Tue. May 6th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

খােলা বাজার২৪। সোমবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৭: চালের সংকট দূর করা এবং দামের ঊর্ধ্বগতিতে লাগাম টানতে দুই ধাপে কমানো হয় আমদানি শুল্ক। ২৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে আনা হয় ২ শতাংশে।

শুল্ক কমানোর ফলে দেশে রেকর্ড পরিমাণ চাল আমদানি হয়েছে এবং হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের এ সুবিধা দেওয়ার ফলে ভোক্তাদের কম দামে চাল কিনতে পারার কথা থাকলেও বাস্তবে তা হয়নি। কারণ আমদানি শুল্ক কমানোর সুবিধার বড় অংশই কায়দা করে ব্যবসায়ীরা নিজেদের পকেটে পুরেছেন।

দেশের বাজারে সংকট তৈরি হওয়ার পর থেকেই ভারত থেকে চাল আমদানি করছেন দীনেশ পোদ্দার। তিনি জানান, বর্তমানে প্রতি টন চাল কিনতে হচ্ছে ৪০০-৪১০ ডলারে (স্থানীয় মুদ্রায় ৩২ হাজার ৮০০-৩৩ হাজার ৬২০ টাকা)। ২ শতাংশ হারে শুল্কায়ন করলে শুল্কের পরিমাণ হয় ৬৫৬-৬৭৩ টাকা। আগে প্রতি টন চালে শুল্কের পরিমাণ ছিল প্রায় ৯ হাজার ২০০ টাকা। এই হিসাবে দেখা যায়, শুধু শুল্কায়নের কারণেই প্রতি কেজি চালে ৯ টাকা কম খরচ হচ্ছে আমদানিকারকদের।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাটের বস্তার বাধ্যতামূলক ব্যবহার থেকে অব্যাহতি দেওয়ায় প্রতি কেজি চালে ব্যবসায়ীদের সাশ্রয় হচ্ছে আরো এক টাকা।

একই সঙ্গে ব্যাংক হিসাবে টাকা না থাকলেও চাল আমদানিতে ঋণপত্র খোলার সুবিধা দেওয়া হয়েছে। আগে যেখানে বড় অঙ্কের টাকা জামানত দিতে হতো, এখন সেটা দিতে হচ্ছে না। অভিযোগ উঠেছে, কৃত্রিম সংকট তৈরি করে এতগুলো সুবিধা বাগিয়ে নিলেও ব্যবসায়ীরা চালের দাম কমিয়েছেন কেজিপ্রতি মাত্র তিন-পাঁচ টাকা। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, শুল্ক ছাড় দেওয়ায় যে সুবিধা ব্যবসায়ীরা পেয়েছেন সে পরিমাণও যদি দাম কমানো হতো তবে বাজারে স্বস্তি ফিরত অনেকখানি।

জানা গেছে, সরকারের হিসাবেই আমদানি শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে আনায় প্রতি কেজি চালের আমদানি খরচ ছয় টাকা কম হচ্ছিল। এখন শুল্ক ২ শতাংশে নামিয়ে আনার পর প্রতি ১০০ টনের চালানে শুল্ক আসছে প্রায় ৩৭ হাজার টাকা। ১০ শতাংশ শুল্কের সময় পরিমাণ ছিল সোয়া তিন লাখ টাকার মতো। সে হিসাবেই খরচ কমেছে আরো দুই টাকা।

আমদানিকারক দীনেশ পোদ্দার বলেন, ‘শুল্ক কমানোয় কেজিতে ৮-৯ টাকা পর্যন্ত আমদানি খরচ কমেছে। তবে বাজারে সেটার প্রভাব নেই। ভারতের চালের দাম বৃদ্ধি এবং দেশি ব্যবসায়ীদের কারণেই সেটা হয়ে ওঠেনি।’

জানা গেছে, চালের সংকট তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে চাল আমদানি শুরু করেন। তখন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা প্রতি টন চালের দাম বাড়িয়ে ৪৩০ ডলার করেন। সে কারণেই মূলত শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।

গত ২০ জুন চাল আমদানির ওপর বিদ্যমান শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করার সিদ্ধান্তের কথা জানান বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। সে সময় তিনি বলেছিলেন, শুল্ক কমানোর পর কেজিপ্রতি পাঁচ-ছয় টাকা পর্যন্ত দাম কমবে। এরপর ১ জুলাই থেকে কম শুল্কে চাল আমদানি শুরু করেন ব্যবসায়ীরা। সে সময় প্রচুর পরিমাণ চাল ভারত থেকে আমদানি শুরু হলে এক মাসে চালের দাম কমে মাত্র এক-দুই টাকা। যদিও পাইকারি পর্যায়ে সেটা তিন টাকা পর্যন্ত কমেছিল। এরপর আরো এক দফা শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত হয় আগস্টের মাঝামাঝি। ১৭ আগস্ট জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চালের আমদানি শুল্ক ২ শতাংশ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। শুল্ক কমানোর পাশাপাশি ভারতীয় বাজারে কমেছে চালের রপ্তানি মূল্যও। বর্তমানে ভারতীয় চাল টনপ্রতি ৩৮০-৪০০ ডলারে রপ্তানি হচ্ছে।

আগস্ট পর্যন্ত চালের শুল্ক দুই দফা কমানো হলেও বাজারে খুব একটা প্রভাব পড়তে দেখা যায়নি। টিসিবির দেওয়া তথ্যমতে, সেপ্টেম্বরের ১৬ তারিখে সরু চালের বাজারদর ছিল ৬২-৬৮ টাকা। শুল্ক কমানোর আগে বাজারে বিভিন্ন প্রকার সরু চাল বিক্রি হয়েছে ৬৫-৭০ টাকায়। আর মোটা চালের দাম ৫০-৫২ টাকায় আটকে ছিল। অর্থাৎ শুল্ক কমানোর পরও চালের দাম কমে মাত্র দুই টাকা।

জানা গেছে, বেনাপোল, ভোমরা, হিলিসহ কয়েকটি স্থলবন্দর দিয়েই প্রচুর চাল আমদানি হচ্ছে। বন্দরকেন্দ্রিক ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং এজেন্ট প্রতিষ্ঠানের মালিক রফিকুল ইসলাম জানান, দুই দফায় ২৬ শতাংশ শুল্ক হ্রাস হিসেবে প্রতি কেজি চাল আমদানিতে ডলারের রেট ও দাম ভেদে ৮-৯ টাকা কমেছে। কিন্তু চাল বাজারে বেশি দামেই বিক্রি হচ্ছে। ভোক্তারা সুফল পেয়েছে নামমাত্র। মুনাফার টাকাটা প্রায় পুরোটাই যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের পকেটে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. আনিসুজ্জামান বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা যে চালগুলো নিয়ে আসেন সেগুলো বাজার পর্যন্ত পৌঁছতে পরিবহনে এক ধরনের বাধা রয়েছে সেটা সবাই জানে। সরকার চাল কিনতে পারছে না, বিভিন্ন দেশে দৌড়াচ্ছে। কিন্তু আমাদের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও তো সরকার চাল কিনতে পারত, যেহেতু তাঁরা প্রচুর চাল দেশে এনেছেন। তাঁদের থেকে চাল কিনে সেটাই আবার নির্দিষ্ট করে দিতে পারত যে তোমরা এই দামে বিক্রি করো। কিন্তু সেটা হয়নি। আসলে মনিটরিং করার বা এসব চিন্তা-ভাবনা করার মতো লোক কম। তাই বাজারে প্রভাব কম পড়ে। ’

এদিকে কাস্টম কর্তৃপক্ষের সংরক্ষিত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির মাসিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর তিন মাসে চাল আমদানির পেছনে ব্যয় হয়েছে ৪৪ কোটি ৭১ লাখ ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের একই সময়ে এই ব্যয় ছিল ৩২ লাখ ডলার। সেই হিসাবে চালের আমদানি ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১৩৮ গুণ বা ১৩৮৭১.৮৮ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক ও ট্যারিফ কমিশন সূত্রে জানা গেছে, শুল্ক কমানোর পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত চাল আমদানির পরিমাণ ২৫ লাখ টন ছাড়িয়েছে।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘এ দেশের ব্যবসায়ীরা একই সঙ্গে লোভী ও সুযোগসন্ধানী। কান্নাকাটি করে হোক, চাপ দিয়ে হোক সুবিধার সবটুকু নেবে। কিন্তু সেই সুবিধা ভোক্তাদের সামনে রেখে নিলেও সেটা আর তাদের কাছে পৌঁছে না। এখনো ঠিক তাই ঘটছে। একটা সংকটে তারা সুবিধা নিয়েছে ভোক্তাদের কথা বলে। কিন্তু বাজারে সেটার পুরো প্রভাব পড়েনি। ’

চাল আমদানির সঙ্গে জড়িত মেসার্স এনডি সাহার মালিক এবং নওগাঁর ধান-চাল আড়তদার ও ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নিরোধ বরণ সাহা বলেন, এলসির দরের ওপর চালের দাম নির্ভর করে। তবে বেশ কয়েক দিন ধরে ভারতে প্রতি টনের বাজার ৩৯০ ডলার চলছে। ফলে ৮২ টাকা ডলারের রেট ধরলে ২ শতাংশ হারে এখন প্রতি টন চালে ৬৩৯ টাকা শুল্ক দিতে হচ্ছে। তা যদি আগের ২৮ শতাংশ হারে হতো তবে প্রতি কেজিতে একই দরে প্রায় আট টাকা বেশি লাগত।

সরবরাহ সংকট না থাকলেও গত ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি থেকে ধাপে ধাপে দাম বাড়ে চালের। হাওরে আগাম বন্যায় বোরো উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় চালের দাম বাড়ানোর নতুন সুযোগ পেয়ে যান ব্যবসায়ীরা। হাওর অঞ্চলে আগাম বন্যায় ক্ষতি হয় ছয় লাখ টনের মতো চাল উৎপাদন। পরে সারা দেশে বন্যায় বোরো মৌসুমে ধানের ফলন কম হয়। এর সঙ্গে যোগ হয় ব্লাস্ট রোগের প্রকোপ। খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম দাবি করেন, এসব কারণে প্রায় ২০ লাখ টন চাল উৎপাদন কম হয়েছে। তবে ব্যবসায়ীদের দাবি, এর পরিমাণ ২৫ লাখ টনেরও বেশি।

গত আগস্টে চালের দাম বাড়তে থাকায় আমদানি শুল্ক কমিয়ে ২ শতাংশ করা হয়। খাদ্যমন্ত্রী সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি জানান, মাত্র এক মাসের ব্যবধানেই বেসরকারিভাবে চাল আমদানি হয়েছে ছয় লাখ টনের বেশি। তবে সুবিধা নিয়ে আমদানি করা চালের প্রভাব পড়ছে না চালের বাজারে।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যে দেখা গেছে, গত বছরের এই সময়ের তুলনায় মোটা চালের দাম প্রায় ১৬ শতাংশ বেশি। এক মাসের ব্যবধানে চালের দাম কমেছে ৪ শতাংশের কিছু বেশি। এখন বাজারে মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৬-৪৮ টাকায়, যা মাসদেড়েক আগে ছিল ৫০-৫২ টাকা। গত বছর একই সময়ে বিভিন্ন প্রকার সরু চালের যে দাম ছিল তার চেয়ে ২০.৫৯ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে এখন।

খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বদরুল হাসান বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করেছি এবং করে যাচ্ছি। বাজারে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য সবার সহযোগিতা দরকার। ’

সূত্র : কালের কণ্ঠ