জানা যায়, ভারতীয় একটি প্রতিষ্ঠান প্রথম থেকেই এ ঘটনায় জড়িত বলে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। ওয়ার্ল্ড ইনফরমেটিকস নামের প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী ভারতীয় নাগরিক রাকেশ আস্তানা।
দীর্ঘদিন ধরে এ প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি বিভাগের উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে আসছে। রিজার্ভ চুরির ঘটনার পর রাকেশ আস্তানাকে প্রধান আইটি বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। অথচ এখন তাকে ও তার প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে ঘনীভূত হচ্ছে রহস্য।
সোমবার এই প্রতিবেদক তদন্ত কমিটির প্রধান ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন এবং কমিটির অন্যতম সদস্য বুয়েটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদের সঙ্গে। তারা বিস্তারিত কিছু বলতে অস্বীকার করলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন, কেন এখনও রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করা হচ্ছে না?
তারা বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের উচিত দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা। একই সঙ্গে সুপারিশ বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেয়া।
সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা, আন্তর্জাতিক লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠান সুইফট এবং ভারতীয় একটি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান জড়িত।
দায়িত্বশীল সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ড. ফরাসউদ্দিন কমিটি এবং সিআইডির তদন্ত দল রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গাফিলতি ও তদারকির অভাব ছিল- এমন প্রমাণ পেয়েছে। এ ঘটনায় একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সম্পৃক্ততার প্রমাণ রয়েছে।
সূত্র জানায়, রিজার্ভ চুরির ঘটনায় ৫ কর্মকর্তার গাফিলতি ও দায়িত্বহীনতা ছিল। তাদের অসতর্কতা এবং প্রযুক্তি জ্ঞানের অভাবেই হাতছাড়া হয় রিজার্ভের বিপুল অর্থ। এছাড়া আরও ২ জন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা সরাসরি জড়িত।
তারা জেনেশুনেই রিজার্ভ চুরিতে সহায়তা করেছেন বলে তদন্তে প্রকাশ পেয়েছে। এছাড়া সুইফট ও ভারতীয় সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ইনফরমেটিকস- বিপুল পরিমাণ অর্থ সরানোর ক্ষেত্রে কলকাটি নেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও তদন্ত কমিটির প্রধান ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, রিজার্ভ চুরির ঘটনায় জড়িতদের দুই ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম ভাগে আছে ৫ জন। এরা অদক্ষ, অথর্ব ও কাজে গাফিলতি করেছে। আর দ্বিতীয় ভাগে আছে ২ জন। এদের অপরাধ গুরুতর।
এই দু’জনের বিষয়ে আরো গভীরভাবে তদন্ত করা দরকার। বিশেষ করে ‘ক্রিমিনাল ল’ অনুযায়ী তদন্ত জোরদার করা প্রয়োজন। এছাড়া তদন্ত প্রতিবেদন দ্রুত প্রকাশ করার দাবি জানান তিনি।
ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন কমিটির পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন ৩০ মে অর্থমন্ত্রীর কাছে জমা দেয়া হয়। কিন্তু প্রায় দেড় মাস পার হতে চললেও এখনও তা প্রকাশ করা হয়নি। এ বিষয়ে সে সময় অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ১০-১৫ দিনের মধ্যেই প্রকাশ করা হবে।
সর্বশেষ ঈদের আগে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ঈদের পরই প্রকাশ করা হবে। সে কথাও রাখেননি তিনি। তদন্তকারীরা বলছেন, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ থাকায় প্রতিবেদনটি দ্রুত প্রকাশ করা দরকার।
তদন্তের সর্বশেষ অগ্রগতি জানতে চাইলে বিশেষ পুলিশ সুপার মির্জা আবদুল্লাহেল বাকী বলেন, তদন্ত শেষ পর্যায়ে। প্রতিবেদন খুব দ্রুতই জমা দেয়া হবে। বিষয়টি স্পর্শকাতর। প্রতিবেদন জমা দেয়ার আগে কিছু বলা যাচ্ছে না।
তবে একটি সূত্র জানান, এ নিয়ে ইন্টারপোলের সঙ্গে একটি সভা হওয়ার কথা ছিল চলতি মাসে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তা পিছিয়ে যাওয়ায় সিআইডির তদন্ত এখনও শেষ করা যায়নি। তবে ইন্টারপোলের সঙ্গে বৈঠক শেষে খুব দ্রুতই সিআইডি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে।
এদিকে বিদেশী লোক দিয়ে আইটি বিভাগে কাজ করার তীব্র বিরোধিতা করেছেন ফরাসউদ্দিন নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটির অন্যতম সদস্য বুয়েটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ।
তিনি বলেন, ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে রাকেশ আস্তানাকে নিয়োগ দেয়া হল। তিনি ঘণ্টা হিসেবে ভাড়া করলেন ফায়ার আইকে। প্রায় ৩ কোটি টাকার বেশি ফায়ার আইকে দিতে হয়েছে।
ফায়ার আইয়ের কাজের সফলতা বা অর্জন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। অর্জনশূন্য ফায়ার আই তিন কোটি টাকা নিয়ে ফেরত গেল। তিনি বলেন, দেশের আইটি সেক্টরকে ছোট করে কোনোদিন বিদেশী আইটি গ্রুপ দিয়ে কখনো উন্নয়ন করা সম্ভব নয়।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় সুইফটের দুর্বলতা, আরটিজিএস সংযোগ প্রশ্নবোধক, স্পর্শকাতর এবং সংবেদনশীল জায়গায় অদক্ষ লোকজন বসিয়ে রাখাই প্রধান দায়ী। এসব কারণেই এত বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে।
জানা গেছে, রিজার্ভ চুরির সময় ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ১৫ হাজার ২১০ কোটি টাকা গচ্ছিত ছিল। হ্যাকারদের সব টাকা নেয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বানান ভুলের কারণে তাদের সে মিশন থেমে যায়।
সব টাকা নেয়ার মতো ব্যবস্থা হ্যাকারদের ছিল বলে সিআইডির একটি সূত্র দাবি করেছে। সূত্রটি বলছে, টাকা নেয়ার মতো সব ‘দরজা’ই খোলা ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকে সুইফটের তিনটি দামি সার্ভার ছিল। সার্ভার তিনটির মূল্য প্রায় ৩ কোটি টাকা। এই সার্ভারে টাকা লেনদেন সংক্রান্ত মেসেজ ছাড়া অন্য কোনো কাজ করার সুযোগ নেই। তবুও সেই সার্ভার মেশিনে ফেসবুক চালানো হয়েছে।
এদিকে যে দুর্বলতার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রায় ৮০০ কোটি টাকা চুরি হয়, একই কারণে দেশের অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংকেও চুরি হয়ে থাকতে পারে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, তদন্ত করতে গিয়ে মনে হল এ ধরনের ঘটনা দেশের আরো অনেক ব্যাংকে হয়েছে। কিন্তু তারা ভয়ে মুখ খুলছে না। ক্ষতির পরিমাণ যায় হোক বদনাম আর আতংক সামাল দিতে তারা এসব তথ্য গোপন করছেন। পরে ক্ষতির টাকা অন্যভাবে পুষিয়ে বা সমন্বয় করে নেবে বলে তার ধারণা।
প্রসঙ্গত, ৪ ফেব্রুয়ারি সুইফট মেসেজিং সিস্টেমের মাধ্যমে ৩৫টি ভুয়া বার্তা পাঠিয়ে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশের এক বিলিয়ন ডলার সরিয়ে ফেলার চেষ্টা হয়। এর মধ্যে পাঁচটি মেসেজে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার যায় ফিলিপিন্সের একটি ব্যাংকে। আর আরেক আদেশে শ্রীলঙ্কায় পাঠানো হয় ২০ লাখ ডলার।
শ্রীলঙ্কায় পাঠানো অর্থ ওই অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া শেষ পর্যন্ত আটকানো গেলেও ফিলিপিন্সের ব্যাংকে যাওয়া অর্থ স্থানীয় মুদ্রায় বদলে জুয়ার টেবিল ঘুরে চলে যায় নাগালের বাইরে। যুগান্তর