খােলা বাজার২৪।। শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭: সমাজে পাশবিকতা বেড়েই চলছে। সেই সাথে নিরাপত্তা হারাচ্ছে শিশু। সমাজের উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত অনেক পরিবারেই ঘটছে শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধর্ষণের ঘটনা শতাধিক হারে বাড়ছে। শিশুদের প্রতি বড়দের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সমাজের অস্থিরতা দূর করতে না পারলে আইন করেও নির্মম এই হত্যাকাণ্ড ঠেকানো যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
২০১৪ সালে ১৯৯ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। পরবর্তী বছর ২০১৫ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৫২১ এবং ২০১৬ সালে ৬৮৬ জন। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, সমাজে এই হারে শিশু ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়া খুবই আশঙ্কাজনক। গত ৫ বছরে পাশবিক নির্যাতন ও নির্মম হত্যার শিকার হয়েছে ১৩ হাজার ১২ শিশু। এরমধ্যে হত্যার শিকার হয়েছে ১ হাজার ৫২৬ শিশু। আত্মহত্যা করেছে ৭২৭ এবং ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১ হাজার ৪৭৫ শিশু। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম ১৪টি জাতীয় দৈনিক থেকে প্রকাশিত ঘটনার সমন্বয়ে এই পরিসংখ্যান তৈরি করেছে। ২০১২ থেকে ১৬ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে এসব শিশু নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা ঘটে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশু হত্যার কারণগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাবা-মা বা পরিবারের সদস্যদের সাথে বিরোধ এবং শত্রুতার বলি হচ্ছে নিরীহ শিশুরা। এ ছাড়াও দরিদ্র শ্রমজীবী শিশুদের তুচ্ছ কারণে বা চুরির অপবাদ দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলার মতো ঘটনা অব্যাহতভাবে ঘটছে। আর বড়দের কু-প্রবৃত্তির শিকার হচ্ছে শিশুরা। ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনসহ গৃহকর্মী শিশুরা সহজে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। তবে এসব ঘটনায় সচেতনতার অভাব। ৯০ দিনের মধ্যে বিচার সম্পন্ন না হওয়া; অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া এবং রায় দ্রুতগতিতে কার্যকর না হওয়াকে দায়ী করেন তারা।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম-(বিএসএএফ) এর তথ্য মতে, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত মাত্র ৮ মাসে ৩৯৯ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। এসময় নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ২২২ শিশুকে। এ সময় বিভিন্ন কারণে আত্মহত্যা করে ১২৯ শিশু। অপহরণের শিকার হয় ৯৪ শিশু। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক নির্যাতনে আহত হয় ৮৮ শিশু এবং বাবা-মায়ের হাতে নির্মম হত্যার শিকার হয় ৩৭ শিশু। এর আগের বছর ২০১৬ সালে ১০৬ শিশুকে এবং ২০১৫ সালে ৯০ শিশুকে চুরির অপবাদে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল। ২০১৫ সালে ৪ হাজার ১২৪ শিশু বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ২০১৬ সালে ২৬৫ শিশু হত্যার শিকার হয়। ২০১৫ সালে ২৯২ শিশু, ২০১৪ সালে ৩৬৬ শিশু, ২০১৩ সালে ১৮০ শিশু এবং ২০১২ সালে ২০৯ শিশু হত্যার শিকার হয়।
চলতি বছর জানুয়ারি থেকে অগাস্ট এই সময়কালে ৩৯৯ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। যাদের মধ্যে ৫৮ শিশুকে গণধর্ষণ করা হয়েছে এবং ৩৭ প্রতিবন্ধী শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে।
হত্যা ধর্ষণসহ সকল ধরনের শিশু নির্যাতনের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া এবং রায় দ্রুতগতিতে কার্যকর করার সুপারিশ করেছে শিশু অধিকার ফোরাম। বলা হয়েছে, যে সকল নির্যাতিত দরিদ্র শিশুর পিতা-মাতার মামলা করার বা চালানোর সামর্থ্য নেই তাদের সরকারি সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। বাদী ও সাক্ষীদের নিরাপত্তা বিধান করার পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শারীরিক শাস্তি কেন বন্ধ হচ্ছে না তা ক্ষতিয়ে দেখাতে হবে। জাতীয় বাজেটে শিশুদের জন্য যে বরাদ্দ রাখা আছে তা সঠিকভাবে ব্যয় নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া শিশু আইন ২০১৩ এর প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন নিশ্চিতসহ আইনের বিধিমালা প্রণয়ন করতে হবে।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের পরিচালক ড. আবুল হোসেন ইত্তেফাককে বলেন, ধষর্ণের ঘটনায় সাক্ষী পাওয়া যায় না ফলে প্রমাণ করা কঠিন হয়ে যায়। সরকারের যে কার্যক্রমগুলো আছে তা জনগণ জানে না। সরকার কাজ করছে তবে যদি সচেতনতা আরো বাড়ানো যায় তাহলে শিশু নির্যাতন কমে আসবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ইনিস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মাহবুবা নাসরীন বলেন, শিশু অধিকার রক্ষায় যে আইনগুলো আছে তা প্রয়োগ করা হয় না। এ বিষয়ে ব্যাপকভাবে সচেতনতা দরকার। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা থাকা দরকার। তাছাড়া সমাজের মানুষ শিশু অধিকার সম্পর্কে সচেতন না। যেসব ঘটনা ঘটছে তার তাত্ক্ষণিক বিচারও হয় না। এসব ঘটনা প্রতিরোধে তিনি বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ পারিবারিকভাবে যদি শিশুর অধিকার ও শিশুর সুরক্ষায় আইনগুলো শেখান হতো; তাহলে শিশুর ওপর এ ধরনের নিষ্ঠুর নির্যাতন হতো না এবং তা কমে আসত।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের চেয়ারপারশন এমরানুল হক চৌধুরী শিশুদের উপর নিষ্ঠুর নির্যাতনের ঘটনাগুলোর জন্য সামাজিক অস্থিরতাকে দায়ী করেন। এ ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ, বাবা-মায়ের সচেতনতা, সমাজের সচেতনতা বাড়ানো দরকার।