Tue. Jun 17th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

খােলা বাজার২৪।। সোমবার, ১৭ জুলাই, ২০১৭: 6কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পগুলো যেন পরিণত হয়েছে সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আস্তানায়। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে এসব ক্যাম্পে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে অপরাধীরা। একসঙ্গে কয়েকটি গ্রুপ আশ্রয় নেওয়ায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে কয়েক দফা সংঘর্ষে অশান্ত হয়ে উঠেছে ক্যাম্পগুলো। সংশ্লিষ্টরা জানান, মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য থেকে পালিয়ে এসে সেখানকার অপরাধীরা স্থানীয় চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ক্যাম্পে অবস্থান নেওয়ায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

সম্প্রতি এক-দেড় মাসের ব্যবধানে ক্যাম্পগুলোতে অবস্থানকারী সন্ত্রাসী গ্রুপের হাতে অপহৃত উখিয়ার কুতুপালং নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরের তিন রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। অপহৃত ও আহত হয়েছে আরও শতাধিক।

এসব ঘটনার রেশ না কাটতেই দুই সপ্তাহ আগে দিনেদুপুরে প্রকাশ্যে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান আবু ছিদ্দিককে হত্যার লক্ষ্যে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে গুরুতর জখম করে পালিয়ে যায়। এরপরও থেমে নেই সন্ত্রাসীদের তৎপরতা। দিন দিন তা বেড়েই চলছে। অপহরণ ও খুনের ভয়ে কুতুপালং শিবিরের রোহিঙ্গা মাঝিরা (নেতা) অজ্ঞাত স্থানে রাত কাটাচ্ছেন বলেও কয়েকটি সূত্রে জানা যায়।

উখিয়া কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চেয়ারম্যান আবু ছিদ্দিক জানান, দুই সপ্তাহ আগে কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তির খেলার মাঠ সংলগ্ন চা দোকানে সন্ত্রাসীরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করে হত্যার উদ্দেশে তাকে ছুরিকাঘাত করতে থাকে। স্থানীয় রোহিঙ্গারা এগিয়ে এলে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। গুরুতর অবস্থায় তিনি (আবু ছিদ্দিক) এখনও চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।

এর আগে গত ১৩ জুন রাত দেড়টার দিকে ১৮-২০ জনের একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী দল হানা দিয়ে কুতুপালং অনিবন্ধিত ক্যাম্পের ই-১ ব্লক নেতা মো. আয়ুব মাঝি ও কুতুপালং নিবন্ধিত ক্যাম্পের শরণার্থী আলী আহমদের ছেলে মো. সেলিমকে (২৬) তাদের ঘর লুটপাটের পর অপহরণ করে নিয়ে যায়।

গত ১৮ জুন দুপুরে বালুখালী তেলীপাড়া খাল থেকে ভাসমান হাত-পা বাঁধা ও গলা কাটা অবস্থায় মো. সেলিম এবং ২৫ জুন রাত ৮টার দিকে অপহৃত রোহিঙ্গা মো. আয়ুব মাঝির একই অবস্থার লাশ উদ্ধার করে উখিয়া থানা পুলিশ। একইভাবে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা গত ২৩ মে কুতুপালং নিবন্ধিত শরণার্থী ক্যাম্প থেকে মালয়েশিয়া ফেরত মৃত ইমাম হোসেনের ছেলে মো. শফিকে (২৬) রাতের অন্ধকারে রোহিঙ্গা শিবির থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। অপহরণের তিন দিনের মাথায় ২৫ মে সকালে পার্শ্ববর্তী মধুরছড়া জঙ্গল থেকে রোহিঙ্গা মো. শফির লাশ উদ্ধার করে উখিয়া থানা পুলিশ। তবে একের পর এক অপহরণ ও খুনের ঘটনায় পুলিশ এ পর্যন্ত কাউকেই আইনের আওতায় আনতে পারেনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একাধিক রোহিঙ্গা জানান, অপহরণকারী ও খুনিদের মধ্যে কুতুপালং শিবির ও বালুখালী বস্তির রোহিঙ্গা কলিম উল্লাহ, ছলিম উল্লাহ, ইসমাইল, কুতুপালং বস্তির সন্ত্রাসী রোহিঙ্গা মো. জাবের (৩২), মো. নূর (২৮), মনির আহাম্মদ (২৮), খুইল্যা মিয়া মুন্না (৩২), সলিম (২৬), কলিমুল্লাহ (২৮) ও বালুখালীর নতুন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মো. কালু (৩৫) ও মো. ইসলামের (৩৩) নেতৃত্বে ১৮-২০ জনের সশস্ত্র একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সবাই আয়ুব মাঝির ঘরে হানা দিয়ে তাকে অপহরণ করে তুলে নিয়ে যায়। এরা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আল ইয়াকিনের পক্ষ হয়ে এখানে কাজ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। চিহ্নিত হলেও আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকায় তাদের সহজে আটক করা যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করলেন অনেকে।

অপহরণ ও খুনের শিকার আয়ুব মাঝির স্ত্রী নূর আনকিছ জানান, ১৮-২০ জন সন্ত্রাসীর মধ্যে উল্লিখিতদের চিহ্নিত করা গেছে। কুতুপালং নিবন্ধিত শিবিরে খুন হওয়া মো. শফির ভাই মো. হাছানও জানালেন একই কথা। তারা এখন ক্যাম্পে অনাহারে এবং আতঙ্ক নিয়ে জীবনযাপন করছেন। যে কোনও মুহূর্তে অপহৃত হওয়ার ভয়ে আছেন তারা। ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা বলতে কিছু নেই বলে মনে করেন তিনি।

কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবির ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান রোহিঙ্গা নেতা মো. আবু ছিদ্দিক বলেন, ‘একের পর এক অপহরণ ও খুনের ঘটনা ঘটছে। আমরা যারা সরকারের আইনকানুন মেনে এখানে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করি তাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। কারণ অপহরণকারী ও খুনিরা মিয়ানমারের তথাকথিত জিহাদি আলকিনের পক্ষ হয়ে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে কাজ করে যাচ্ছে। এরাই কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে দায়িত্বরত নেতাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দাবি করে ব্যর্থ হয়ে অপহরণ ও খুন করে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। রোহিঙ্গা মাঝিদের অনেকে নিরাপত্তা ও প্রাণের ভয়ে রাতে অজ্ঞাত স্থানে লুকিয়ে রাত কাটাচ্ছে।’

এ প্রসঙ্গে জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে উখিয়া উপজেলার রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী কথা বলতে রাজি হননি। তবে স্থানীয় ইউপি সদস্য বখতিয়ার আহমদের ভাষ্য, ‘কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে দেশি-বিদেশি অনেক অখ্যাত, বিতর্কিত লোক, সংস্থা, এনজিও মানবতার নামে অবাধে রোহিঙ্গাদের মাঝে অজ্ঞাত অর্থ বিলাচ্ছে। এ কারণে সেখানে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর তৎপরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব নিয়ন্ত্রণে আনতে আমাদের পক্ষ থেকে স্থানীয় প্রশাসন ও ইউনিয়ন পরিষদকে দায়িত্ব দেওয়ার জন্য বলা হলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। রোহিঙ্গাদের ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ডে স্থানীয় লোকজন সবসময় ভয় ও আতঙ্কে থাকে।’

মিয়ানমার থেকে নতুন করে পালিয়ে আসা লক্ষাধিক রোহিঙ্গার মধ্যে অনেক সন্ত্রাসী ক্যাম্পে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিতে পারে বলে মনে করেন উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল খায়ের। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ক্যাম্পে সম্প্রতি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ইতোমধ্যে অভিযান চালিয়ে বেশকিছু সন্ত্রাসীকে আটক করা হয়েছে। এ ঘটনার পর থেকে পুলিশের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। অভিযান অব্যাহত রয়েছে এবং বর্তমানে ক্যাম্পে শান্তি ও স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে।’

কক্সবাজারে ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গা জঙ্গিগোষ্ঠী আলকিন মুখোশ পরে হামলা চালাচ্ছে বলে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স একটি সংবাদ প্রকাশ করেছে। তবে এটি ভিত্তিহীন ও অতিরঞ্জিত সংবাদ বলে মন্তব্য করেছেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আফরুজুল হক টুটুল। বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া তার বক্তব্য হলো, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া অপরাধমূলক বিভিন্ন ঘটনার পর থেকে ব্যাপক তল্লাশি ও তদন্ত করে এ সংক্রান্ত কোনও কিছুর আলামত পাওয়া যায়নি। ক্যাম্পে হত্যাকাণ্ডটি মূলত অভ্যন্তরীণ কিছু দ্বন্দ্বের কারণে হয়েছে। ভবিষ্যতে যাতে এসব ক্যাম্পে অপ্রীতিকর কোনও ঘটনা না ঘটে সেজন্য বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।’

তথ্যসূত্র : বাংলাট্রিবিউন