খােলা বাজার২৪। রবিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৭: অজ্ঞাত কারণে আটকে আছে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের অর্থায়ন। গত বছরের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরকালে এ-সংক্রান্ত চুক্তি সইয়ের সম্ভাবনা তৈরি হলেও শেষ পর্যন্ত তা আটকে যায়। বাংলাদেশে রেলওয়ে ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের পক্ষ থেকে অনেক দেন দরবার করা হলেও কোনো এক অজ্ঞাত কারণে অর্থায়ন এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। গত মাসে প্রকল্প এলাকায় সরেজমিন পরিদর্শনে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডের (ইআরইসি) ১৫ সদস্যের একটি দল ঢাকায় আসে। এ ছাড়া গত মাসে চীনা এক্সিম ব্যাংকের শর্ত অনুযায়ী কাটছাঁট করে অর্থায়নের জন্য ফিন্যান্সিয়াল প্রজেক্ট পেপার জমা দেয়া হয়। এ বিষয়ে ৩১৫ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণচুক্তির জন্য সম্মত হয় এক্সিম ব্যাংক, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ২৫ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা। অনেক কথাবার্তার পর তারা এই ডিসেম্বরে ঋণচুক্তি বাস্তবায়নে সম্মত হয়। কিন্তু ঋণচুক্তি এখন অথৈ জলে। চীনের অর্থায়ন শেষ পর্যন্ত মিলবে কিনা, তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছে রেলওয়ে।
শর্ত মোতাবেক মোট প্রকল্প ব্যায়ের অর্থাৎ ৩৫ হাজার কোটি টাকার ৮৫ শতাংশ অর্থাৎ ৩ বিলিয়ন ডলার (২৫ হাজার ৯৮৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা) ৫ কিস্তিতে দেবে এক্সিম ব্যাংক। ২০১৭ সালে এ প্রকল্পে ৮০ কোটি ডলার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু অর্থ না পাওয়ায় কোনো কাজই এগোয়নি। শুধুমাত্র জমি অধিগ্রহণ এখন শেষ পর্যায়ে, কাজেই অলস সময় পার করছেন প্রকল্পটির পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টরা। ইতোমধ্যে প্রকল্পের জন্য কনসালটেন্টও নিয়োগ দেয়া হয়েছে। মূলত, টাকা ছাড়ের আশায় বসেই রয়েছেন সবাই। এ জন্য দ্রুত ঋণচুক্তি সম্পন্ন করতে জোর তৎপরতা চালায় রেলপথ মন্ত্রণালয়। গত ফেব্রুয়ারিতে চীনে প্রতিনিধিদল পাঠায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। এ ছাড়া চীনের রাষ্ট্রদূতকে চিঠি দেন রেলপথমন্ত্রী। সর্বশেষ, চীনের পক্ষ থেকে ৮৫ শতাংশ ঋণ সহায়তার আশ্বাস দিলেও তা এখনো চূড়ান্ত করেনি দেশটি। তাই পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্প এখনো অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে বলে রেলওয়ে সূত্র জানায়।
এ বিষয়ে পদ্মা লিংক রেল প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার গোলাম ফকরুদ্দীন এ চৌধুরী গত মঙ্গলবার বলেন, আমরা পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগের জন্য চীনা সরকারের কাছে প্রকল্পের জন্য পুরো অর্থ অর্থাৎ ৩৫ হাজার কোটি টাকা চেয়েছিলাম। কিন্তু চীনা সরকার ও এক্সিম ব্যাংক এ নিয়ে কিছু দর কষাকষি করে। পরে প্রকল্পের খরচের ৮৫ শতাংশ অর্থাৎ তিন বিলিয়ন ডলার যা বাংলাদেশি টাকায় ২৫ হাজার ৯৮৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা দিতে তারা রাজি হয়েছে। এ বিষয়ে আমরা সেখানে গিয়েছি। তারাও প্রকল্প কর্মকাণ্ড বিষয়ে সরেজমিন পরিদর্শন করেছে। এরপরও গত নভেম্বরে এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে আমাদের কথা হয়, তারা এ পরিমাণ অর্থ দিতে নীতিগতভাবে সম্মত হয়। কিন্তু কোনো বড় ঋণচুক্তিতে কিছু ধাপ থাকে। কিছু পদক্ষেপ পার করতে হয়। এক্সিম ব্যাংকের এ চুক্তির শর্তাবলিসহ বিষয়টি তাদের মন্ত্রণালয়ে (কেবিনেটে) যাবে। পরে এটি রাষ্ট্রপতি অনুমোদন দেবেন। এসব কাজ করতে কিছু সময় প্রয়োজন। তবে যেহেতু চীনা রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশে এসে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন এবং এটি আগে থেকেই আলাপ-আলোচনা করে চুক্তি হয়েছে। তা ছাড়া প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে চীনা সরকারের অনুমতিক্রমে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড। তাই মোটামুটি সব কিছু প্রস্তুত রয়েছে, খুব দ্রুত চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হবে বলে আশা করি।
এদিকে গত নভেম্বরের শেষ ভাগে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব কাজী শফিকুল আযম বলেছিলেন, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ স্থাপনে চীনের সঙ্গে ৩১৫ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণচুক্তি হচ্ছে ডিসেম্বরে। এ চিন্তাকে সামনে রেখে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (বার্ষিক) সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। শফিকুল আযম বর্তমানে বিদেশ ভ্রমণে থাকায় তার মন্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
তবে ইআরডির চীনা ডেক্সের উপসচিব এ কে এম মতিউর রহমান বলেন, আমরা ঋণচুক্তির সব রকমের কাগজপত্র পাঠিয়েছি। আমরা চীনেও গিয়েছি। সেখানে এবং দেশে বসে আমরা এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করে সব বিষয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে আছি। আমরা ৩ বিলিয়ন ইউএস ডলার চেয়েছি। এক্সিম ব্যাংক দিতে সম্মত হয়েছে। তবে কিছু পদ্ধতিগত বিষয় রয়েছে। এগুলো দ্রুত কেটে যাবে এবং আমরা দ্রুত চুক্তি সম্পন্ন করে অর্থ ছাড় পাব বলে আশা করছি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন জানান, পদ্মা সেতু রেল সংযোগে অর্থায়নের জন্য চীন আমাদের প্রতিশ্রæতি দেয় আগেই। এবার সে দেশের এক্সিম ব্যাংক অর্থায়নের জন্য বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করে সম্মত হয়েছে। তারা যেসব ডকুমেন্ট চেয়েছিল আমরা তা সরবরাহ করার পর এবং বেশ কয়েকবার তাদের সঙ্গে মিটিং করার পর তারা অর্থ দেবে বলে জানিয়েছে। এ-সংক্রান্ত ঋণচুক্তির খসড়াও পাঠায় এক্সিম ব্যাংক। চলতি ডিসেম্বরে তাদের সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শুনছি বড় অঙ্কের ঋণ হওয়ায় এটি অনুমোদনের জন্য কয়েক ধাপে আলোচনা ও অনুমোদন প্রয়োজন। ঋণ দাতা এক্সিম ব্যাংক অর্থ দিতে সম্মত রয়েছে, এখন শুধু চীনা রাষ্ট্রপতির অনুমোদন প্রয়োজন। তবে চুক্তিটি খুব দ্রুত বাস্তবায়ন হবে বলে জানান তিনি।
এ নিয়ে রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক বলেন, প্রতিশ্রতি অনুযায়ী চীন আমাদের পদ্মা সেতু রেল সংযোগে অর্থায়নে রাজি হয়েছে। সে দেশের এক্সিম ব্যাংক আমাদের প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ হিসেবে দিচ্ছে। এ নিয়ে ইআরডি সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। দ্রুত চূড়ান্ত চুক্তি হবে। এ বছরের মধ্যে অর্থায়ন হবে বলে জানান রেলমন্ত্রী।
এত বড় অঙ্কের অর্থায়ন, পদ্মা সেতু দিয়ে কতগুলো রেল চলবে? এমন প্রশ্নের জবাবে রেলমন্ত্রী বলেন, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। আমরা দেশের সব জেলাকে রেল নেটওয়ার্কের মধ্যে আনতে চাই। তাই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গে রাজধানী তথা সারা দেশের সংযোগ স্থাপন ও ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারে পদ্মা সেতু খুবই কার্যকরী হবে। দূরত্ব ও সময় কমে আসবে।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ৩ মে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন করা হয় পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পটি। এতে ব্যয় ধরা হয় ৩৪ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা। শুরুতে এ প্রকল্পে শতভাগ অর্থায়নে সম্মত হলেও পরে চীনের এক্সিম ব্যাংক ২৪ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা ঋণ দিতে সম্মত হয়।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, এ প্রকল্পের আওতায় প্রধান কার্যক্রম হচ্ছে ১৬৯ কিলোমিটার মেইন লাইন নির্মাণ, ৪৩ দশমিক ২২ কিলোমিটার লুপ ও সাইডিং, তিন কিলোমিটার ডাবলসহ মোট ২১৫ দশমিক ২২ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেল ট্র্যাক নির্মাণ, ২৩ দশমিক ৩৭ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট, এক দশমিক ৯৮ কিলোমিটার র্যাম্পস, ৬৬টি বড় সেতু, ২৪৪টি ছোট সেতু ও কালভার্ট, একটি হাইওয়ে ওভারপাস, ২৯টি লেভেল ক্রসিং, ৪০টি আন্ডারপাস, ১৪টি নতুন স্টেশন ভবন নির্মাণ, ছয়টি বিদ্যমান স্টেশনের উন্নয়ন ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ, ২০টি স্টেশনে টেলিযোগাযোগসহ কম্পিউটারভিত্তিক রেলওয়ে ইন্টারলক সিস্টেম সিগন্যালিং ব্যবস্থা, ১০০টি ব্রডগেজ যাত্রীবাহী গাড়ি সংগ্রহ ইত্যাদি। তবে এক হাজার ৭০০ একর ভূমি অধিগ্রহণসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম চালু রয়েছে। অর্থের অভাবে মাটি ভরাট, রেললাইন বসানো, ব্রিজ-কালভার্ট তৈরিসহ মূল কাজই এখনো শুরু করতে পারেনি বাংলাদেশ রেলওয়ে।ভোরেরকাগজ থেকে নেয়া।