Tue. May 6th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

খােলা বাজার২৪। সোমবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৭: মিয়ানমারের গণহত্যা ও সেনাবাহিনীর নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পেতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এতে বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর অপ্রত্যাশিত চাপ সৃষ্টি হয়েছে। রোহিঙ্গার পুনর্বাসন ও ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে তাৎক্ষণিক বড় ধরণের অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে সরকারকে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে ব্যর্থ হলে দীর্ঘমেয়াদি দেশের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থ প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, দেশে বন্যার পাশপাশি অপ্রত্যাশিতভাবে রোহিঙ্গারা অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে কর্মীদের কাজ কমিয়ে দিয়েছে। অনেক প্রকল্প বন্ধ করে দিয়েছে। কাতারে সমস্যা আছে। নানা ধরনের সমস্যার কারণে রেমিটেন্সে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। স্বাভাবিকভাবে অর্থনীতিতে একটি চাপ সৃষ্টি হয়েছে। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ে আশঙ্কা অনুযায়ী এর হার বাড়েনি। বন্যার কারণে সবজির দাম বেড়েছে। প্রথম দায়িত্ব চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা। সরকার সেটি করতে পেরেছে বলে দাবি করেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এমকে মুজেরী বলেন, অর্থনীতির কয়েকটি সূচকের ওপর সম্প্রতি চাপ সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে বন্যা ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে মূল্যস্ফীতিতে এক ধরনের চাপ পড়েছে। চালসহ খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে আগামী মাসগুলোয় মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। পাশাপাশি রেমিটেন্স ও রফতানি আয়ে নিন্মমুখী ও স্থবিরতা এখনও কাটেনি। আগামীতে এ উভয় খাতের প্রবৃদ্ধি না হলে অর্থনীতির ওপর বহির্খাতে চাপ আরও বাড়ার সম্ভাবনা থাকবে। তিনি বলেন, এ পরিস্থিতিতে মুদ্রা বিনিময় হারের ওপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করে কৃত্রিমভাবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। এভাবে খুব বেশিদিন পরিচালনা সম্ভব হবে না, যদি নিন্মমুখী সূচকগুলোর চাপ সঠিকভাবে মোকাবেলা করা না হয়।

পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এরই মধ্যে রোহিঙ্গার চাপে কক্সবাজার এলাকার পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। রোহিঙ্গাদের কারণে এরই মধ্যে ১৫০ কোটি টাকার বনজসম্পদ ধ্বংস হওয়ার কথা জানিয়েছে ওই কমিটি। এছাড়া তাদের কারণে কক্সবাজার সৌন্দর্যহীন ও পর্যটকশূন্য হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের শরণার্থী সেলের সংশ্লিষ্টরা।

এছাড়া রোহিঙ্গা সংকট প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এত বিপুল বিপন্ন মানুষ যেখানেই থাকবে, সেখানেই বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয় হবে। সামাজিক কিছু সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে, যেমন- স্থানীয় শ্রমিকদের মজুরি কমে যাচ্ছে। কারণ চাহিদার তুলনায় শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। সেখানে একটি অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে। তাদের মতে, রোহিঙ্গাদের জন্য বৈদেশিক সহায়তা এলেও বাংলাদেশের তহবিল থেকে বিপুল অর্থ খরচ হবে। সেখানেও বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে।

রোহিঙ্গা সংক্রান্ত অপ্রত্যাশিত চাপ সৃষ্টির আগে অর্থনীতিতে বড় ধরনের আঘাত আসে দেশব্যাপী ৩২ জেলার বন্যা। এতে কৃষি খাত ও গ্রামীণ অবকাঠামোতে বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে বন্যায় ১ লাখ ৪ হাজার ৯০০ হেক্টর কৃষি জমি পুরোপুরি ক্ষতি হয়। আংশিক ক্ষতি হয়েছে ৫ লাখ হেক্টর জমি। হাওর অঞ্চলে আগাম বন্যার কারণে ধান উৎপাদন কম হবে ৮ থেকে ১০ লাখ টন। আর পরে স্বাভাবিক বন্যায় ২০ লাখ টন উৎপাদন কম হয়েছে। সব মিলিয়ে ৩০ লাখ টন চালের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যে কারণে বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে ১২ লাখ টন চাল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু পরে আরও ৩ লাখ বাড়িয়ে ১৫ লাখ টন চাল আমদানির ঘোষণা দেয়া হয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মজুদ কমে আসায় সরকারকে এবার প্রচুর চাল আমদানি করতে হবে। বেশি দামে চাল কিনে কম দামে সরবরাহ করতে হবে। শরণার্থীদের জন্য খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। সে কারণে এবার খাদ্য খাতে মোটা অঙ্কের ভর্তুকি দিতে হতে পারে। তাতে বাজেটের ওপর চাপ পড়বে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এ বছর কৃষি খাতে ৯ হাজার কোটি টাকাসহ ভর্তুকি খাতে ১৯ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু বছর শেষে এ ভর্তুকির পরিমাণ আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এছাড়া বন্যায় গ্রামীণ অবকাঠামোর মধ্যে সাড়ে চার হাজার প্রতিষ্ঠান, সাড়ে ৯শ’ কালবার্ট, ৮৯০ কিমি. রাস্তা ও ১৩২ কিমি. বেড়িবাঁধ এবং ১ লাখ ৪ হাজার ঘরবাড়ি পুরোপুরি ক্ষতি হয়েছে। আর আংশিক ক্ষতি হয়েছে ৬ লাখ ৩৩ হাজার ঘরবাড়ি, ১০ হাজার ৫০০ কিমি. রাস্তা ও ৬৬৪ কিমি. বেড়িবাঁধ।

জানা গেছে, বন্যাপরবর্তী এসব রাস্তাঘাট, বেড়িবাঁধ, কালবার্ট, প্রতিষ্ঠান সংস্কার ও মেরামতের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়েল ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, প্রাথমিকভাবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বাজেট থেকে এসব মেরামত ও সংস্কারের জন্য ব্যয় করতে বলা হয়েছে। বছরের শেষে সংশোধিত বাজেটে এ ব্যয় অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

এদিকে চাপের মুখে পড়েছে মূল্যস্ফীতি। বন্যা ও রোহিঙ্গা সংকট থাকায় খাদ্য সরবরাহে চ্যানেলে এক ধরনের বাধা সৃষ্টি হয়েছে। এতে চালের মূল্যসহ সব ধরনের সবজির দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। পাশাপাশি খাদ্যপণ্যের বাড়তি দাম বিরাজ করছে বিশ্ববাজারেও। ফলে চলতি অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের মতে, কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়েই ছিল। গত অর্থবছর শেষে গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে এসেছিল। এবার তা ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

অভ্যন্তরীণ চাপের পাশাপাশি রেমিটেন্স ও রফতানি আয়ের প্রবাহ স্থবিরতার কারণে বহির্খাতের অর্থনীতির ওপরও চাপ বাড়ছে। সরকার নানামুখী উদ্যোগ নেয়ার পর রেমিটেন্সপ্রবাহ বাড়ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গত সেপ্টেম্বরে ৮৫ কোটি মার্কিন ডলারের রেমিটেন্স আসে। আগাস্টে প্রায় ১৪২ কোটি ডলারের রেমিটেন্স আসে। এক মাসের ব্যবধানে কমেছে ৫৭ কোটি ডলার। তবে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর- এ সময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ের ৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ বেশি আসে রেমিটেন্স। বিশ্বব্যাংক মনে করছে, দীর্ঘদিনে কমে যাওয়ার পর এবার রেমিটেন্সপ্রবাহ ঘুরে দাঁড়াতে পারে।

২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর (প্রথম প্রান্তিক) রফতানির আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। শুধু সেপ্টেম্বরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কমেছে প্রায় ২৫ কোটি ডলার। অর্থাৎ ২৬ দশমিক ৭২ শতাংশ কম। একমাত্র হিমায়িত মাছ ছাড়া কোনো খাতেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাব মতে, প্রথম প্রান্তিকে রফতানি আয় ৮৯১ কোটি ডলারের বিপরীতে ৮৬৬ কোটি ডলার আয় হয়েছে।

বন্যাসহ কয়েকটি কারণে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন হার কমছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট- এ দু’মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন হয়েছে ৫ দশমিক ১৫ শতাংশ। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো ব্যয় করতে পেরেছে ৮ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা। বাকি ৯৫ শতাংশ এডিপি আগামী ১০ মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে।