Sun. Jun 22nd, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

খােলা বাজার২৪। সোমবার, ৪ ডিসেম্বর , ২০১৭: খাবার বা পণ্য ঘরে বসে পেতে হোম ডেলিভারি সার্ভিস চালু হয়েছে অনেক আগেই। আর এখন রাজধানীতে চালু হয়েছে মাদকের হোম ডেলিভারি। চাইলেই ঘরে বসে পাওয়া যাচ্ছে যেকোনও ধরনের মাদক দ্রব্য। মাদকসেবীদের জন্য নতুন এই ‘সেবা’ চালু করেছে পুরনো ও অভিজ্ঞ মাদক ব্যবসায়ীরা।

রাজধানীতে রয়েছে মাদক বেচাকেনার বিভিন্ন স্পট। এসব স্পট থেকে মাদকদ্রব্য কেনা সবসময় নিরাপদ নয়। তাই সামান্য বেশি টাকা দিলেই হোম ডেলিভারি পাওয়া যাচ্ছে। অনেক ধরনের মাদকের মধ্যে হোম ডেলিভারিতে ইয়াবার চাহিদা সবচেয়ে বেশি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে অনায়াসে এ ব্যবসা চলছে রাজধানীজুড়ে। আকারে ছোট ও সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় ইয়াবার হোম ডেলিভারি ঠেকাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন গোয়েন্দারা।

সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া মাদকের হোম ডেলিভারি ঠেকানো বেশ মুশকিল বলে দাবি করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, আকারে ছোট মাদকদ্রব্যগুলোর হোম ডেলিভারিতে চাহিদা বেশি। শরীরের গোপনস্থানে লুকিয়ে এসব মাদকের ডেলিভারি দেওয়া হয়। তবে হোম ডেলিভারি ঠেকানো কঠিন হলেও অসম্ভব না। রাজধানীতে মাদক ব্যবসার মূল হোতাদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হলে কেনাবেচার এই নতুন পদ্ধতিও এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজধানীর অন্তত সাতটি এলাকায় মাদকের নিয়মিত হোম ডেলিভারি পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকা, তেজগাঁও, গুলশান, নিকেতন, মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প, মিরপুর, উত্তরা উল্লেখযোগ্য। আর এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা কেউই নতুন নয়, পুরনো মাদক ব্যবসায়ীরাই এ সেবা চালু করেছে।

কিভাবে মাদকের হোম ডেলিভারি চলছে? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের নিয়মিত অভিযানে রাজধানীতে মাদকের বড় বড় স্পটগুলো প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। তাছাড়া, ওপেন স্পটে মাদক কেনাবেচা এখন আর নিরাপদও নয়। যেকোনও মুহূর্তে আটক হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে ক্রেতা-বিক্রেতা দুপক্ষেরই। ফলে নিরাপদে ব্যবসা চালাতে শুরু হয়েছে ‘হোম ডেলিভারি’। কিন্তু যে কেউ চাইলেই হোম ডেলিভারি পাবেন না। পুরনো ক্রেতা ও পরিচিতদের রেফারেন্স পেলেই কেবল হোম ডেলিভারি পাওয়া যায়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যবসায়ী জানায়,প্রায় পাঁচ বছর ধরে সে মাদকের ব্যবসা করে আসছে। তার ভাষ্য, এখন তো সবকিছুই ডিজিটাল হইছে, তাই আমিও ব্যবসাকে ডিজিটাল করে ‘হোম ডেলিভারি’ চালু করেছি। তাছাড়া, স্পটে কেনাবেচা করা রিস্কি। ক্রেতা-বিক্রেতা দু’পক্ষেরই ঝামেলা। স্পট থেকে মাদক কিনে নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাওয়ার সাহস অনেক ক্রেতাই পান না। তাই কিছুটা রিস্ক থাকলেও আমরা বাসায় ডেলিভারি দিয়ে আসি। বিনিময়ে আগের তুলনায় মাদকের দাম কিছুটা বেশি রাখা হয়।দাম একটু হলেও বেশি ক্রেতারা কিন্তু এতে খুশি। কেননা, তাদের আর কোনও রিস্ক থাকে না।

নাম প্রকাশ না করে উত্তরার একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী বলেন, ‘ব্যবসায়ীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে স্পটে। কিন্তু স্পটে গিয়ে কিনে আনাটা ঝামেলার। পুলিশ অনেক ঝামেলা করে। যে বিক্রি করে তাকে না ধরে, যে কিনতে যায় তাকে ধরে।আর একবার ধরা পড়লে সঙ্গে থাকা টাকা দিয়েও ছাড়া পাওয়া যায় না। বাবা-মাকে জানানোর হুমকি দেয়। তারপর মোটা অংকের টাকা দিয়ে ছাড়া পেতে হয়। আর হোম ডেলিভারিতে সামান্য টাকা বেশি গেলেও পুলিশের কোনও ঝামেলা নেই। খুব সহজে ধরা না পড়লেও হোম ডেলিভারি দেয় এমন মাদক ব্যবসায়ীকে এরইমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। এছাড়া, মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে আসা একাধিক ব্যক্তিও হোম ডেলিভারির মাধ্যমে মাদক সংগ্রহের বিষয়টি স্বীকার করেছেন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের রমনা জোনের সাব ইন্সপেক্টর মোশাররফ বলেন, ‘গত ২৬ সেপ্টেম্বর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে মাদক ব্যবসায়ীদের একটি গ্রুপকে আটক করা হয়েছিল। এই চক্রের ছয় জনকে আটক করা হয়।তারা ফেনসিডিল ডেলিভারি দিতো। মোবাইল ফোনে ক্রেতা ডিমান্ডের কথা জানালেই জায়গা মতো ফেনসিডিল পৌঁছে দিতো তারা।

এই গ্রুপটির কাছ থেকে হোম ডেলিভারির কাজে ব্যবহার করা তিনটি মোটরসাইকেল ও একটি প্রাইভেটকার আটক করা হয়। তবে আটক ছয় জন বর্তমানে জামিনে রয়েছে বলে জানান সাব ইন্সপেক্টর মোশাররফ। কমবেশি সব শ্রেণির মাদকাসক্তরাই এখন হোম ডেলিভারি নিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। তবে এ ক্ষেত্রে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেশি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সদস্যদের দাবি, কোন এলাকায় কোন মাদক বেশি ডেলিভারি হয়, সেটিও নির্ভর করে মূলত এলাকারই ওপরই। যেমন- গুলশানে মদ-ইয়াবা, তেজগাঁওয়ে গাঁজা-ফেনসিডিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গাঁজা-ইয়াবা,নিকেতনে ইয়াবা-মদ, মিরপুরে ইয়াবা-মদ, উত্তরায় ইয়াবা ও গাঁজার চাহিদা বেশি। রাজধানীর উল্লিখিত এলাকাগুলোতে হোম ডেলিভারির চাহিদা দিন দিন বাড়লেও এসব হোম ডেলিভারি বন্ধ করা কঠিন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

ডিবি দক্ষিণ বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার খন্দকার রবিউল আরাফাত লেলিন বলেন, এরা খুব কৌশলে কাজটি করে থাকে। ক্রেতাদের চাহিদা থাকে কম কম। ফলে ইয়াবার মতো ছোট আকারের মাদক যেকোনোভাবে সঙ্গে নিয়ে মুভ করা যায়। ফলে কার আছে ইয়াবা আছে তা শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে ধরা মুশকিল। তবে কিছু কিছু ধরা পড়ছে।

তিনি বলেন, হোম ডেলিভারির বাহক হিসেবে নারী ও শিশুদেরও ব্যবহার করা হচ্ছে। মাদক দ্রব্য বহনকারীরা ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে চলাফেরা করে। সুন্দরী ও স্মার্ট নারীদের মাদকদ্রব্য পরিবহনের কাজে ব্যবহার করা হয়। আবার বোরকা পরিহিত নারীদের এ কাজে ব্যবহার করা হয়। যাতে সন্দেহ করা না যায় সেজন্য শিশুদের বাহক হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা পুরনো কৌশল। এখন হোম ডেলিভারিতেও তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ঢাকা মেট্রো উপ-অঞ্চলের সহকারী পরিচালক (ঢাকা উত্তর) মোহাম্মদ খুরশিদ আলম বলেন, মাদকের ক্ষেত্রে একেক সময় একেকটি নতুন ট্রেন্ড আসে। আমরা সেটিকে চিহ্নিত করে ধ্বংস করার চেষ্টা করি। আমাদের নিয়মিত অভিযানের কারণে ব্যবসায়ীরা এখন কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। তারা এখন আর চাইলেই স্পট থেকে মাদক বিক্রি করতে পারছে না। আমাদের কঠোর নজরদারিও রয়েছে।আমরা ইতোমধ্যে মাদক বিক্রির বেশ কয়েকটি বড় স্পট ধ্বংস করতে পেরেছি। সেসব ব্যবসায়ীরাই এখন হোম ডেলিভারির ব্যবসা করছে। আমরা মূল ব্যবসায়ীদের আটকের চেষ্টা করছি। তাদের আটক করে আইনের আওতায় আনতে পারলে হোম ডেলিভারির ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে।’ সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন।