
একটি তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর সিস্টেম কিংবা সফটওয়্যার সঠিকভাবে নির্মিত হয়েছে কি না তা পরীক্ষা করা একটি সুনির্দিষ্ট বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি। ‘সফটওয়্যার টেস্টিং’ এই কারণে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল পাঠক্রমের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বেশ কয়েক বছর আগে, যখন পাসপোর্ট প্রকল্পের কাজ শুরু হয়, আমাদের বিভাগ থেকে টেন্ডার ডকুমেন্টটি নিরীক্ষণ করিয়ে নেওয়া হয়েছিল। আমাদের বিভাগের বিশেষজ্ঞ শিক্ষকরা তাঁদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে টেন্ডার ডকুমেন্টটিতে কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছিলেন। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এবং পরে আর কোনো কাজে আমাদের কাছ থেকে প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য নেওয়া হয়নি। পুরো সিস্টেমটি বাস্তবায়নের পর ভেন্ডর তা প্রকল্প অফিস কিংবা সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরকে বুঝিয়ে দিয়ে যায়, তখন তা যথাযথভাবে টেস্ট করে নেওয়া হয়েছে কি না আমার জানা নেই।
সম্প্রতি এ বিষয়ের এক উচ্চ পর্যায়ের কমিটিতে কাজ করার সময় পুরনো ডকুমেন্টটি চোখে পড়ে। লক্ষ করলাম যে ডকুমেন্টটিতে অনেক শর্ত ছিল, যা সঠিকভাবে সিস্টেমে প্রতিফলিত হয়নি। পরিকল্পনা ছিল যে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডাটা বেইস ও সিস্টেমের সঙ্গে (যা তখন ও সম্ভবত এখনো তৈরি হয়নি) এবং আমাদের ভোটার আইডি কার্ড বা জাতীয় পরিচয়পত্র-সংশ্লিষ্ট ডাটা বেইস ও সিস্টেমের সঙ্গে পাসপোর্টের সিস্টেমটির যোগাযোগ করার ব্যবস্থা থাকবে এবং এই তিন সিস্টেমের ও প্রয়োজনে আরো ডাটা বেইস কিংবা সিস্টেমের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপিত হবে। পরিষ্কারভাবে শর্তে উল্লেখ করা ছিল যে এ ধরনের ‘ইন্টারফেসিং’ করার মতো ব্যবস্থা সিস্টেমে থাকতে হবে। এখন দেখা যাচ্ছে, এ ধরনের ইন্টারফেসিং তো দূরের কথা, পাসপোর্ট সিস্টেমের যে ডাটা বেইস রয়েছে তা থেকে আলাদাভাবে তথ্য নেওয়া এবং তা বিশ্লেষণ করার কোনো ব্যবস্থাই নেই; বিশাল একটা তথ্যভাণ্ডার (ডাটা বেইস) পাসপোর্ট অধিদপ্তরে তৈরি হয়েছে অথচ তা কিভাবে আমরা পরবর্তী সময়ে কিংবা অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহার করব, তার কোনো প্রস্তুতি কিংবা পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আমি মনে করি আমাদের অবিলম্বে দেশীয় কম্পিউটারবিজ্ঞানীদের ব্যবহার করে কিভাবে এই বিশাল ডাটা বেইসের তথ্য আমরা ওই সিস্টেম ছাড়াই পড়ে নিতে পারি, তার ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
সম্প্রতি বাংলা নিয়ে কিছু ব্যয়বহুল প্রকল্পের কথা আলোচনায় এসেছে। একই সফটওয়্যার সরকারেরই একাধিক অধিদপ্তর বা প্রকল্প থেকে আলাদাভাবে নেওয়া হয়েছে, যা সুস্পষ্টভাবে সমন্বয়হীনতার ইঙ্গিত বহন করে। বাংলা ওসিআর নিয়ে আমরা দুই ধরনের বক্তব্য পেয়েছি। এক জায়গায় বলা হয়েছে, এই সফটওয়্যারটি যখন উদ্বোধন করা হয় তখন নাকি জানানো হয়েছিল যে এই ওসিআরটা ‘৯৬ শতাংশ সঠিকভাবে কাজ করে’, কিন্তু পরে যখন আইসিটি অধিদপ্তর এটি গ্রহণ করে তখন নাকি জানা যায় এটি ‘৮৭ শতাংশ সঠিকভাবে কাজ করে’! প্রশ্ন হলো, বাংলা ওসিআর সফটওয়্যারটি যখন নেওয়া হলো, তখন কি এর ধপপঁত্ধপু গ্রহণকারীর পক্ষ থেকে যথাযথ ডাটাসেট ব্যবহার করে পরীক্ষা করা হয়েছিল? পরীক্ষা করা হয়ে থাকলে পরীক্ষণের সব মেথোডলজি ও ব্যবহারিক সেটআপের ডকুমেন্টেশন কি আছে? আমার মনে হয় তা মোটেই নেই। আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সব প্রচেষ্টার মধ্যে এটি নিশ্চিতভাবেই একটা বড় ফাঁক হয়ে রয়ে গেছে এবং আমরা যদি এই দিকটিতে নজর না দিই, তবে যতই সদিচ্ছা থাকুক না কেন আমরা অল্প একটু এগিয়েই মুখ থুবড়ে পড়ে যাব।
বাংলা ওসিআর বিতর্কের পরপরই আমরা জানতে পারলাম যে ১৫৯.০২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প একনেকে পাস হয়েছে, যার মাধ্যমে বাংলা ভাষার সঙ্গে সম্পর্কিত ১৬টি সফটওয়্যার টুলস এবং সেই সঙ্গে দক্ষ জনবল তৈরির জন্য প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজন করা হবে। আমরা যতটুকু বুঝতে পেরেছি, এই প্রকল্পের আওতায় বাংলা ওসিআরও থাকবে। এসংক্রান্ত প্রকল্পটি নিয়ে একটি সভা আয়োজন করা হলে সেই সভায় অংশ নেওয়ার জন্য আমি আমার একজন বিজ্ঞ সহকর্মী, আমার বিভাগের একজন সম্মানীয় অধ্যাপককে অনুরোধ করি, যিনি বাংলা ভাষা নিয়ে একসময় অনেক কাজ করেছেন। তিনি এই প্রকল্পের ব্যাপারে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেন এবং কিছু দিকনির্দেশনা দিয়ে একটি অফিশিয়াল চিঠি দেন। যেমন সেখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিল এ রকম যে আমাদের জানা মতে সরকারি ও বেসরকারিভাবে একাধিক প্রকল্পে বাংলা নিয়ে কাজ চলছে এবং আগেও হয়েছে। এসব প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা কী তা একটি ব্যয়বহুল নতুন প্রকল্প চিন্তা করার আগে বিবেচনা করা জরুরি। তিনি যখন এই চিঠিটি লেখেন তখনো কিন্তু আমরা উপরোক্ত বাংলা ওসিআরের বিষয়ে কিছু জানতাম না। তাঁর এই চিঠির কিছুদিন পরই আমরা খবর পেলাম যে ১৫৯.০২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প একনেকে পাস হয়ে গেছে এবং তার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা আরো জানলাম যে ৬.৩৪ কোটি টাকা দিয়ে ২০১৪ সালে কেনা একটি সফটওয়্যার আমাদের কোনো কাজেই আসেনি এবং সম্ভবত আর কাজে আসবেও না। এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কি তাহলে শুধু এভাবে টাকাই খরচ করে যাব? আমাদের জনগণের টাকা দিয়ে কি জিনিস কিভাবে তৈরি হচ্ছে তা মনিটর করব না? তৈরি হওয়ার পর তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই গ্রহণ করব? এবং সর্বোপরি গ্রহণযোগ্য না হলে নতুন আরেকটা প্রকল্প দাখিল করব? এই প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরই আমাদের অজানাও নয়।