খােলা বাজার২৪। শুক্রবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১৭: বাংলাদেশে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মোবাশ্বের হাসান নিখোঁজ হয়েছিলেন আজ থেকে ঠিক একমাস আগে। অর্থাৎ ৭ নভেম্বর রাজধানী ঢাকায়। গত একমাস ধরে হাসানের পরিবার ও শুভাকাঙ্খীরা পুলিশ এবং সরকারের কাছে তাকে খুঁজে বের করার দাবি করেছেন। কিন্তু তার বাবা মোতাহের হোসেন বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, পুলিশের কাছ থেকে কোনো ধরনের ইঙ্গিত তারা পায়নি। পুলিশও বলছে, তাদের তদন্তে এখনও বলার মতো অগ্রগতি হয়নি।
মোবাশ্বের হাসান নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষগতা করছিলেন গত এক বছর ধরে। গত ৭ নভেম্বর সকালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসও নিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শেষ করে বের হবার পর আইডিবি ভবনে একটি বৈঠকে অংশ নেয়ার কথা ছিল তার। এরই মধ্যে তিনি নিখোঁজ হোন। তার বাবা মোতাহের হোসেন বলেন, ছেলে নিখোঁজ হওয়ার একমাস পরও তারা কোনো খোঁজ পাচ্ছে না। কী কারণে এই নিখোঁজের ঘটনা ঘটতে পারে কারা তার ছেলেকে তুলে নিয়ে যেতে পারে এসব প্রশ্নের তিনি কোনো ধারণা না খুঁজে পাচ্ছে না।
মোতাহের হোসেন বলেন, এই ছেলেটা হাইপ্রোফাইল কোনো ছেলে না হয়তো কিছু লেখালেখি করে। এই লেখালেখিতে কোনো বিচ্যুতি হলেও হতে পারে কিন্তু সেটার জন্য তাকে এত নিমর্মভাবে এক কাপড়ে নিয়ে যাবে এটা চিন্তা করা আমার জন্য খুবই কষ্টকর। আসলে সঠিক কী কারণে কীভাবে এসব হয়েছে আমরা বুঝতেই পারছি না।
নিখোঁজ হওয়ার মাস দেড়েক আগে মোবাশ্বের দিল্লী ভিত্তিক একটা জানার্লে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। বাংলাদেশের ভেতর কীভাবে ইসলাম ও উগ্রবাদী সহিংসতা ছড়াচ্ছে সেটি তিনি তার প্রবন্ধে তুলে ধরেছিলেন। তার পিএইচ ডি থিসিসের বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামের প্রভাব নিয়ে। তার নিখোঁজ হওয়ার পেছনে এ ধরনের গবেষণা কোনো কারণ হতে পারে কী না সেটাও তার পরিবারকে ভাবাচ্ছে।
মোতাহের হোসেন আরও বলেন,তার ছেলে নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে তিনি পুলিশ ও র্যাবের কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু কোনো আশার কথা শুনতে পাচ্ছেন না। তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি কোনো ধারণা পাচ্ছেন না।
মোবাশ্বের হাসান নিখোঁজ হওয়ার একমাসে পরিবারটির জীবন-যাপনই ওলট পালট হয়ে গেছে। তার মা উম্মে কুলসুম আরা বেগম বলেন, একমাত্র সন্তানকে ছাড়া সবকিছুই তাদের অর্থহীন মনে হচ্ছে। সন্তানকে ফিরে পেতে তিনি বারবার আবেদন করছেন।
মোতাহের হোসেন বলেন, তার ছেলে কখনো কারো ক্ষতি করেনি। যদি কেউ কোনো কারণে ওকে রেখে থাকেন তাহলে মা হিসেবে আমার আকুল আবেদন আমার সন্তানটাকে ফেরত দিয়ে দেন। পুলিশও এই ঘটনা সম্পর্কে পরিষ্কার করে কিছু বলতে পারছে না। মোবাশ্বের হাসানের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা পুলিশের যে দলটি তদন্ত করছে সেই দলটির প্রধান ও খিঁলগাও থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মশিউর রহমান বলেন, তারাও এখনও কোনো সূত্র খুঁজে পাচ্ছে না। মোবাশ্বের হাসানকে যেদিন থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তারপর থেকেই আমরা খুব গুরুত্বের সাথে বিষয়টি তদন্ত করি। নিখোঁজের পুরো পরিবারের সাথে কথা বলি। ওনার বাসায় গিয়েও আমরা বিভিন্ন ফুটেজ নেই। কিন্তু বলার মতো কিছুই নেই, তবে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত তিন মাসে রাজনীতিক, সাংবাদিক ও ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার ১৪ জনের মতো নিখোঁজ হয়েছেন। এর মধ্যে চার জনের খোঁজ পাওয়া গেলেও বাকিদের কোনো তথ্যই পাওয়া যাচ্ছে না।
মোবাশ্বের হাসানের আগেও অনেক সাংবাদিক, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও শিক্ষক নিখোঁজ হয়েছেন। তাদের অনেকেই ফিরেছেন আবার অনেকেই ফেরেননি। সর্ব শেষ গত সোমবার নিখোঁজ হয়েছেন, সাবেক একজন রাষ্ট্রদূত, এম মারুফ জামান।
বিবিসি বাংলার সাক্ষাতকারে বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হকের কাছে প্রশ্ন ছিলো, যেভাবে নিখোঁজ হচ্ছে তা নিয়ে তারা কতটা উদ্বিগ্ন ও তার প্রতিকার নিয়ে কী ভাবছেন?
এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যখনি কোনো গুমের ঘটনা ঘটে তাৎক্ষণিক বিষটি আমলে নিয়ে তার জন্য পদক্ষেপ নেয়া হয়। এবং বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে জননিরাপত্তা বিভাগে জানানো হয়। এবং সেখানে বলা হয় প্রতিটি জনগণের জান মালের নিরাপত্তা দেবার বিষয়টি সরকারের।
তিনি বলেন, সরকারকে সংশ্লিষ্ট সংস্থা হিসেবে নিখোঁজ ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে হবে এবং তার পরিবারের কাছে ফেরত দিতে হবে। আর যারা গুমের সাথে জড়িত, তারা সরকারি, বেসরকারি বা যে কেউ হোক না কেন তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে।
তিনি আরো বলেন, মোবাশ্বের হোসেন গুম হবার খবর নভেম্বর মাসের ৯ তারিখে পাবার পরেই ঘটনা সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে।
মোবাশ্বের হোসেন গুম হয়েছেন প্রায় এক মাস হয়েছে, সে সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কী কিছু জানিয়েছেন?
জবাবে রিয়াজুল হক বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কোনো জবাব পাইনি। তবে জবাব না পেয়ে গত ৩ তারিখে আরেকটি রিমাইন্ডার দিয়েছেন বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, মারুফ হোসেনের ব্যাপারে আমলে নেয়া হয়েছে তবে বাইরে থেকে কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি।
গুম হবার বিষয়ে যে মানবাধিকার সংস্থা কাজ করছে সে বিষয়ে সরকার কী কান দিচ্ছে?
জবাবে রিয়াজুল হক বলেন, সরকার কান দিচ্ছে তা বলা যায় না তবে কয়েকটি ঘটনায় ঘটেছে তার মধ্যে ব্যবসায়ী ও বাংলাদেশে বেলারুশের অনারারি কনসাল অনিরুদ্ধ কুমার রায় নিখোঁজের পর তার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। সে বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ডিএ লেটারও লেখা হয়েছে বলেন তিনি। তার কিছু দিন পরে অনিরুদ্ধ রায় কিছু দিন পরেই ফিরেই এসেছেন, বলেন তিনি।
মানুষ দিনে দুপুরে নিখোঁজ হচ্ছে এবং পরিবারগুলো বলছে তারা দৌড়াদৌড়ি করে সবার কাছে যাচ্ছেন তবে কোনো সন্তোষজনক উত্তর পাচ্ছেন না। দিনের পর দিন সপ্তহের পর সপ্তাহ পার হয়ে যাচ্ছে এর চেয়ে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন কী হতে পারে? আর অনেকেই বলছে মানবাধিকার সংস্থায় গিয়ে কোনো লাভ নেই কিন্ত কেন?
এমন প্রশ্নের জবাবে রিয়াজুল হক বলেন, মানবাধিকার সংস্থার কাছে গিয়ে কোনো লাভ নেই তা অনেকেই হতাশা থেকে বলেন। তবে আমাদের কাছে আসলে আমাদের আইনী যতটুকু ক্ষমতা আছে তার ভেতর দিয়ে যতদূর সম্ভব করা হয়। এবং সরকারের কাছে তুলে ধরা হয়, বলেন তিনি।
রিয়াজুল হক আরো বলেন, আমাদের কাছে যারা এসেছে অভিযোগ নিয়ে তাদের অনেকেই ফিরে এসেছে আবার অনেকের কোনো খবরই নেই। এমন অনেকেই যারা নিখোঁজ হয়েছে প্রায় দু’বছর কারণ নিখোঁজ ব্যাক্তিকে খুজে বেড় করার মতো মেশিনারি পৃথিবীতে নেই।
নিখোঁজের ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব, আর মানবাধিকার কমিশনের দায়িত্ব হচ্ছে, নিখোঁজ ব্যক্তির খোঁজে মনিটরিং করা এবং সরকারে ওপরে চাপ সৃষ্টি করা। নিখোঁজের ব্যাপারটি থামানোর কাজটি কোনো মানবাধিকার কমিশনারের নেই বলেন রিয়াজুল হক।