Tue. May 6th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

6রবিবার, ১ অক্টোবর ২০১৭: ফিরোজ খান (৬২) রাজধানীর মধ্য বাড্ডা এলাকায় বসবাস করেন। তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী। গত ২৫ মে ফজরের নামাজ শেষে গুলশান লেকের রাস্তায় প্রাতর্ভ্রমণ করতে বের হয়েছিলেন। এ সময় আবদুল হামিদ নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। আলাপচারিতার একপর্যায়ে অবসর সময়ে তাঁর চাকরি করার আগ্রহ আছে কি না জিজ্ঞাসা করেন। ফিরোজ খান জানান, তাঁর সম্মতি আছে। এভাবেই প্রতারকের সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর। আর এরপর সারা জীবনের জমানো সঞ্চয় হারিয়ে এখন নিঃস্ব তিনি।

শনিবার দুপুরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) কার্যালয়ে ফিরোজ খান বলেন, তাঁর চাকরি করার ইচ্ছা আছে শুনেই ফিরোজ খান তাঁকে আলী নেওয়াজ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ লি. নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কথা বলেন। এর চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত সচিব (পিএস) আল-আমিনের ভিজিটিং কার্ড দেন এবং ফোনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে দেন। আল-আমিনের সঙ্গে যোগাযোগ করে তিনি চাকরির জন্য পাসপোর্ট সাইজের তিন কপি ছবি, স্ট্যাম্প সাইজের তিন কপি ছবি ও বায়োডাটা নিয়ে ২৭ মে বনশ্রী এলাকায় তাদের অফিসে যান। আল-আমিন তাঁকে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জি মোস্তফা কামালের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এমডি জানান, কোম্পানির চেয়ারম্যানের কাছে বায়োডাটাটি দেখানো হবে। এ জন্য তাঁকে পরের দিন সকালে আল-আমিনের সঙ্গে যোগাযোগ করে অফিসে আসার জন্য বলেন। পরদিন তাঁকে জানানো হয়, প্রশাসনিক (অ্যাডমিন) পদের জন্য তাঁকে মনোনীত করা হয়েছে এবং তাঁর বেতন সর্বসাকল্যে ৬০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

ভুক্তভোগী ফিরোজ খান বলেন, আলোচনার একপর্যায়ে এমডির রুমে হঠাৎ মিজানুর রহমান নামে একজন প্রবেশ করেন এবং আল আমিনের দূর সম্পর্কের ভাই পরিচয় দেন। তিনি এমডিকে বলেন, আল-আমিনের কাছে ১০ লাখ টাকা পাবেন। কিন্তু আল-আমিন সেই টাকা না দিয়ে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে রাখছেন। কিসের টাকা, এমডি জানতে চান। মিজানুর রহমান জানান, তাঁরা তিনজন এক ভারতীয় ব্যবসায়ীর সঙ্গে তাস খেলেন। এতে তাঁরা ৩০ লাখ টাকা জেতেন। আল-আমিন ও আরেকজন তাঁকে ঠকিয়ে ওই টাকা নিয়ে যান। ওই ভারতীয় বাংলাদেশে কোনো এক প্রতিষ্ঠানের কান্ট্রি ডিরেক্টর (আবাসিক পরিচালক) বলেও জানানো হয়। এমডি বলেন, ‘আপনার টাকা কোম্পানি থেকে পরিশোধ করা হবে।’ এসব কথা বলার সময় ফিরোজ খান চুপচাপ বসে শুনছিলেন।

আল আমিন বলেন, তিনি ভারতীয়র সঙ্গে কার্ড খেলে আগেও ৩০ লাখ টাকা জিতেছিলেন। এমডি তখন খেলাটা সম্পর্কে জানতে চান। আল আমিন পাঁচ মিনিটের মধ্যেই কার্ড সংগ্রহ করে এমডিকে খেলাটি দেখান এবং ভারতীয়কে ডাকতে বলেন এমডি।

ভুক্তভোগী জানান, ভারতীয়কে ফোন দিলে দুই ঘণ্টার পর তিনি চলে আসেন। তাঁর নাম বলেন, রামনাথ ঠাকুর। এসেই হিন্দিতে কথা বলা শুরু করেন। তখন মিজান তা বাংলায় অনুবাদ করেন। ভারতীয় ব্যবসায়ী এমডিকে বলেন, তিনি একজন বড় ব্যবসায়ী। একটি নতুন প্রজেক্ট করার জন্য বাংলাদেশে এসেছেন। তখন এমডি এবং আল আমিন তাঁকে বলেন, ‘স্যার আমরা আপনার সঙ্গে একটা চুক্তি করব। তার আগে আসুন এই কার্ড খেলাটা একবার খেলি।’ এরপর ভারতীয় ব্যবসায়ী কার্ড খেলে ২৫ লাখ টাকা জিতে নেন। তখন ফিরোজ খানকে দেখিয়ে এমডি একটা ব্যাগে ভরা ২৫ লাখ টাকা ভারতীয়কে দেন। সেদিনই বিকেল ৫টায় আবার ভারতীয়কে আসার জন্য অনুরোধ করা হয় এবং ফিরোজ খানকে বাসায় চলে যেতে বলেন। ফিরোজ খান চলে যাওয়ার পর তাঁকে আবার ফোন করে বিকেল ৫টায় অফিসে আসতে বলেন। ফিরোজ খান তাঁদের কথামতো বিকেলে অফিসে এসে ওই ভারতীয়কে বসা অবস্থায় দেখেন। এই সময় তাঁরা আবার তাস খেলা শুরু করেন। এরপর এমডির কথামতো ফিরোজ খান তাস খেলায় দুই কোটি টাকা বাজি ধরেন এবং জিতে যান। কিন্তু রামনাথ ঠাকুর বলেন, দুই কোটি টাকা নিতে হলে তাঁদের দুই কোটি টাকা দেখাতে হবে।

একপর্যায়ে ফিরোজ খান এমডিকে বলেন, তাঁর চাকরির কী হলো? এমডি বলেন, জাপান থেকে তাঁর কাগজপত্র সবকিছু আসা শুরু হয়েছে। খুব দ্রুতই তাঁকে বনানী সদর দপ্তরে অ্যাডমিনের দায়িত্বে নিয়োজিত করা হবে। এরপর অফিসে বসেই সিদ্ধান্ত হয়, ভারতীয়র সঙ্গে ব্যবসা এবং প্রজেক্ট বিষয়ে মিজানুর রহমান ৪০ লাখ, আল আমিন ২০ লাখ, ফিরোজ খান ১০ লাখ টাকা দেবেন। বাকি টাকা এমডি বিনিয়োগ করবেন। আর খেলায় জেতা দুই কোটি টাকা আদায় করার দায়িত্ব নেন এমডি। ফিরোজ খান জমি বিক্রি, পেনশন একং ধার করে সাত লাখ ৭৫ হাজার টাকা তাঁদের হাতে তুলে দেন। তাঁকে বলা হয়, ৫ জুন তাঁকে নিয়োগপত্র ও খেলায় জেতা টাকা দেওয়া হবে। কিন্তু ৫ জুন সকালে অফিসের ঠিকানায় গিয়ে দেখেন সেখানে অফিস নেই। তাঁদের মোবাইল ফোনও বন্ধ। অফিসের একজন কর্মচারী ফোনে ফিরোজ খানকে জানান, বস দুই কোটি টাকা ডলার করতে গিয়ে ধরা পড়েছেন পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) হাতে।

ফিরোজ খান প্রতারিত হয়েছেন বুঝতে পেরে এ ঘটনার বিষয়ে ৫ জুন খিলগাঁও থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।

পিবিআইয়ের বিশেষ পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ জানান, এই প্রতারক চক্রের হাত থেকে বাদ যাননি অবসরপ্রাপ্ত সচিব ও উপসচিবও। তাঁরাও একইভাবে প্রতারিত হয়েছেন।

এ ধরনের ১২টি অভিযোগ জমা পড়েছে পিবিআই ঢাকা মেট্রোর কার্যালয়ে। তাঁরা সবাই সহযোগিতা চান। এ ঘটনার বিষয়ে পিবিআই অপরাধীদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারে আসামিদের মোবাইল ফোন নম্বরের কললিস্ট সংগ্রহ করে তা পর্যালোচনা করে চক্রের সন্ধানসহ অবস্থান চিহ্নিত করে।

পিবিআই ঢাকা মেট্রোর বিশেষ পুলিশ সুপারের নির্দেশনায় পুলিশ পরিদর্শক মো. মনিরুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি দল গতকাল বেলা সাড়ে ৩টায় পল্লবী থানা এলাকার ১১ নম্বর রোডের ৫ নম্বর বাসার দ্বিতীয় তলায় অভিযান পরিচালনা করে এ চক্রের পাঁচজনকে আটক করে।

আজ বেলা ১২টার দিকে আগারগাঁওয়ে পিবিআইয়ের অতিরিক্ত ডিআইজি মাইনুল হোসাইন সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত তুলে ধরেন। তিনি জানান, আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে পিবিআই জানতে পারে, তাদের নাম মো. হারুন অর রশিদ ওরফে রামনাথ ঠাকুর (৫৬), মো. উজ্জ্বল চৌধুরী ওরফে জি মোস্তফা কামাল (৪৭), মো. শামছুল আলম মজুমদার ওরফে মিজানুর রহমান (৪৮), আমিনুল ইসলাম ওরফে আমিন (৩৭) ও মো. মোকসেদুর রহমান আকন ওরফে আল আমিন (৩৮)।

ডিআইজি মাইনুল আরো বলেন, আটক আসামিরা তাঁদের সহযোগীদের মাধ্যমে অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী ও বয়স্ক লোকদের বিদেশি সংস্থা বা প্রকল্পে বেশি টাকা বেতনে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে তাঁদের সাজানো অফিসে নিয়ে যান। সেখানে চক্রটি তাঁদের পরিকল্পিত বিভিন্ন কৌশলের মাধ্যমে লোকজনকে ফাঁদে ফেলেন। কোনো লিখিত নিয়োগপত্র না দিয়েই চাকরিতে নিয়োগ, পদবি ও বেতন নির্ধারণ করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁদের এক সহযোগীকে ভারতীয় বড় একজন ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন। তাঁদের পাতানো তাস খেলার মাধ্যমে বাজি ধরে কথিত ভারতীয়কে হারিয়ে লাখ লাখ টাকা জিতেছেন দেখান। ওই টাকা নিতে গেলে সমপরিমাণ টাকা উপস্থাপনের কথা বলেন এবং কথিত প্রতিষ্ঠানের প্রজেক্টে মূলধন হিসেবে বিনিয়োগের জন্য নির্ধারিত অঙ্কের টাকা ভুক্তভোগীদের আনতে বলেন। টাকা নিয়ে অফিসে গেলে চক্রের সদস্যরা কৌশলে ভুক্তভোগীর কাছ থেকে টাকা রেখে তাঁকে পরে যোগাযোগ করতে বলেন। এরপর সুযোগ বুঝে অফিসের আসবাবপত্র নিয়ে অন্যত্র চলে যান।

পিবিআইয়ের এই কর্মকর্তা জানান, প্রতারক চক্রের কাছ থেকে একটি ব্রিফকেস, সাতটি মোবাইল ফোন, দুই বান্ডিল মার্কিন ডলার, দুই বান্ডিল পুরাতন ১০ টাকার নোট ও আটটি তাসের বান্ডিল উদ্ধার করা হয়। এই চক্রের অন্যদের গ্রেপ্তার করতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তিনি আরো জানান, পাঁচজনের বিরুদ্ধে পুলিশ পরিদর্শক মনিরুল ইসলাম বাদী হয়ে রাজধানীর খিলগাঁও থানায় একটি মামলা করেছেন।