খােলা বাজার২৪।। বুধবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭: সিলেটের শিশু রাজনের মতো এবার ময়মনসিংহের গৌরীপুরে চোর সন্দেহে সাগর নামের এক কিশোরকে খুঁটিতে বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গত সোমবার ভোরে গৌরীপুর উপজেলার ডৌহাখলা ইউনিয়নের চরশ্রীরামপুর গ্রামে গাউছিয়া মত্স্য প্রজনন কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে।
রাজনের ঘটনার মতো সাগরকে নির্যাতনের চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
হ্যাচারির মালিক আক্কাছ আলী ও তাঁর লোকজন চোর সন্দেহে সাগরকে আটকের পর খুঁটিতে বেঁধে অন্তত দেড় থেকে দুই ঘণ্টা পেটায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে। নির্যাতনের প্রায় ৩০ ঘণ্টা পর গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১১টার দিকে হ্যাচারির পাশে একটি ঝোপ থেকে সাগরের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
সাগর ময়মনসিংহ শহরের নাটকঘর লেন এলাকার রেল বস্তিতে থাকা শিপন মিয়ার ছেলে। সে ভাঙ্গারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল বলে জানিয়েছেন তার বাবা।
সাগরকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় গতকাল দুপুরে গাউছিয়া মত্স্য প্রজনন কেন্দ্র ও হ্যাচারির মালিক আক্কাছ আলী ও তাঁর চার ভাইসহ ছয়জনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। আক্কাছ আলী ছাড়া অন্য আসামিরা হলেন তাঁর ভাই হাসু, সাত্তার, জুয়েল ও সোহেল এবং হ্যাচারির কর্মচারী কাইয়ুম।
তবে লাশ উদ্ধারের পর থেকেই আক্কাছ আলী ও তাঁর সহযোগীরা গা ঢাকা দিয়েছে। অবশ্য নির্যাতনকারীদের হোতা আক্কাছসহ সব আসামিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন গৌরীপুর থানার ওসি দেলোয়ার আহম্মদ।
এদিকে সাগরের লাশের সুরতহাল প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গৌরীপুর থানার এসআই আলাউদ্দিন জানান, নিহতের ডান পা ভেঙে একেবারে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেছে। এ ছাড়া পুরো শরীরেই আঘাতের চিহ্ন রয়েছে
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় লোকজন জানায়, সোমবার ভোরে গাউছিয়া মত্স্য প্রজনন কেন্দ্র ও হ্যাচারিতে চোর সন্দেহে সাগরকে আটক করেন হ্যাচারির মালিক আক্কাছ আলী ও তাঁর লোকজন। এরপর একটি খুঁটির সঙ্গে দাঁড় করিয়ে রশি দিয়ে তাকে বেঁধে ফেলা হয়। এ ছাড়া বিদ্যুতের তার দিয়ে কোমরের কাছে এবং পিছমোড়া করে দুই হাত বাঁধা হয়। এরপর আক্কাছ আলী, তাঁর ভাইয়েরা ও কর্মচারীরা মিলে পালা করে সাগরকে পেটাতে থাকে।
স্থানীয়রা জানায়, ওই সময় উত্সুক গ্রামবাসী ভিড় করে। কেউ কেউ মোবাইল ফোনে ছবি তুললেও সাগরকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। সাগর বাঁচার জন্য করুণ আর্তনাদ করলেও প্রভাবশালী আক্কাছ আলী ও তাঁর ভাইদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস করেনি কেউ। একপর্যায়ে গাছে বাঁধা অবস্থায়ই সাগর নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তখন মারধর থামান আক্কাছ আলী ও তাঁর লোকজন। পরে উত্সুক গ্রামবাসী যে যার কাজে চলে যায়।
সকাল ৮টার পর থেকে সাগরকে আর ঘটনাস্থলে দেখা যায়নি। তবে সাগরকে নির্যাতনের ছবি ফেসবুকে দেয় স্থানীয় কেউ কেউ।
স্থানীয় লোকজন আরো জানায়, পরে আক্কাছ আলী ও তাঁর লোকজনের কাছে সাগরের ব্যাপারে জানতে চাইলে তাঁরা জানান—ছেলেটিকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। চলে গেছে। তবে নির্যাতনে সাগর মারা গেছে বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে।
ওই খবর পেয়ে সোমবার স্থানীয় সাংবাদিকরা ও গৌরপুর থানার পুলিশ আক্কাছ আলীর কাছে জানতে চাইলে তিনি দাবি করেন, সাগর তাঁর হ্যাচারির পানির মোটর চুরি করতেছিল। তাকে হাতেনাতে ধরা হয়। এরপর তাকে কিছু পিটুনি দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরে সাগর কোথায় গেছে তা তিনি জানেন বলে দাবি করেন।
এদিকে সাগরের সন্ধান না পাওয়ায় গৌরীপুর থানা পুলিশ বিষয়টি সম্পর্কে খবর নিতে শুরু করে। গতকাল স্থানীয় ডৌহাখলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শহীদুল হক সরকারকে সঙ্গে নিয়ে পুলিশ এলাকায় তল্লাশি চালায়। একপর্যায়ে সকাল ১১টার দিকে আক্কাছ আলীর হ্যাচারির পাশের ঝোপ থেকেই সাগরের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানায়, সোমবার ভোর ৫টার দিকে ছেলেটিকে আটক করা হয়। এরপর অন্তত দেড়-দুই ঘণ্টা তাকে মারধর করা হয়। হ্যাচারির মালিক আক্কাছ এবং কর্মচারী কাইয়ুমই বেশি মারধর করে বলে স্থানীয়রা জানায়।
ইউপি চেয়ারম্যান শহীদুল হক সরকার বলেন, ছেলেটিকে নির্যাতনের কথা তিনি সোমবার বিকেলে শুনেছেন। ছেলেটিকে মেরে ফেলা হয়েছে এমন কথাও তাঁকে কেউ কেউ বলেছে। তাই তিনি পুলিশ নিয়ে গতকাল হ্যাচারিতে যান এবং হ্যাচারির পাশেই ছেলেটির লাশ পাওয়া যায়।
নিহত সাগরের বাবা শিপন মিয়া জানান, তিনি ময়মনসিংহ শহরে বিভিন্ন জিনিস ফেরি করে বেড়ান। অভাবী মানুষ বলে রেললাইনের পাশের বস্তিতে থাকেন। তাঁর দুই স্ত্রীর এক পক্ষের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। এদের মধ্যে মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেদের মধ্যে সাগর ভাঙ্গারি ব্যবসা করত। সেই তাঁকে সহায়তা করত। আর ছোট ছেলে ফয়সালের বয়স পাঁচ বছর। শিপন মিয়া দাবি করেন, তাঁর ছেলে কখনো চুরি করতে পারে না।
নিহত সাগরদের প্রতিবেশী আব্দুল হেলিম বলেন, সোমবার থেকে সাগরকে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে তাঁরা জানতে পারেন, গৌরীপুরে একটা ছেলে খুন হয়েছে; যে ভাঙ্গারি ব্যবসা করত। তখন তাঁদের সন্দেহ হয়। পরে তিনি সাগরের বাবাকে নিয়ে গৌরীপুরে যান এবং লাশ শনাক্ত করেন।
গতকাল বিকেলে ময়মনসিংহ শহরের রেলস্টেশনসংলগ্ন বস্তিতে গিয়ে দেখা গেছে শোকের ছায়া। বারবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন সাগরের মা। বস্তির অন্য নারীরা তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। সাগরের মা কিছুক্ষণ পর পর সাগরের নাম ধরে চিৎকার করে কাঁদছেন।
এদিকে সাগরের নামে এর আগে চুরির কোনো মামলা ছিল না বলে জানিয়েছেন গৌরীপুর থানার ওসি দেলোয়ার আহম্মদও। ওসি আরো জানান, পুরো ঘটনা তাঁরা তদন্ত করে দেখছেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গৌরীপুর থানার এসআই আলাউদ্দিন জানান, একাধিক ব্যক্তি সাগরকে নির্মমভাবে পিটিয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে। অতি উৎসাহী হয়ে এলাকারও কেউ কেউ এ ঘটনায় যুক্ত থাকতে পারে।
এসআই আলাউদ্দিন জানান, আজ বুধবার ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে নিহতের লাশের ময়নাতদন্ত করা হবে। আর আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশ মাঠে আছে বলে তিনি জানান।
প্রসঙ্গত, সিলেটের কুমারগাঁওয়ে ২০১৫ সালের ৮ জুলাই চোর অপবাদে শিশু সামিউল আলম রাজনকে (১৩) খুঁটিতে বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। নির্যাতনের সেই দৃশ্য মোবাইল ফোনে ধারণ করে নির্যাতনকারীদেরই একজন, যা ওই ভিডিওর কথোপকথনে স্পষ্ট হয়।