Tue. Aug 19th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

4খােলা বাজার২৪।। বুধবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭: মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা নিয়ে কাল বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা হবে। ওই আলোচনায় রোহিঙ্গা সমস্যার সর্বশেষ চিত্র তুলে ধরবেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। ওই বৈঠক থেকে রাখাইনে দ্রুত সহিংসতা বন্ধ করে সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের ওপর চাপ দিতে পরিষদের কাছে জোরালো পদক্ষেপ আশা করছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা মনে করেন, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে বাংলাদেশ। নেপথ্যে বিভিন্ন পর্যায়ের আলোচনার ফলশ্রুতিতে এটা সম্ভব হয়েছে।

নিউইয়র্ক থেকে বাংলাদেশের এক কূটনীতিক এই প্রতিবেদককে বলেন, গতকাল মঙ্গলবার নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। মূলত বৃহস্পতিবারের বৈঠকের প্রস্তুতি হিসেবে বিষয়টি আলোচনায় আসে। আলোচনায় রাখাইনে অবিলম্বে সব ধরনের সহিংসতা বন্ধ করা, সেখানে বাধাহীনভাবে ত্রাণকর্মীদের কাজ করতে দেওয়ার এবং কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা জোর দিয়েছেন। বৃহস্পতিবারের আলোচনায়ও তাঁরা এ বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দেবেন।

জাতিসংঘ জানিয়েছে, গত সোমবার পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে ৪ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। জাতিসংঘের এই তথ্য প্রকাশের পর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম গতকাল এক টুইটে বলেছেন, বাংলাদেশ এখন মিয়ানমারের ৯ লাখ নাগরিককে আশ্রয় দিচ্ছে। তিনি হিসাব দিয়ে বলেন, এবারের ৪ লাখ ৮০ হাজার, গত বছরের ৮৭ হাজার, নিবন্ধিত শরণার্থী শিবিরের ৩৩ হাজার এবং অনিবন্ধিত ৩ লাখ—সব মিলিয়ে সংখ্যাটি এখন ৯ লাখ।

গতকাল সন্ধ্যায় সরকারি সূত্র জানিয়েছে, নিরাপত্তা পরিষদের পাশাপাশি জাতিসংঘের রাজনীতিবিষয়ক ফোরাম থার্ড কমিটিতে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হতে যাচ্ছে। ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সদস্যদেশগুলোর পক্ষে সৌদি আরব রোহিঙ্গা প্রসঙ্গটি আলোচনায় তুলবে। থার্ড কমিটিতে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে জোরালো পদক্ষেপের আশা করছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের কর্মকর্তারা মনে করছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে যতই সোচ্চার হোক না কেন, এখনো থামানো যায়নি মিয়ানমারকে। তাই নিরাপত্তা পরিষদের মতো ফোরামে একটি জোরালো অবস্থান নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ, অবরোধসহ নানা ধরনের জোরালো অবস্থান নেওয়ার সামর্থ্য আছে নিরাপত্তা পরিষদের।

নিউইয়র্কের একটি কূটনৈতিক সূত্র গতকাল সকালে প্রথম আলোকে জানিয়েছে, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাঁচ দফা প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদকে দেওয়া হয়েছে।

নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে চীন ও রাশিয়া ভেটো দিতে পারে। এ নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে একটি সরকারি সূত্র গতকাল সন্ধ্যায় জানিয়েছে, গত এক সপ্তাহে এই দুই দেশের পাশাপাশি ভারতকে পাশে পেতে চেষ্টা করে যাচ্ছে বাংলাদেশ। পরিস্থিতি যেখানে গেছে, তাতে ভারত, চীন ও রাশিয়া বাংলাদেশের পাশে জোরালোভাবে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পাশে থাকার সময় মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টিকেও তাদের বিবেচনায় নিতে হচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ধারণা করা হচ্ছে নিরাপত্তা পরিষদে চীন, রাশিয়া এবার ভেটো না-ও দিতে পারে। বড়জোর হয়তো এখনই মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো প্রস্তাব না নেওয়ার কথা বলতে পারে।

সরকারি সূত্রটি আভাস দিয়েছে, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছে। মিয়ানমারও এ ক্ষেত্রে বসে নেই। মিয়ানমারও তার মতো করে বাংলাদেশের বন্ধুদেশগুলোকে পাশে পাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এরপরও গত কয়েক দিনে চীন ও রাশিয়ার অবস্থানের পরিবর্তনের সুস্পষ্ট আভাস আছে। আর বাংলাদেশ অতীতে ভারতকে যেভাবে পাশে পেয়েছে, এ সমস্যার ক্ষেত্রেও সেভাবে পাশে পাওয়ার আশা করছে।

রোহিঙ্গাদের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে আজ বুধবার দুপুরে ঢাকায় কর্মরত নিরাপত্তা পরিষদের নয় সদস্য দেশের শীর্ষ কূটনীতিকদের ব্রিফ করবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। ব্রিফিংয়ে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জাপান, ইতালি, সুইডেন ও মিসরের কূটনীতিকেরা থাকবেন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা গতকাল জানিয়েছেন, মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলরের দপ্তরের মন্ত্রী কিউ টিন্ট সোয়েকে অক্টোবরের শুরুতে ঢাকায় আসছেন। এদিকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী বাংলাদেশের ট্রলার লক্ষ্য করে গুলি করার প্রতিবাদে গতকাল মিয়ানমারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের তিন অগ্রাধিকার

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে সরকারের অগ্রাধিকারের বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক গতকাল সকালে তাঁর দপ্তরে প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর পাঁচ দফা প্রস্তাব দেওয়ার পর তা বাস্তবায়নে তিনটি বিষয়ে জোর দিচ্ছে বাংলাদেশ। প্রথমত, দীর্ঘদিনের সমস্যাটির স্থায়ী সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সক্রিয়ভাবে যুক্ত করা। দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে চাপ দেওয়া। আর তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে বাংলাদেশে নতুন আসা রোহিঙ্গাদের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করা।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পর রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সমর্থনকে কাজে লাগাতে বাংলাদেশ এরই মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা চালাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে বিষয়টি নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদেশগুলোর সঙ্গে গত কয়েক দিনে বাংলাদেশ নানাভাবে যোগাযোগ করেছে। গতকাল সকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মিয়ানমারের ওপর যে চাপ তৈরি হয়েছে, তা অব্যাহত রাখা জরুরি। কারণ, চাপ না থাকলে এই সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনায় বসবে না মিয়ানমার।

জানা গেছে, গত সপ্তাহে জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে আলোচনা করেন মিয়ানমারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা থং তুন। এ সময় রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে তাঁকে একটি লিখিত প্রস্তাব দেন মাহমুদ আলী। প্রস্তাবে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার একটি রূপরেখার উল্লেখ আছে। তাতে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব যাচাইয়ের প্রক্রিয়া শেষ করে তাদের ফেরত নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে নিবন্ধিত শিবিরে থাকা ৩৩ হাজার মানুষকে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলেছে বাংলাদেশ।

রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য জাপানের পররাষ্ট্রবিষয়ক সংসদীয় উপমন্ত্রী ইয়াও রাই এবং তুরস্কের উপপ্রধানমন্ত্রী সংক্ষিপ্ত সফরে আজ বুধবার বাংলাদেশে এসেছেন।

অবরোধের আহ্বান এইচআরডব্লিউর

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্মূল অভিযান চালিয়ে মিয়ানমার মানবতাবিরোধী অপরাধ করছে বলে অভিযোগ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। দেশটির ওপর বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবরোধসহ অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।

এইচআরডব্লিউর আইন ও নীতিবিষয়ক পরিচালক জেমস রস বলেন, ‘বার্মিজ সেনাবাহিনী উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের নিষ্ঠুরভাবে উৎখাত করছে। গ্রামবাসীর ওপর ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালানো ও বাড়িঘরে আগুন দিয়ে তাদের বের করে দেওয়া—এর সবই মানবতাবিরোধী অপরাধ।’

শ্রীলঙ্কায় রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা

শ্রীলঙ্কায় আশ্রয় নেওয়া একদল রোহিঙ্গার ওপর হামলা চালিয়েছে দেশটির উগ্রপন্থী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জোট বোদু বালা সেনা (বিবিএস)। দেশটির রাজধানী কলম্বোতে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) আশ্রয়কেন্দ্রে বিবিএসের বিক্ষুব্ধ সদস্যরা হামলা চালায়। এ সময় তারা আশ্রয়কেন্দ্রের গেট ভেঙে ভবনে ঢুকে পড়লে সেখানে থাকা ৩১ জন রোহিঙ্গা মুসলিমের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এসে বিক্ষোভকারীদের তাড়িয়ে দেয়।

কলম্বো থেকে বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. রিয়াজ হামিদুল্লাহ প্রথম আলোকে জানান, বিক্ষোভকারীরা চলে যাওয়ার পর কলম্বোতে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা মুসলিমদের গলে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

সু চিকে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ

জাতিসংঘের সাত মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ রাখাইনে সেনাবাহিনীর নিপীড়নের শিকার হওয়া রোহিঙ্গা মুসলিমদের সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ জানিয়েছেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চিকে। গতকাল জেনেভা থেকে এক বিবৃতিতে তাঁরা এই আহ্বান জানান।

সু চিকে রাখাইনের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করতে যেসব মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ অনুরোধ জানিয়েছেন তাঁদের মধ্যে আছেন মিয়ানমারের মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ র‍্যাপোর্টিয়ের ইয়াংঘি লি।

অন্যরকম