Tue. Apr 22nd, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

143636tigerখােলা বাজার২৪।।শনিবার, ২৯ জুলাই, ২০১৭: রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাঘ সম্মেলনে বাংলাদেশ, ভারতসহ ১৩টি বাঘসমৃদ্ধ দেশের সরকারপ্রধানদের ঘোষণা ছিল, ২০২২ সাল নাগাদ নিজ নিজ দেশে এ প্রাণীটির সংখ্যা দ্বিগুণ করা হবে। এর পর কেটে গেছে সাত বছর। এ সময়ে ভারতে প্রাণীটির সংখ্যা বাড়লেও বাংলাদেশে চলছে উল্টো চিত্র।

বন বিভাগের সাবেক উপপ্রধান বন সংরক্ষক তপন কুমার দে ১৩টি দেশে বাঘের সংখ্যা নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। তাতে দেখা গেছে, ২০১০ সালে ভারতে বাঘের সংখ্যা ছিল এক হাজার ৭০৬টি; এখন দুই হাজার ২২৬টি।

আর বাংলাদেশে ২০১০ সালে বাঘ ছিল ৪৪০টি, সাত বছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১০৬টিতে।

রাশিয়ায় গত সাত বছরে বাঘের সংখ্যা ৩০৬টি থেকে বেড়ে ৪৪৩ হয়েছে।

এ বাস্তবতায় আজ শনিবার বাঘ দিবস পালিত হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। সুন্দরবন বন বিভাগও আলোচনাসভা, সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি নিয়েছে। বন বিভাগের আয়োজনে প্রথমবারের মতো বাঘ দিবসের অনুষ্ঠান হচ্ছে এবার বাগেরহাটে। প্রতিপাদ্য, ‘বাঘ আমাদের গর্ব, বাঘ রক্ষা করব’।

দুনিয়ার নানা জায়গায় গত শতকেই প্রাণীটির ৯৭ শতাংশ মারা পড়েছে। ফলে এটি বিলুপ্ত হতে যাওয়া প্রাণীর তালিকায় নাম লিখিয়ে ফেলেছে।

সুন্দরবনের বাঘ
একে রয়েল বেঙ্গল টাইগার বলা হলেও এর প্রকৃত নাম বেঙ্গল টাইগার। গবেষণায় তপন কুমার দে দেখিয়েছেন, সাম্প্রতিক সময়ে সুন্দরবনে বাঘের সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্ব কমে গেছে। তাঁর মতে, এর মানে হলো- বাঘের সংখ্যা হয়তো আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। ১০ বছর আগেও বনে প্রতি বছর ২০ থেকে ২৫ জন মানুষ বাঘের আক্রমণে নিহত হতো। এখন সেখানে মারা যাচ্ছে মাত্র এক থেকে দু’জন।

কেন বাংলাদেশে বাঘ কমছে
এমন প্রশ্নে তপন কুমার দে কালের কণ্ঠকে বলেন, বাজেট আর নিবেদিত লোকের অভাব। বাঘের সংখ্যা বাড়াতে যে ধরনের পরিকল্পনা, পাচার রোধে করণীয় ও বাজেট থাকা দরকার ছিল, তা নেই বলে অভিযোগ করেন তিনি।

চোরা শিকারিদের কবলে পড়ে যেসব বাঘ মারা পড়ছে মাঝেমধ্যে সেসবের চামড়া উদ্ধার হচ্ছে। ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত পূর্ব সুন্দরবন (শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জ) এলাকায় ১০টি চামড়া উদ্ধার হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বাঘ হত্যায় তৎপর আছে বড় ছয়টি শিকারি দল। তারা সুযোগ পেলেই প্রাণীটির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিভিন্ন দেশে পাচার করে। পশ্চিম সুন্দরবন (খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জ) বিভাগে শিকারিরা বেশি তৎপর। বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, ১৯৮০ থেকে এ পর্যন্ত শিকারি, বনদস্যুদের হামলা, গ্রামবাসীর পিটুনি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে সুন্দরবনে ৭০টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। আরো একটি কারণে সুন্দরবনে অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে বাঘ। বনে বাস্তুতন্ত্র (ইকোলজি) দ্রুত বদলে যাচ্ছে। সুন্দরবনের মাটি ও পানিতে বিপুল পরিমাণ লবণ জমা হওয়ায় বাঘের খাদ্য-শৃঙ্খল ভেঙে পড়েছে। এ ছাড়া মরে যাচ্ছে ছোট গাছ ও তৃণজাতীয় উদ্ভিদ, যেগুলো প্রধানত হরিণের খাবার। আর খাবারের অভাবে দ্রুত কমছে হরিণ। ফলে বাঘও খাদ্য সংকটে পড়েছে।

প্রধান বন সংরক্ষক সফিউল আলম চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, সুন্দরবনের বাঘ রক্ষায় বন বিভাগ সচেষ্ট আছে। সেখানকার কমিউনিটিকে সচেতন করে তোলা হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও কাজ করছে। তাঁর মতে, দেশে এখন বাঘের সংখ্যা হবে দেড় শতাধিক।

তপন কুমার দে তাঁর প্রতিবেদনে দেখিয়েছেন, ২০১০ সালে নেপালে বাঘের সংখ্যা ছিল ১২১টি, সেটি এখন বেড়ে ১৯৮ হয়েছে। ভুটানে ২০১০ সালে ছিল ৭৫টি, এখন ১০৩টি। সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণে বেশ কয়েকটি সুপারিশও তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। তাতে বলা হয়েছে, সুন্দরবনের আশপাশে সব ধরনের ভারী শিল্প ও কলকারখানা বন্ধ করে দিতে হবে। বনের ভেতর দিয়ে নৌযান চলাচল কমিয়ে দিতে হবে। এ ছাড়া চিহ্নিত শিকারিদের ধরার জন্য গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়াতে হবে।

এ বিষয়ে বন সংরক্ষক জাহিদুল কবির বলেন, সুন্দরবনে কর্মরত বন বিভাগের কর্মকর্তাদের জন্য ঝুঁকি ভাতার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। টহল জোরদারে বাজেট বাড়ানোরও চেষ্টা চলছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান মনে করেন, বাঘ রক্ষায় শিকারি ও পাচার বন্ধ করা জরুরি। স্থানীয় মানুষদের এ বিষয়ে সচেতন করে তুলতে হবে। গত বছর ইন্টারপোলের এক প্রতিবেদনেও দেখা গেছে, সুন্দরবনে বাঘ হত্যা ও পাচারের সঙ্গে স্থানীয় অনেক প্রভাবশালী নেতা জড়িত।

বন বিভাগের তথ্য বলছে, পৃথিবীর মাত্র ১৩টি দেশে এখন বাঘ আছে। দেশগুলো হলো বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, ভুটান, নেপাল ও রাশিয়া।

বন সংরক্ষক জাহিদুল কবির বলেন, বাঘের আটটি প্রজাতির মধ্যে এরই মধ্যে বালিনিজ টাইগার, জাভানিজ টাইগার ও কাস্পিয়ান টাইগার বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে পাঁচটি প্রজাতির বাঘ কোনো রকমে টিকে আছে। এগুলো হলো বেঙ্গল টাইগার, সাইবেরিয়ান টাইগার, সুমাত্রান টাইগার, সাউথ চায়না টাইগার ও ইন্দো-চায়না টাইগার। বন বিভাগের দেওয়া তথ্য মতে, ১৯০০ সালে বাঘের সংখ্যা ছিল এক লাখ এবং বর্তমানে এর সংখ্যা তিন হাজার ৮৯০টি।

ভারতে বেড়াতে যাওয়া বাঘেরা কি ফিরেছে?
বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা কম কেন- এমন প্রশ্নে ২০১৫ সালের বাঘ দিবসে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেছিলেন, বাঘ ভারতে বেড়াতে গেছে। সেই বাঘ ফিরলো কিনা তার জবাব নেই কারোর কাছেই। যদিও মন্ত্রী বললেন, বাঘ বেড়েছে। এর মানে বেড়াতে যাওয়া বাঘ ফিরেছে কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি শুধু বলেন, বেড়েছে। আর প্রাণিবিজ্ঞানীরা বলছেন, সর্বশেষ শুমারির দশ বছর পর আবারও শুমারি হলেই কেবল বলা সম্ভব বাঘ কমলো না বাড়লো।

বাংলাদেশ ও ভারতের প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবন হচ্ছে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল। সুন্দরবনের ৬২ শতাংশ বনাঞ্চল বাংলাদেশের মধ্যে পড়েছে।   এ বনের জল-স্থলে বাঘের জন্য রয়েছে প্রচুর বৈচিত্রপূর্ণ খাদ্য- হরিণ, বানর, কাঠবিড়ালি, গিরগিটি, শুশুক, ভোঁদড়, কুমির ইত্যাদি।

বনবিভাগের কর্মকর্তারা জরিপের তথ্য উল্লেখ করে বলছেন, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের ৬ হাজার বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ৪ হাজার ৮৩২ বর্গকিলোমিটার এলাকায় বাঘ বিচরণ করে। এদের বিচরণের প্রধান ক্ষেত্র বাগেরহাটের কটকা, কচিখালী ও সুপতিসহ খুলনার নীলকমল, পাটকোষ্টা ও গেওয়াখালী এবং সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জ, দোবেকি ও কৈখালী এলাকা।

‘স্ট্যাটাস অব টাইগারস ইন দ্যা সুন্দরবন ল্যান্ডস্কেচ’ শীর্ষক বাঘ জরিপের প্রতিবেদনে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের ৩টি ও ভারত অংশের ৫টি অঞ্চলের মোট ছয় হাজার ৭২৪ বর্গকিলোমিটার এলাকার চিত্র উঠে এসেছে। এই শুমারি অনুযায়ী সুন্দরবনে এখন বাঘের সংখ্যা মাত্র ১৮২টি। এরমধ্যে বাংলাদেশ অংশে ১০৬ ও ভারত অংশে ৭৬টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার রয়েছে।

বাঘের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ প্রায় অসম্ভব
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ফিরোজ জামান বলেন, কয়েক স্তরের জরিপ ছাড়া কেবল একটা দু’টা পদ্ধতি ব্যবহার করে কী সংখ্যক বাঘ রয়েছে- তা নিরূপণ সম্ভব নয়। ফলে একেকবার একেকরকম তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৩ সালের যে জরিপ যার ভিত্তিতে ২০১৫ সালের প্রতিবেদন, সেটির আগে ২০০৪ সালে বন বিভাগ জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সহায়তায় বাঘের পায়ের ছাপ গুনে জরিপ করেছিল। এতে বাঘের সংখ্যা এসেছিল ৪৪০টি। পরবর্তী সময়ে ২০১৫ সালে নতুন জরিপের প্রতিবেদন বলা হয়েছে, আগের ওই জরিপটি যথেষ্ট বিজ্ঞানসম্মত ও আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে করা হয়নি। ফলে আগের ওই বাঘের সংখ্যা সঠিক নয়। যদিও ২০০৬ সালে জুওলজিক্যাল সোসাইটির সহায়তায় আরেকটি বাঘ গণনা হয়, যেখানে বাঘের সংখ্যা ছিল ২০০টি।