খােলা বাজার২৪। মঙ্গলবার , ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৭: মূল নকশা আসলেই শুরম্ন হবে সেটা বাস্ত্মবায়নের কাজ। সরিয়ে ফেলা হবে নকশাবহির্ভূত সব স্থাপনা। কিন্তু কিছুই হয়নি। বরং কাঠখড় পুড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া ইউনিভার্সিটির আর্কাইভ থেকে সংগ্রহ করা জাতীয় সংসদের ‘মূল নকশা’ বাস্ত্মবায়ন নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। নকশা আনার এক বছর পরও অনুসন্ধান আর পর্যালোচনায় বাক্সবন্দি হয়ে আছে সব ‘পরিকল্পনা’। কাজ এগোয়নি সিকিভাগও।
সংশিস্নষ্টরা জানিয়েছেন, নকশা পর্যালোচনা কাজ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। প্রধানমন্ত্রীকে এগুলো দেখাতে সংসদ সচিবালয় প্রস্তুত রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীকে সময় পেলেই নকশাগুলো দেখানো হবে। তবে নকশা অনুযায়ী বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানসহ অন্যদের কবর সরবে কি-না তা একমাত্র সরকারি সিদ্ধান্ত্মের ওপর নির্ভর করছে। কিন্তু রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে এটুকু অনুমেয় যে, সরকার এখন এমন কোনো সিদ্ধান্ত্ম নেবে না; যাতে রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়ায় বা একাদশ সংসদ নির্বাচনের হওয়ায় আগে রাজনীতির মাঠ গরম হয়। আর প্রতিপক্ষকে এ ‘ইসু্য’টি নির্বাচনে কাজে লাগাতে পারে। সব মিলিয়ে লুই আই কানের ‘মূল নকশা’ বাস্ত্মবায়নের নেই কোনো অগ্রগতি।
এ ব্যাপারে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন জানান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে লুই আই কান প্রণীত জাতীয় সংসদ ভবনের মূল নকশায় কোনো কবর ছিল না। এ নকশা যারা পরিবর্তন করেছে তাদের অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে।
তিনি বলেন, সরকারি নির্দেশনায় বিভিন্ন সময়ে সংসদ ভবন চত্বরে কবর গড়ে তোলা হয়েছে। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় লুই আই কানের সব নকশা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা হয়েছে। এখন এ নকশা বাস্ত্মবায়ন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
উলেস্নখ্য, গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী গত ১৬ নভেম্বর জানিয়েছিলেন, লুই কানের জাতীয় সংসদের মূল নকশা এলেই সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে। সংসদ লুই কানের মূল নকশায় ফিরে যাবে।
তথ্যমতে, সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রম্নয়ারি লুই আই কানের মূল নকশা সংগ্রহের নির্দেশ দেন সংসদ সচিবালয়কে। ২০১৫ সালের ১৩ অক্টোবর একনেক বৈঠকেও এ নকশা আনার নির্দেশনা দেন তিনি। এরপর গত বছর ১ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে সংরক্ষণে রাখা ওই নকশা আর্থিক চাহিদা মিটিয়ে দেশে আনা হয়। কথা ছিল প্রধানমন্ত্রী নকশাগুলো দেখে অনুমোদন দিলেই; ‘মূল নকশা’ অনুযায়ী আগারগাঁও এলাকার পরিকল্পনা বাস্ত্মবায়ন করা হবে।
জানা গেছে, গত বছরের ১ ডিসেম্বর ৪১টি বাক্স করে জাতীয় সংসদ ভবনের মূল নকশা নিয়ে আসা হয় ঢাকায়। যুক্তরাষ্ট্রে সংরক্ষিত ৮ হাজার নকশার মধ্যে খুঁজে খুঁজে সংসদের সঙ্গে সংশিস্নষ্ট ৮৩৫টি নকশা এবং ৫৬টি ডকুমেন্ট দেশে আনে। প্রতিটি নকশার সংগ্রহে খরচ হয় ১৯ ডলার অর্থাৎ ১ হাজার ৫৮৭ টাকা ৭৩ পয়সা। নকশা সংগ্রহের পর সংসদ সচিবালয়ের সিদ্ধান্ত্ম ছিল সবগুলো নকশা বাছাই করে চারটি সেট আলাদা করে; চার প্রতিষ্ঠানের কাছে থাকবে। এর মধ্যে এক সেট সংসদ সচিবালয়ে সংরক্ষিত থাকবে। একটি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে যাবে। আর এক সেট জাতীয় আর্কাইভে রাখা হবে। আরেকটি সেট থাকবে সংসদের আর্কাইভে।
এ বিষয়ে জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ বলেন, নকশা সংসদ সচিবালয় এনেছে। পর্যালোচনার কাজও শেষ। এখন নকশা প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্ত্মান্ত্মর করবেন। এরপর সরকার সিদ্ধান্ত্ম বাস্ত্মবায়ন করবে।
তথ্যমতে, সংসদ ভবনের নির্মাণকাজ শুরম্ন হয় ১৯৬১ সালে, অর্থাৎ পাকিস্ত্মান আমলে। স্থপতি মাযহারম্নল ইসলামকে সংসদ ভবনের নকশার দায়িত্ব দেয়া হলেও তার প্রস্ত্মাবে লুই কান প্রধান স্থপতি হিসেবে কাজ করেন। আর আনুষ্ঠানিকভাবে সংসদ ভবনের উদ্বোধন করা হয় ১৯৮২ সালে ২৮ জানুয়ারি। সামনে ও পেছনে বিস্ত্মীর্ণ সবুজ খোলা মাঠসহ ২০৮ একর জমির ওপর জাতীয় সংসদ ভবন লুই কানের নকশার প্রথম ধাপ। এর চারদিকে আট লেনের সড়ক, মাঝখানে লেক। দ্বিতীয় ধাপে লেকের পর বিস্ত্মীর্ণ সবুজ চত্বর। এ ছাড়া বাকি জায়গায় গড়ে তোলার কথা সচিবালয়, লাইব্রেরি, জাদুঘর, হাসপাতালসহ প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক বলয়।
কিন্তু সংসদ ভবন এলাকায় লুইকানের নকশার বাইরেও কিছু স্থাপনা গড়ে উঠে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে তখনকার রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার দুই দিন পর তার কবর সেখানে প্রতিস্থাপন করা হয়। ক্রিসেন্ট লেকে ঝুলন্ত্ম ব্রিজ নির্মাণ করা হয়। আর চন্দ্রিমা উদ্যানের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় জিয়া উদ্যান। একইভাবে ওই এলাকায় এরই মধ্যে ১০ একর জমিতে বঙ্গবন্ধু আন্ত্মর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত্ম সংসদ ভবন এলাকায় আরও সাতজনকে সমাহিত করা হয়। তাদের মধ্যে স্বাধীনতাবিরোধী শাহ আজিজুর রহমান, খান এ সবুর ও মশিউর রহমান জাদু মিয়ার কবরও রয়েছে। এ ছাড়া নকশা লঙ্ঘন করে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবনসহ আরও সাতটি স্থাপনা ও বাসভবন নির্মাণ করা হয়েছে সংসদ ভবন এলাকায়।
এ পরিবর্তন সম্পর্কে তখন বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, মূল নকশায় পরিবর্তনের কারণে ভবনের স্থাপত্য সৌন্দর্য, ঐতিহ্য ও আন্ত্মর্জাতিক মান ক্ষুণ্ন হয়েছে। বিষয়টি সংসদ ভবনের আন্ত্মর্জাতিক স্থাপনা হিসেবে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেন্টারের স্বীকৃতি পেতে বাধার সৃষ্টি করবে।
বঙ্গবন্ধু আন্ত্মর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র ও পস্নানিং কমিশন নকশায় আছে কি-না এমন প্রশ্নের উত্তরে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের কাছে একটা নকশা আছে। বঙ্গবন্ধু আন্ত্মর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র লুই কানের নকশার মধ্যে আছে এবং পস্নানিং কমিশন যেটা আছে সেটাও লুই কানের নকশার মধ্যে আছে।