Thu. Mar 13th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

খােলা বাজার২৪। বৃহস্পতিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৭:  নিউইয়র্কে যখন ভোর পাঁচটা বাজে, বাংলাদেশে তখন বিকাল চারটা। প্রতিদিনের মতো আকায়েদের কাছে যোগাযোগের অ্যাপস ইমোর মাধ্যমে ফোন করেছেন স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস জুঁই। ঘুম থেকে তুলে দিয়েছেন আকায়েদকে। তখন আকায়েদ তাকে (স্ত্রীকে) রেডি হয়ে কাজে যাচ্ছে জানিয়ে ফোন রেখে দেয়। কিন্তু এই কথাই যে স্বামীর কাছ থেকে আপাতত শেষ কথা হবে,তা ঘুনাক্ষরেও ভাবেননি জুঁই। এমনকি জুঁইয়ের কল্পনাতেও ছিল না কয়েক ঘণ্টা পর তার জন্য এমন একটি খবর অপেক্ষা করছে, যেটি শুধু তাকেই না, বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের মানুষকে হতভম্ব করে দেবে। জঙ্গিবাদে জড়িয়ে নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনের বাস টার্মিনালে আকায়েদের আত্মঘাতী হামলার চেষ্টা, এমন একটি খবর কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছে না স্ত্রী ও স্বজনেরা।

ঢাকার জিগাতলার ১০/১ মনেশ্বর রোডের বাসাটি এখন স্থানীয়দের কাছে একনামে পরিচিত। সোমবারের (১১ ডিসেম্বর) ঘটনার একদিন পর মঙ্গলবার বিকালে ওই বাড়ি থেকে আকায়েদের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস জুঁই, শ্বশুর জুলফিকার হায়দার ও শাশুড়ি মাহফুজা আক্তার হীরাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিজেদের কার্যালয়ে নিয়ে যায় কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। এরপর থেকেই ওই বাড়িটির সামনে উৎসুক মানুষ আর দেশি-বিদেশি সংবাদকর্মীদের ভিড় লেগেই আছে। মঙ্গলবার রাতেই তাদের ছেড়ে দেওয়া হলেও আকায়েদের কর্মকাণ্ডে হতভম্ব এই পরিবারটি এখন বলতে গেলে অবরুদ্ধ জীবন-যাপন করছে।

বুধবার (১৩ ডিসেম্বর) দুপুরে আকায়েদের স্ত্রী জুঁইয়ের কাছে তার স্বামী সম্পর্কে জানার চেষ্টা করা হলে প্রথম দিকে কোনও কথা বলতেই রাজি হননি তারা। বারবার চেষ্টা করার পরও দরজা খুলতে চাননি। পরে অবশ্য এই প্রতিবেদকের সঙ্গে মিনিট দশেক কথা বলেন আকায়েদের স্ত্রী জুঁই ও শাশুড়ি মাহফুজা আক্তার। তাদের ভাষ্য, আকায়েদ এ ধরনের কোনও কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হতেই পারে না। তাকে ষড়যন্ত্র করে ফাঁসানো হয়েছে বলে মনে করছেন তারা।

সোমবারের সেই ঘটনার আগে আকায়েদের সঙ্গে স্ত্রী জুঁইয়ের কী কথা হয়েছিল? ছয় মাস বয়সী শিশু সন্তানের মা জান্নাতুল ফেরদৌস জুঁই বলেন,‘‘আমি সকালে ফোন করেছিলাম। প্রতিদিনের মতো তাকে কাজে যাওয়ার জন্য ঘুম থেকে উঠিয়ে দেই। তারপর সে ওঠে। বলে যে ‘রেডি হইতেছি, কাজে যাবো ইনশাল্লাহ’। এটা বলে উঠে যায়, তারপর রেডি হয়ে চলে যায়।’’

জুঁই বলেন, ‘‘এমনি সবসময় যেরকম কথা হয় সেরকম কথাই হয়েছে। স্পেশাল কোনও কথা হয়নি। শুধু ‘রেডি হইতেছি’ বলে ফোনটা রাখে। আমি কোনও কিছু টেরও পাইনি। আমার মনে হয় না সে এরকম কিছু করতে পারে। সে ধার্মিক ছিল। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো। কিন্তু জঙ্গি হয়ে হামলা করবে এমনটা আমার বিশ্বাস হয় না।’

বিয়ের আগে আকায়েদের স্ত্রী জুঁই যেমন সাধারণ চলাফেরা করতেন, বিয়ের পর তেমনটা আর করেন না। স্বামী আকায়েদের ইচ্ছাতেই হিজাব পড়ে চলাফেরা করেন। নামাজ-রোজাও করেন নিয়মিত। জুঁই বলছেন, ‘আমাকে সবসময় নামাজ-রোজা করতে বলতো। ঠিকমতো চলাফেরা করতে বলতো। এটাই। আমরা আগে যেমন নামাজ পড়তাম। সেরকম করেই পড়তে বলতো। কোনও বিষয়ে ফোর্স করেনি।’

মেয়ের এই কথায় সায় দেন মা মাহফুজা আক্তার হীরা। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে আগে নামাজ পড়তো। তবে এত বেশি বোরকা-টোরকা পড়তো না। ওর বান্ধবী হেলেন (আকায়েদের বোন) আমেরিকা থেকে বোরকা পাঠাইছিল তখন পড়ছে। বিয়ের দিন থেকে বোরকা পড়া শুরু করেছে। এখন তো বাংলাদেশের সবাই বোরকা পড়ে। আমরা ধার্মিক। এতটুকুই। এর বেশি কিছু না।’

আকায়েদের শাশুড়ি হীরা আরও বলেন, ‘আমার জামাই অনেক নম্র ও ভদ্র একটা ছেলে। সে সব সময় মাটির দিকে তাকিয়ে চলাফেরা করতো। সে এমন একটা কাজ করতে পারে, তা বিশ্বাস হচ্ছে না। এটা ষড়যন্ত্র করে করা হয়েছে। তাকে ফাঁসানো হয়েছে। আমাদের পরিবারটা একেবারে ধ্বংস করে দেওয়া হলো।’

২০১১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সপরিবারে ইমিগ্র্যান্ট হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাওয়া আকায়েদের পরিবার দীর্ঘ প্রায় এক যুগ ছিল জিগাতলার ৪৮/৩ নম্বর ঊষা হাউসের নিচতলা ও তৃতীয় তলায়। আকায়েদের বাবা সানাউল্লাহ মিয়া পাশের হাজারীবাগ বাজারে একটি মুদি দোকান চালাতেন। আকায়েদদের তিন ভাইকে তারা চিনতো অপু-সপু-অর্ণব নামে। দুই বোন হেলেন ও আইফাকেও চিনতো বাড়ির মালিকের স্ত্রী ষাটোর্ধ্ব ফিরোজা বেগম। তিনি বলেন, ‘সানাউল্লাহর দুই সন্তান আমার বাড়িতেই জন্ম হইছে। তারা গরীব ছিল। সানাউল্লার বড় ছেলেকে ছোট থাকতেই তার মামা আমেরিকা নিয়া যায়। সেই ছেলেই সবাইরে নিয়ে গেছে। ওরা তো ভালো ছিল। ছেলে-মেয়েগুলোও ভালো ছিল। দেশে থাকতে তো কোনও খারাপ কিছু কোনোদিন শুনি নাই।’

ফিরোজা বেগমের পূত্রবধূ শাহানআরাও ভালো করে চিনতেন আকায়েদের পুরো পরিবারকে। তিনি বলেন, ‘আকায়েদ ছোটবেলায় কিছুটা দুষ্ট ছিল। খেলাধূলা আর ছোটাছুটি করে বেড়াতো। ভালো ছিল। কিন্তু কোনও বদনাম ছিল না ওদের। এই ছেলে কিভাবে এত বড় ঘটনা ঘটালো?’ বিস্ময়ের সঙ্গে উল্টো প্রশ্ন করেন তিনি।

বুধবার (১৩ ডিসেম্বর) ওয়াজেদুর রহমান নামে আকায়েদের স্কুল এবং কলেজ জীবনের এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলেছে ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। তার কাছে জানতে চেয়েছিল ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার আগে কেমন ছিল আকায়েদ? ওয়াজেদুরের বরাত দিয়ে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলছেন, ওয়াজেদুরের ভাষায়, স্কুল-কলেজে তারা ‘উরাধুরা’ সময় পার করেছে। ফলে কর্মকর্তারা মনে করছেন, ঢাকায় অবস্থানের সময় তার মধ্যে ধর্মীয় জঙ্গিবাদে ঝুঁকে যাওয়ার কোনও প্রমাণই তারা পাননি।

আকায়েদ উল্লাহ (আগের ছবি)ওয়াজেদুর বলেছে, ২০১১ সালে আকায়েদ চলে যাওয়ার সময় তাকে বিদায় জানায়। তারপর থেকে যোগাযোগ কম হলেও ২০১৬ সালে যখন সে দেশে এসে জুঁইয়ের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তখন তাকে একেবারে অন্যরকম লেগেছে। ওয়াজেদুরের ভাষায়, ‘মুখভর্তি দাঁড়ি, ইন্ট্রোভার্ট, অনেক বেশি ধার্মিক।’ ফলে আগের মতো আড্ডাবাজি আর জমেনি বলে সিটিটিসির কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন ওয়াজেদুর। তার সঙ্গে আকায়েদের শ্যালক হাফিজ মাহমুদ জয়কেও ডেকে নিয়ে কথা বলেন সিটিটিসির কর্মকর্তারা। জয়ও পুলিশ কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন, আকায়েদ তাকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার কথা বলতো। কিন্তু জঙ্গিবাদে উদ্ভুদ্ধ হওয়ার বিষয়ে কখনও তাকে কিছু বলেনি। মঙ্গলবার (১২ ডিসেম্বর) এই প্রতিবেদককেও একই কথা বলেছিলেন তিনি।

ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, ‘আমাদের এখানে আকায়েদের টেরোরিস্ট অ্যাক্টিভিটিজ বা কোনও ক্রিমিনাল রেকর্ডস নেই। আমরা তার স্ত্রী ও স্বজনের সঙ্গে কথা বলে যতদূর বুঝতে পেরেছি, সে হয়তো যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েই ইন্টারনেটের মাধ্যমে র‌্যাডিক্যালাইজড হয়েছে। অর্থাৎ সেল্ফ র‌্যাডিক্যালাইজড। এখানে এসে যাদের সঙ্গে মিশতো তাদের বিষয়েও আমরা তথ্য পেয়েছি। কিন্তু এখানে তার কোনও অ্যাসোসিয়েটস র‌্যাডিক্যালাইজড আছে- এমন কোনও তথ্য আমাদের কাছে নেই।’

গত বছরের জানুয়ারি থেকে এপর্যন্ত তিন বার দেশে এসেছিলেন আকায়েদ উল্লাহ, বাংলাদেশি পাসপোর্টের তথ্য অনুযায়ী তার জন্ম ১৯৯০ সালের ২৫ মার্চ।২০১৬ সালে দেশে এসে ১০ জানুয়ারি বিয়ে করে জুঁইকে। মার্চে চলে গেলেও ওই বছরেরই সেপ্টেম্বরে সে আবার আসে দেশে। এসময় প্রায় সাড়ে চার মাস দেশে অবস্থান করার পর চলতি বছরের জানুয়ারিতে ফিরে যায়। সর্বশেষ দেশে আসে গেলো ৮ সেপ্টেম্বর। দেড় মাস থেকে ফিরে যায় ২২ অক্টোবর। কিন্তু দেশে এসে কাদের সঙ্গে মিশতো আকায়েদ? আর কোথায় যাতায়াত ছিল তার? পরিবারের সদস্যরা বলছে, মাঝের সময়টাতে একবার সে নিজের গ্রামের বাড়ি সন্দ্বীপে গিয়েছিল। আর সর্বশেষ সেপ্টেম্বরে আসার পর সে গিয়েছিল কক্সবাজারে,রোহিঙ্গাদের অর্থ সহযোগিতা করতে।

কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলছেন, তারাও আকায়েদের কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যাওয়ার তথ্য পেয়েছেন। ১৫ সেপ্টেম্বর সেখানে গিয়ে একদিন পরই ফিরে আসে সে।

সিটিটিসির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আকায়েদ ঢাকায় এসে যে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতো তা তারা ঘেঁটে দেখেছেন। কিন্তু তাতে এমন কিছু পাওয়া যায়নি, যাতে কোনও বিষয়ে সন্দেহ হতে পারে। তারপরেও তার সহযোগী কেউ এদেশে রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখছেন তারা।

উল্লেখ্য, গত ১১ ডিসেম্বর সকালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ারের কাছে পোর্ট অথরিটি বাস টার্মিনালে বিস্ফোরণ ঘটে। এর সঙ্গে আকায়েদ উল্লাহ নামে এক বাংলাদেশি যুবকের সংশ্লিষ্টতা পায় নিউইয়র্ক পুলিশ। হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার পর তার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে সন্ত্রাসবাদের তিনটি ধারায় অভিযোগ এনেছে নিউইয়র্কের পুলিশ।

আকায়েদের বাড়ি বাংলাদেশের চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে। তবে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকার হাজারীবাগে। আকায়েদ স্থায়ী মার্কিন নাগরিক হিসেবে নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে বসবাস করতো। প্রথমে ড্রাইভিংয়ের কাজ করলেও সম্প্রতি সে ভাইয়ের একটি ইলেকট্রনিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করতো। বাংলাট্রিবিউন