খােলা বাজার২৪। শনিবার, ০২ডিসেম্বর , ২০১৭: পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির (শান্তি চুক্তি) ২০তম বর্ষপূর্তি শনিবার। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য এলাকার শান্তি স্থাপনে জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সঙ্গে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার এ চুক্তি করে। সে সময়ে এ চুক্তি দেশে-বিদেশে আলোড়ন ফেলে। কিন্তু, চুক্তির দুই দশক পরে এসেও প্রশ্ন হয়ে রয়েছে- সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদ, সংঘাত, খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি বন্ধ হয়ে পাহাড়ে কতটা শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়েছে?
শুরু থেকেই এই চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। চুক্তি বাস্তবায়নে পরস্পরকে দোষারোপ যেন নিত্য ব্যাপার।
ইতোমধ্যে চুক্তির অন্যতম পক্ষ জেএসএস ভেঙে চারটি সশস্ত্র সংগঠন গড়ে উঠেছে। তাদের তৎপরতায় সারাক্ষণ তটস্থ থাকেন পাহাড়ের অধিবাসীরা।
এর পাশাপাশি ২০ বছরের খতিয়ান বলে, চুক্তি অনুযায়ী জেএসএস ও স্থানীয় উপজাতীয়দের একটি অংশ বেশ লাভবান হয়েছেন। বিপরীতে সাধারণ পাহাড়ি ও বাঙালিরা সেই অন্ধকারেই রয়েছে গেছেন। দুই দশক গেলেও তারা খুন, গুম, অপহরণ ও চাঁদাবাজি থেকে রেহাই পাচ্ছেন না।
গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যে, চুক্তির পর গত ২০ বছরে তিন পাহাড়ি সশস্ত্র গ্রুপের ভ্রাতৃঘাতী ও নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ৪ শতাধিক মানুষ।
ফিরে দেখা:
চুক্তির স্বাক্ষরের ধারাবাহিকতায় ১৯৯৮ সালের ১০ ফ্রেরুয়ারি খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার স্টেডিয়ামে আনুষ্ঠানিকভাবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে গেরিলা নেতা সন্তু লারমা অস্ত্র তুলে দিয়ে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে জনসংহতি সমিতির সদস্যরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার অঙ্গিকার করেন। কিন্তু, এখনো তাদের সদস্যদের হাতে আধুনিক অস্ত্র শোভা পাচ্ছে বলে অভিযোগ খোদ পাহাড়ের অন্য উপজাতীয় সংগঠনগুলোর।
চাঁদাবাজি ও সরকারি অর্থ লোপাটের অভিযোগে শীর্ষ নেতৃত্বে ফাটল ধরার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১০ সালে ভেঙে যায় জেএসএস। চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে ১৯৯৮ সালে জেএসএস নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে জন্ম নেয় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। কালের বিবর্তনে ২০১৭ সালে এসে ভেঙে যায় ইউপিডিএফও।
খুন-গুম-অপহরণের খতিয়ান:
১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৯৭ সালে চুক্তি সম্পাদনের আগ পর্যন্ত পাহাড়ে সেনা, পুলিশ, আনসার, ভিডিপি, সাধারণ পাহাড়ি-বাঙালি ও শান্তি বাহিনীর সদস্য মিলিয়ে ৩০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে বলে দাবি কয়েকটি সংগঠনের।
পার্বত্য চুক্তির মধ্য দিয়ে এই খুনাখুনি বন্ধ হওয়ার প্রত্যাশা করলেও বাস্তবে তা না হওয়ায় এ অঞ্চলের মানুষ হতাশ।
চুক্তির পর ইউপিডিএফ তাদের পূর্বসূরিদের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে থাকে। এ নিয়ে জেএসএস ও ইউপিডিএফের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে শুরু হয় ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত। ঝরতে থাকে প্রাণ, বাড়ে আধুনিক অস্ত্রের ঝনঝনানি।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, বিভিন্ন সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে আর্মি, পুলিশ, বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) ও আনসারসহ পাহাড়ি-বাঙালি নিহত হয়েছেন ২ হাজার ৩১৪ জন।
পার্বত্য চুক্তি সম্পাদনের পর ১৯৯৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৬৭৬ জন। আহত ১ হাজার ৩২৬ জন এবং অপহরণের স্বীকার হয়েছেন ১ হাজার ২৯৪ জন।
এদিকে, ইউপিডিএফ ও জেএসএস সূত্রে জানা গেছে, পার্বত্য চুক্তির পর বিভিন্ন সময় তাদের চার শতাধিক নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন, যার বেশিরভাগই ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষে।
চুক্তির সুযোগ-সুবিধার খতিয়ান:
১৯৯৭ সালে চুক্তির অন্যতম লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রদ্রোহী সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের নিরস্ত্র করে শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পাহাড়বাসীর উন্নয়ন। যদিও অভিযোগ রয়েছে, চুক্তির ক্ষেত্রে পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালি এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি এবং তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে।
তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও এ চুক্তির বিরোধিতা করে পার্বত্য চট্টগ্রাম অভিমুখে লংমার্চ করেছিল। কিন্তু, ক্ষমতায় এসে চুক্তি বাতিল বা সংশোধন প্রসঙ্গে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি দলটি।
গত ২০ বছরে চুক্তির শতভাগ পূরণ না হওয়ার অভিযোগ তুলে দেশে-বিদেশে নানা রকম বিভ্রান্তি ছড়ানোর অভিযোগ রয়েছে সন্তু লারমা তথা চুক্তির পক্ষের সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে।
কিন্তু, সরকার পক্ষ বলছে, চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে ৪৮টি ধারা। ২৪টি ধারার আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে। বাকিগুলোর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন। কিন্তু, সন্তু লারমার দাবি, মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সরকারের আমলে চুক্তি বাস্তবায়নের অনুকূলে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ১. ১৯৯৮ সালেই সরকার পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করেন। ২. জেএসএস প্রধান সন্তু লারমাকে প্রতিমন্ত্রী মর্যাদায় আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান করে ২৫ সদস্যের অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ গঠন করেন। দীর্ঘ ১৯ বছর বিনা নির্বাচনে সন্তু লারমা এখনো সেই চেয়ারে আছেন। ৩. উপজাতীয়দের কল্যাণে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করেন। তার ধারাবাহিকতায় উপজাতীয় একজনকে মন্ত্রী বানানো হয়। দীর্ঘ ১৯ বছর পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন বিভিন্ন উপজাতীয় নেতা। ৪. পার্বত্য ৩ জেলায় ‘পার্বত্য জেলা পরিষদ’ গঠন করেন। ৫. উপজাতীয় থেকে পরিষদের চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়ে আসছেন সরকার। বিনা নির্বাচনে সেই পার্বত্য জেলা পরিষদও চলছে জন্মলগ্ন (১৯৯৮) থেকে। ৬. চুক্তির শর্তানুযায়ী উপজাতীয়দের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডেও। যদিও বিএনপির আমলে একবারের জন্য বাঙালি এমপি ওয়াদুদ ভূইয়া সেই চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ৭. মন্ত্রণালয়ের অনেকগুলো বিষয় হস্তান্তর করে ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়েছে। যার মধ্যে সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, মৎস্যসহ ৩৩টি বিভাগের মধ্যে মধ্যে রাঙামাটিতে ২৩, খাগড়াছড়িতে ২২ এবং বান্দরবানে ২১টি পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তর করা হয়েছে। আরও অনেক বিভাগ হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে।
৮. প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় একজন উপজাতীয়কে শরণার্থী পুনর্বাসন বিষয়ক টাস্কফোর্স চেয়ারম্যান করা হয়েছে। এজন্য টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। ৯. ১২ হাজার ২২৩টি উপজাতীয় চাকমা পরিবারকে নানা সুবিধাসহ পুনর্বাসন করা হয়েছে। ১০. আত্মসমর্পণকারী শান্তিবাহিনীর সদস্যদের সরকারি চাকরি দিয়ে পুনর্বাসন করে হয়েছে। ১১. সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, আনসারসহ নিরাপত্তা বাহিনীর পদাতিক ব্রিগেড সদর দফতরসহ কয়েকশ’ ছোট-বড় ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। ১২. সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে উপজাতি কোটা বাড়ানো হয়েছে। ১১. স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ইত্যাদিতে ভর্তির কোটা বাড়ানোসহ নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমা বিভিন্ন সময় অভিযোগ করেছেন, সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক নয়। চুক্তি বাস্তবায়নের পরিবর্তে সরকার রাষ্ট্রযন্ত্র ও অস্ত্র শক্তি ব্যবহার করে, জুম্ম জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে দমন-পীড়ন করছে। এমন চলতে থাকলে জুম্ম জনগণ তাদের অস্তিত্ব ও আবাসভূমির সংরক্ষণের স্বার্থে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে বদ্ধপরিকর।
জনসংহতির সমিতির অপর অংশের (এমএন লারমা) সভাপতি সুধাসিন্দু খীসা বলেন, চুক্তি বাস্তবায়নে এখনও অনেক বিষয় রয়ে গেছে। ভূমি কমিশন যদি যথাযথভাবে কাজ করে এবং কাজ করার জন্য যদি আন্তরিক হন তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘদিনের সমস্যা ঝুলে আছে তা কিছুটা হলেও পরিষ্কার হবে।
তিনি অনির্বাচিত আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদে নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে পরিচালনার দাবি জানিয়েছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমঅধিকার আন্দোলনের খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট আব্দুল মালেক মিন্টু বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অসাংবিধানিক ও বৈষম্যমূলক। এ চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধানকে অস্বীকার করা হয়েছে।
তিনি বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে যুগ যুগ ধরে বসবাসকারী একটি বিশাল জনগোষ্ঠী বাঙালিদের অধিকার হরণ করা হয়েছে। সম্প্রতি অবৈধ চুক্তির ফসল ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন সংশোধন করে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করার পথ সুগম করেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের একমাত্র মহিলা সংসদ সদস্য (এমপি) ফিরোজা বেগম চিনু বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শান্তি চুক্তি করে পাহাড়ে অনেক উন্নয়ন করেছেন। এ উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে প্রয়োজন শান্তি-শৃঙ্খলা। কিন্তু, উপজাতীয়দের একটি অংশ সশস্ত্র গ্রুপ করে চাঁদাবাজি, খুন, গুম, অপহরণ করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা করছে।
সূত্র : পরিবর্তন ডটকম