিকভাবে দেশে জাতীয় নির্বাচনের একটি অনুকূল আবহ সৃষ্টি হয়েছে। ইসি কর্মপরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলো নিয়ে স্টেকহোল্ডার, গণমাধ্যম, দলসহ সংশ্লিষ্টদের সামনে উপস্থাপন করে সবার মতামত নেবে। সবার মতামতের আলোকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আইনানুগ ও গ্রহণযোগ্য করে তোলা সম্ভব বলে ইসি বিশ্বাস করে।
কর্মপরিকল্পনায় সাত করণীয় : আইনি কাঠামোসমূহ পর্যালোচনা ও সংস্কার, নির্বাচন প্রক্রিয়া সহজ ও যুগোপযোগী করতে সংশ্লিষ্ট সবার পরামর্শ গ্রহণ, সংসদীয় এলাকার নির্বাচনী সীমানা পুনর্নির্ধারণ, নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও সরবরাহ, বিধি অনুসারে ভোট কেন্দ্র স্থাপন, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন এবং নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিরীক্ষা, সুষ্ঠু নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট সবার সক্ষমতা বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ এবং আইন সংস্কার নিয়ে প্রস্তাব।
আইন সংস্কারে যা থাকছে : নির্বাচন পরিচালনায় বিদ্যমান আইন-বিধি প্রয়োগ করে অতীতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব হয়েছে। এখন আইনি কাঠামোর আমূল সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে ইসি বিবেচনা করে না। তবে পরিবেশ-পরিস্থিতির পরিবর্তনের মুখে এগুলো আরও যুগোপযোগী করার সুযোগ রয়েছে; যাতে ভোট প্রক্রিয়া আরও সহজতর ও অর্থবহ হয়।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ও নির্বাচন পরিচালনা বিধি অনুযায়ী ‘পোস্টাল ব্যালটে’ ভোট দেওয়ার প্রক্রিয়াটি জটিল। বিশেষ করে বিদেশে অবস্থানরতদের সহজ পদ্ধতিতে ভোট দেওয়ার কাঠামো বের করা প্রয়োজন। বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত প্রার্থীর গেজেট প্রকাশ নিয়ে বিধিতে অস্পষ্টতা রয়েছে উল্লেখ করে তা দূর করার প্রস্তাব কমিশনের। সেই সঙ্গে আইনি কাঠামো পর্যালোচনা করে আরও অসঙ্গতি পেলে তা দূর করতে উদ্যোগ থাকবে ইসির। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে এ পর্যন্ত দুই শতাধিক সংশোধনী আনা হয়েছে। এ আইনটিও যুগোপযোগী করতে আরও সংস্কারের প্রয়োজন হবে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ও সীমানা পুনর্নির্ধারণ অধ্যাদেশ বাংলা ভাষায় রূপান্তর করা গেলে ভোটার, প্রার্থী ও নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সবার কাছে সহজবোধ্য হবে বলে মনে করছে ইসি। সীমানা পুনর্বিন্যাসে নতুন প্রশাসনিক এলাকা ও বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোকে নিয়ে নির্বাচনী এলাকা পুনর্নির্ধারণ করতে চায় ইসি। বিদ্যমান অধ্যাদেশে জনসংখ্যার বিবেচনায় আসন বিন্যাস করা হয়। জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় শহর ও গ্রামাঞ্চলের আসনে বৈষম্য সৃষ্টি হবে। বড় শহরের জনসংখ্যা বাড়লেও অনেকে ভোটার হন গ্রামাঞ্চলে। ইসির প্রস্তাব হচ্ছে— আইন সংস্কার করে শুধু জনসংখ্যাকে বিবেচনা না করে জনসংখ্যা, ভোটার সংখ্যা ও আয়তন বিবেচনায় আনা যেতে পারে। রাজধানীর মতো বড় শহরের আসনসংখ্যা সীমিত করে নির্দিষ্ট করা যায় বলে মনে করে সংস্থাটি।
সীমানা পুনর্নির্ধারণে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নীতিমালার আলোকে সংসদীয় আসনের সীমানার খসড়া করে সংশ্লিষ্ট দাবি-আপত্তি নিষ্পত্তি শেষে চূড়ান্ত করা হবে। অবৈধ অর্থ ব্যবহার রোধ ও পেশিশক্তির ব্যবহার দমনে আইনি সংস্কার ও তা প্রয়োগে সংশ্লিষ্ট সবার সুপারিশ পেলে শান্তিপূর্ণ ভোট করতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করে ইসি। নির্বাচন কমিশনারদের নিয়ে গঠিত এ-সংক্রান্ত কমিটি সব পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত করবে। ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও বিতরণ, দলের নিবন্ধন হালনাগাদকরণ, ইসির জনবলের সক্ষমতা বাড়াতে কার্যক্রম নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করার পরিকল্পনাও তুলে ধরা হয়েছে রোডম্যাপে।
সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন