খােলা বাজার২৪।। বুধবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৭: বিএনপির আরাধ্য সহায়ক সরকার, দেশবাসীর জন্য যে ভয়ঙ্কর সহায়ক সরকারে পরিণত হবে না, সেই গ্যারান্টি কে দেবে?জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ সেলিম
বিগত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি-জামায়াত জোট দেশব্যাপী সর্বস্তরের গণমানুষের ওপর যে নিষ্ঠুর তা-ব চালিয়ে ছিল, সেই তা-বের ক্ষতিচিহ্ন দেশবাসীর দেহমন থেকে আজও মুছে যায়নি। অদূর ভবিষ্যত মুছে যাবে তেমন সম্ভবনাও খুবই ক্ষীণ।
বিএনপি-জামায়াত জোট কর্তৃক সংঘটিত নির্বাচনকেন্দ্রিক সেই তা-বটি ছিল নিরপরাধী ঝিকে মেরে বৌকে শিক্ষা দেয়ার একটি নিষ্ঠুর প্রয়াস। সংবিধানের দোহাই দিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থেকে সরে যায় দলীয় সরকারের অধীনে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সব প্রস্তুতি গ্রহণ করলে তার প্রতিবাদ এবং ওই নির্বাচন প্রতিহত করতে গিয়ে সে সময় বিএনপি-জামায়াত জোট দেশব্যাপী অনির্দিষ্টকালের জন্য ধ্বংসাত্মক আন্দোলন শুরু করে। লক্ষণীয় বিষয় হলো সেই বর্বোরচিত আন্দোলনটির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিল দল-মত নির্বিশেষে এদেশের সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ। যে ব্যক্তি জীবনে ধানের শীষ ছাড়া অন্য কোনো প্রতীকে ভোট দেয়নি কিংবা দেবেও না, দেখা গেছে সেই ব্যক্তিকেই বিএনপি-জামায়াত জোটের ছুড়ে মারা অগি্ন-বোমায় জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হতে হয়েছে।
এ কথা কোনো ভাবেই অস্বীকার করা যাবে না যে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সে সময় যারা চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন কিংবা যাদের মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে তাদের বেশির ভাগই দলকানা সাধারণ জনগণ। অবশ্য বিএনপির দাবি সত্যি বলে মেনে নিলে বলতে হবে যে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংস আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রায় সবারই বিএনপি-জামায়াত জোটের ভক্ত-সমর্থক। কেননা বিএনপি ইদানীং প্রায়ই বলে আসছে-আওয়ামী লীগের প্রতি জনসমর্থন নাকি শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। এতে করে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, বিএনপি ক্ষমতার মসনদে বসার জন্য ঠিক কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে। বিএনপি আজ গণতন্ত্রের জন্য বিরামহীন কান্না করে চলেছে শয়নে-স্বপনে, দিবা-রাত্রী, দেশ-বিদেশে। গণতন্ত্রের জন্য তাদের এই কান্না যে, শ্রেফ মায়াকান্না তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
গণতন্ত্রের প্রতি বিএনপির যদি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা বোধ থাকত, তাহলে তাদের পক্ষে ক্ষমতায় থাকার সুবাদে তৎকালীন প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে সদলবলে হত্যার উদ্দেশে ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে বিশাল জনসভার কেবমমাত্র যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত মারাত্মক বিধ্বংসী গ্রেনেড চার্জ করা আদৌ সম্ভব হতো কী? সেদিনের সেই জনসভায় নিক্ষিপ্ত গ্রেনেডগুলোর সবকটিই যদি বিস্ফোরিত হতো আজ বাংলাদেশ পাকিস্তানে পরিণত না হলেও আফগানিস্তানে পরিণত যে হতোই এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকে না। এদেশে বৃহত্তম রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগ বাংলার মাটি থেকে চিরবিদায় জানাতে তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোট সুপরিকল্পিতভাবেই শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে বিপুল বিধ্বংসী গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল; কিন্তু বিধির বিধান ছিল অন্যরকম। তিনি সেই ভয়াবহ ষড়যন্ত্র থেকে কোনো রকমে প্রাণে বেঁচে গেলেও, আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেত্রী আইভি রহমানসহ অনেককে প্রাণ দিতে হয়েছিল ওই গ্রেনেড হামলায়। এ ছাড়া ওই আক্রমণে অনেকই আহত হয়ে আজও মরণ যন্ত্রণা ভোগ করে চলেছেন। যে অসহ্য যন্ত্রণা আমৃত্যু তাদেরকে বয়ে বেড়াতে হবে। অথচ হৃদয়বিদারক সেই হত্যাকা-ের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত কিন্তু তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার করেনি। তারা বরং ওই নৃশংস হত্যাকা-কে অন্যখাত প্রবাহিত করার হীনস্বার্থ জজ মিয়া নাটক তৈরি করে দেশবাসীকে বোকা বানিয়ে ধোঁকা দেবার সমস্ত আয়োজন সুসম্পন্ন করেছিল। গণতন্ত্রের জন্য হাহাকার করান। বিএনপির এই হলো গণতন্ত্র প্রীতির অকাট্য নমুনা। তবে কথায় আছে ধর্মের কল নাকি বাতাসে নড়ে। ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ঘটনাকে বিএনপি-জামায়াত জোট শেষ পর্যন্ত জজমিয়ার কাঁধে চাপাতে পারেনি। বরং সঙ্গত কারণেই ২১ আগস্টে সংঘটিত গ্রেনেড হামলার সমস্ত দায়-দায়িত্ব তৎকালীন সরকারপ্রধান হিসেবে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং ওই সরকারের প্রাণ ভোমরা খালেদাপুত্র তারেক রহমানকে বহন করতে হবে সেটিই স্বাভাবিক।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে সমূলে ধ্বংস করার উদ্দেশে সংঘটিত ২১ আগস্টের সেই ঘৃণ্য গ্রেনেড হামলাকারীদের বিচার কবে নাগাদ শেষ হবে, তা জানা না গেলেও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাহেন্দ্রক্ষণ একাদশতম জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেশবাসীর দ্বারপ্রান্তে এসে পড়েছে। এতে করে দেশবাসীর মনে নতুন করে আবার আলো জ্বলে ওঠার পরিবর্তে ভয়ভীতি ও আতঙ্কের কালো মেঘ জমতে শুরু করছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপির অস্তিত্ব বিলীন হবার আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না, যদি ক্ষমতাসীন সরকার বিএনপির উত্থাপিত দাবি মেনে না নেয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলছে সংবিধানের বাইরে গিয়ে তাদের পক্ষে কিছুই করার নেই। অন্যদিকে বিএনপি দাবি করে আসছে_ নির্বাচন পরিচালনার জন্য ক্ষমতাসীন সরকারকে পদত্যাগ করে এমন এক সরকারের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে, যে সরকারের নাম হবে সহায়ক সরকার। অর্থাৎ বিএনপি সহায়ক সরকারের ছত্রছায়া ছাড়া নির্বাচনে অংশ নিতে ভয় পাচ্ছে। বিএনপি গণমানুষের সহায়তাকে পাশ কাটিয়ে সহায়ক সরকারের সহায়তায় রাষ্ট্র ক্ষমতা লাভের দিবা স্বপ্ন দেখছে।
বিএনপির অতীত ইতিহাসের আলোকে আমার ধারণা তারা শুধু সহায়ক সরকারের কল্যাণে আসন্ন নির্বাচনী বৈতরণী পারি দিতে পারবে না। এ মুহূর্তে বিএনপির জন্য দরকার একটি ভয়ঙ্কর সহায়ক সরকার। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট বাঙালি জাতির দুর্ভাগ্যবসত সালসাখ্যাত একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পেয়েছিল। যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারটি ছিল আপাদমস্তক একটি ভয়ঙ্কর তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এই সরকারের অধীনে ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট শুধু যে ভূমিধস বিজয় অর্জন করেছিল তা নয়, বরং বিএনপি-জামায়াত জোট অষ্টম সংসদ নির্বচানের তিন খলিফা/প্রধান কুশীলব এমএ সাঈদ, লতিফুর এবং শাহাবুদ্দীন গংদের মদদেই নির্বাচন-উত্তর রাতে এদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মা-বোনদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানোর মওকা লাভ করেছিল। অষ্টম সংসদ নির্বাচনকালে সালসাখ্যাত এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যাতিত যেহেতু অন্য কোনো সরকারের কোনো অস্তিত্বই ছিল না সেহেতু নির্বাচন-উত্তর রাতের সংঘটিত পাশবিক অত্যাচার তথা নারী ধর্ষণের উপযুক্ত বিচার করার গুরু দায়িত্ব সালসাখ্যাত সরকারের ওপরেই ন্যস্ত ছিল। অবশ্য পরবর্তীতেও এসব নিয়ে কোনো সরকারকেই খুব একটা উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায়নি। আজকাল ক্রসফায়ারের নামে বিনা বিচারে কত আদম সন্তানকেই না প্রাণ হারাতে হচ্ছে। অবশ্য এসব হত্যাকা- নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা ধরনের যুক্তিও উত্থাপিত হচ্ছে। কিন্তু ক্রসফায়ারে প্রাণহানির ঘটনা বন্ধ হয়নি, হবেও না অদূর ভবিষ্যতে। আমাদের ধারণা, ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনের রাতে যারা গণধর্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল সেসব সারমেয়দের ক্রসফায়ারে হত্যা করা হলে দেশবাসী সেই ক্রসফায়ারকে স্বাগত জানাতে মোটেও কার্পণ্য যে দেখাত না তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ক্ষমতাসীন সরকার সেই কাজটি কেন করেনি সেই প্রশ্নটি আজও মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। অবশ্য সময়ই বলে দেবে আওয়ামী লীগ এ ব্যাপারে আদৌ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করবে কি-না। ইদানীং ধর্মীয় জঙ্গিবাদের যে উত্থান পৃথিবীর দেশে দেশে বিস্তারলাভ করেছে তা আমাদের জন্য মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়। দেশে আইএস আছে, আইএস নেই_ সেই বিতর্কে দেশের জল কম ঘোলা হয়নি। আমরা যদি ধরেও নেই দেশে আইএস নেই তাতেই কী আমাদের আত্মপ্রসাদ লাভের কোনো অবকাশ আছে? বর্তমান সরকার এ পর্যন্ত অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে জঙ্গিবাদী হামলাকারীদের মোকাবেলা করে আসছে এবং তা বিশ্বব্যাপী নন্দিত। নারকীয় হত্যাকা- সংঘটিত করার মূল নায়কদের সঙ্গে নির্বাচনকালে সহায়ক সরকার দাবিকারীদের সম্পর্ক সাপে-নেউলে তা ভাববার কোনো অবকাশ আছে কী? পৃথিবীজুড়েই চলছে জঙ্গিবাদের উন্মাদনা। যে উন্মাদনা থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করা নির্বাচিত সরকারের পক্ষেই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সেই জঙ্গিবাদী উন্মাদনা থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করবে নির্বাচনকালে উড়ে এসে জুড়ে বসা একদল অনভিজ্ঞ লোকের সমন্বয়ে গঠিত ‘সহায়ক সরকার’ তা ভাবতেও ভয় হয়। তথাকথিত গণতন্ত্র ভিক্ষা পেতে গিয়ে যদি দেশবাসীকে ২০০১ সালের নির্বাচন-উত্তর পরিস্থিতির শিকার হতে হয় তবে দেশের শান্তিপ্রিয় জনগণ ক্ষমতাসীন সরকারকে নিশ্চয় করজোড়ে মিনতি করে বলবে_ গণতন্ত্র ভিক্ষা চাই না মাগো, গণতন্ত্রের লেবাসধারী অগণতান্ত্রিক কুত্তাদের সামলাও। বিএনপির আরাধ্য সহায়ক সরকার, দেশবাসীর জন্য যে ভয়ঙ্কর সহায়ক সরকারে পরিণত হবে না, সেই গ্যারান্টি কে দেবে?