Fri. Apr 11th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

bda6মঙ্গলবার, ৩ অক্টোবর, ২০১৭: আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছিলেন পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান। অভিযোগ ওঠে আফগানদের দিয়ে মার্কিন মদদে এই হত্যার ছক কষা হয়েছিল।

১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডির পৌরসভা পার্কে আয়োজিত এক সভায় লিয়াকত আলি খানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা করার কথা ছিল। ওই সভামঞ্চ থেকে মাত্র ১৫ গজ দূরে উপবিষ্ট থাকা এক আততায়ী সৈয়দ আকবর তাঁকে গুলি করে। তাঁর বুকে দুটি গুলি লেগেছিল। তিনিঁ নিহত হন। তাঁকে হত্যার কারণ আজও জানা যায়নি। যদিও অভিযোগ ওঠে এর পিছনে যুক্তরাষ্ট্রের হাত রয়েছে।

অভিযোগ ওঠে আফগানিস্তানের তৎকালীন সরকারকে ব্যবহার করে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। ওই হত্যাকাণ্ডের ৬৪ বছর পর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে প্রকাশিত সে সময়কার গোপন নথিপত্র থেকে এই ধরনের তথ্য উঠে এসেছে বলে দাবি করা হয়।

পররাষ্ট্র দফতরের থেকে প্রকাশিত ওই নথির বরাত দিয়ে ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান টুডে জানিয়েছিল, পঞ্চাশের দশকে মার্কিন তেল কোম্পানিগুলোকে ইরানে তেলের চুক্তি পাইয়ে দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।

শুধু প্রত্যাখ্যান নয় উল্টে পাকিস্তান থেকে মার্কিন ঘাঁটি সরানোর দাবি জানিয়েছিলেন। তাঁর এমন অনড় অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে হত্যার পরিকল্পনা করে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। কিন্তু তখন পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করার মতো কাউকে জোগাড় করতে পারেনি তারা। সিআইএ তখন কৌশলগত কারণে আফগানিস্তানের দিকে নজর দেয়। পঞ্চাশের দশকে দেশ দুটির মধ্যে রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল তিক্ত। তখনও পাকিস্তানকে মেনে নেয়নি আফগানিস্তান। ফলে লিয়াকতকে হত্যায় এ তিক্ত সম্পর্ককে কাজে লাগায় ওয়াশিংটন।

তখন আফগান রাজা জহির শাহর কাছে একজন আততায়ী চান কাবুলে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত। বিনিময়ে পাকিস্তান ও আফগান সীমান্তের পাশতুনিস্তানকে স্বাধীনতার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কৌশলগত কারণে এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান জহির শাহ এবং আততায়ী হিসেবে সৈয়দ আকবর নামের একজনকে নিয়োগ করেন তিনি। সিআইএর পরিকল্পনা অনুসারে লিয়াকত আলী খানকে হত্যা করার পর হত্যাকারী আকবরকে হত্যার জন্যও প্রস্তুত রাখা হয় আরও দুজনকে। সেই মতো হত্যাকাণ্ডের একদিন আগে রাওয়ালপিন্ডির একটি আবাসিক হোটেলে উঠেছিল ওই তিন হত্যাকারী।

হত্যাকাণ্ডের পর পরিকল্পনা মাফিক বাকি দুজন ঘাতক আকবরকে গুলি করে মেরে ফেলে। একটু পর ওই দুজনও বিক্ষুব্ধ জনতার গণপিটুনিতে মারা যায়। ফলে হত্যাকাণ্ডের সব তথ্য-প্রমাণ শেষ হয়ে যায় তখনই। হত্যার পর গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল, হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত বুলেট সাধারণভাবে পাকিস্তানের বাজারে পাওয়া যেত না। ওই ধরনের বুলেট পদস্থ মার্কিন কর্তারা ব্যবহার করেন বলেও জানানো হয়েছিল।

মৃত্যুর পর লিয়াকাৎকে শহীদ-এ-মিল্লাহ উপাধীতে ভূষিত করা হয়। রাওয়ালপিন্ডির যে উদ্যানে পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নিহত হন, সে উদ্যানের নামকরণ করা হয় “লিয়াকত বাগ”। ঘটনাচক্রে তার থেকে ৫৬ বছর ২০০৭ সালের ২৭ডিসেম্বর ওই একই স্থানে পাকিস্তানের আরেক প্রধানমন্ত্রী বেনজীর ভুট্টো আততায়ীর হামলায় নিহত হন।

উল্লেখ্য, ১৮৯৬ সালের ২ অক্টোবর অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের কারনালে জন্ম। তাঁর পিতা বৃটিশ সরকারের কাছ থেকে রুখেন-উদ্দৌলা, শমসের জং, নবাব বাহাদুর প্রভৃতি উপাধি লাভ করেছিলেন। তাঁর মায়ের নাম মাহমুদা বেগম। ১৯১৮ সালে তিনি আলিগড়ের মোহামেডান-অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ থেকে স্নাতক হন। একই বছর পারিবারিক আত্মীয়া জাহাঙ্গিরা বেগমকে বিয়ে করেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনি যুক্তরাজ্যে যান এবং ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। অক্সফোর্ডে তিনি ইন্ডিয়ান মজলিসের সম্মানিত কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন।

তিনি ১৯২৩ সালে দেশে ফিরে ভারতীয় কংগ্রেসে যোগ না-দিয়ে, নিখিল ভারত মুসলিম লীগে যোগদান করেন। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি মুজাফফরনগর থেকে প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে।

লিয়াকত আলির আহ্ববানে মহম্মদ আলী জিন্নাহ ভারতে ফিরে এসে মুসলিম লীগ গুছিয়ে নিতে শুরু করেন। ১৯৩৬ সালে বোম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই) নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সম্মেলনে জিন্নাহ লিয়াকত আলিকে মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদে মনোনিত করেন। তখন লিয়াকত বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁকে মুসলিম লীগের সংসদীয় দলেরও সহ সভাপতি করা হয়। ১৯৪৫-৪৬ এর নির্বাচনে লিয়াকত আলি মিরাট থেকে নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনে মুসলিম লীগ মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত আসনগুলোর ৮৭ শতাংশ আসনে জয়লাভ করে। ঐ নির্বাচনের পর একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। লিয়াকত আলি সে সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন।

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর লিয়াকত আলি খানকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর করা হয়। তিনি পাকিস্তানের সংবিধানের রূপরেখা প্রণয়ন করেন এবং সংসদে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ১২ মার্চ তা উপস্থাপন করেন। তাঁর আমলে ভারত ও পাকিস্তান কাশ্মীর সমস্যা জাতিসংঘের মাধ্যমে সমাধানে একমত হয়। তখন এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, এ সমস্যার গণতান্ত্রিক সমাধানের উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে কাশ্মিরে একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। জিন্নাহ মৃত্যুর পর পাকিস্তানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মাঝে সমস্যা দেখা দেয় এবং ভারত-পাকিস্তান দ্বিতীয় যুদ্ধের মুখোমুখি হয়। লিয়াকত আলি তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর সাথে লিয়াকত-নেহেরু চুক্তি করেন। এই চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল ভারত পাকিস্তান সম্পর্কের উন্নয়ন করা। ১৯৫১ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান। ১৯৪৯ সালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐ একই সময় করাচীতে একটি কাগজের টাকা ছাপার কারখানাও (টাকশাল) স্থাপিত হয়।

১৯৫১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বৃটিশ সেনাপ্রধান ডগলাস গ্রেসী অবসরে গেলে লিয়াকত আলি খান জেনারেল আইয়ুব খানকে সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ হিসেবে নিয়োগ করেন। ওই বছরই পাকিস্তানের প্রথম সামরিক অভ্যুত্থান সংঘঠিত হয়েছিল। এই ব্যর্থ অভ্যুত্থান রাওয়ালাপিন্ডি ষড়যন্ত্র নামে পরিচিত। এই ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত ছিলেন সামরিক বাহিনীর চিফ-অব-জেনারেল স্টাফ জেনারেল আকবর খান। তাঁর সাথে আরো ১৪ জন্য সেনাকর্মকর্তা জড়িত ছিলেন। কোর্ট মার্শালে দোষী প্রমাণিত হবার পর এদের কারাদণ্ড হয়।