খােলা বাজার২৪।বৃহস্পতিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৭: বাংলাদেশ ব্যাংকের চুরি যাওয়া রিজার্ভের অর্থ ফেরত দিতে গড়িমসি করায় ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) ওপর চটেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি মনে করেন, যে ব্যাংক চুরির অর্থ নিয়ে ব্যবসা করে তার ব্যাংকিং জগতে থাকার অধিকার নেই। বরং তাকে তালাবদ্ধ করে এ ব্যবসা থেকে বিদায় করা উচিত। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের কাছে লেখা এক চিঠিতে এমন মন্তব্য করেন অর্থমন্ত্রী। একই সঙ্গে ফিলিপাইনের এই দুর্বৃত্ত ব্যাংক থেকে অর্থ উদ্ধারে মামলা-মোকদ্দমা যা যা করা দরকার সেটা করার জন্যও চিঠিতে নির্দেশ দেন তিনি।
২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমসের (ফেড) নিউইয়র্ক শাখা থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। নজিরবিহীন এ চুরির ঘটনার প্রায় ২৩ মাস পার হতে চললেও সিংহভাগ অর্থই উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) মহাব্যবস্থাপক দেবপ্রসাদ দেবনাথ আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, মামলায় তো যেতেই হবে। তবে মামলা করার আগে অনেক কিছু চিন্তা করতে হয়। এক্ষেত্রে লাভ-লোকসানের বিষয়টি জড়িত। এ জন্য বিশেষজ্ঞদের মতামতও নেয়া হবে। মোটকথা, পুরো অর্থ ফেরত পাওয়ার জন্য যা যা করা দরকার সেটিই করা হবে। সরকার থেকে এরকমই দিকনির্দেশনা রয়েছে।
জানা গেছে, ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুরক্ষিত সুইফট সিস্টেমে প্রবেশ করে ১০০ কোটি ডলার পরিশোধের জন্য মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম অব নিউইয়র্কে ৩৫টি নির্দেশ পাঠানো হয়। ৩০টি পরিশোধ নির্দেশ আটকে দিলেও পাঁচটি নির্দেশ কার্যকর করে ফেড নিউইয়র্ক। ওই পাঁচটি নির্দেশের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কায় ২ কোটি ডলার ও ফিলিপাইনে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চলে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ফিলিপাইনে যাওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের মধ্যে এখন পর্যন্ত ফেরত পাওয়া গেছে মাত্র দেড় কোটি ডলার। এছাড়া ২ কোটি ৯০ লাখ ডলারের সন্ধান পাওয়া গেছে। সন্ধান পাওয়া বাকি অর্থ ফেরতের বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন। তবে অবশিষ্ট ৩ কোটি ৭০ লাখ ডলারের কোনো হদিস নেই। তবে শ্রীলঙ্কায় যাওয়া ২ কোটি ডলার আটকানো সম্ভব হওয়ায় ওই সময়ই ফেরত পাওয়া গেছে।
গভর্নরকে লেখা চিঠিতে অর্থমন্ত্রী বলেন, ব্যাংকিং ব্যবস্থার ভিত্তি হলো বিশ্বাস। ফিলিপাইনের আরসিবিসি শুরু থেকেই সেই বিশ্বাসের অনুপযুক্ত। তাদের ব্যাংকে চুরি করা অর্থ জমা হয়েছে। তারা সেই অর্থ ফেরত দিতে গড়িমসি করছে। এটি প্রমাণিত যে, অর্থের উৎস হচ্ছে বাংলাদেশ। কতিপয় দুষ্কৃতকারী এ অর্থ পাচার করেছে। চুরির অর্থ নিয়ে যে ব্যাংক ব্যবসা করে, সে ব্যাংক ব্যাংকিং জগতে থাকতে পারে না। তাকে তালাবদ্ধ করে তার পরিচালক ব্যবস্থাপকদের চিরতরে এ ব্যবসা থেকে বিদায় করা বিশ্ব ব্যাংকিং ব্যবস্থার দায়িত্ব। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ফিলিপাইনের এ দুর্বৃত্ত ব্যাংক থেকে টাকা উদ্ধারের জন্য মামলা মোকদ্দমা যা যা করা দরকার সেটা করা উচিত। এ বিষয়ে নিউইয়র্ক ফেডের সাহায্য নিশ্চিত করা দরকার। একই সঙ্গে ফিলিপাইন সরকারের দায়িত্ব নির্দিষ্ট করা ও পাচার করা অর্থ উদ্ধারের প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ প্রদানও আমাদের কর্তব্য। এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের যা কিছু করা দরকার সেসব পদক্ষেপ নেয়া হোক।
এদিকে ৮ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, গেল মাসে এক কনফারেন্স কলে আরসিবিসির বিরুদ্ধে মামলা করার পরিকল্পনা নিয়ে নিউইয়র্ক ফেডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে বাংলাদেশ, যেখানে ব্যাংকিং লেনদেনের আন্তর্জাতিক মেসেজিং নেটওয়ার্ক সুইফটের দুই প্রতিনিধিও ছিলেন। চুরি যাওয়া টাকা উদ্ধারের জন্য আগামী মার্চ-এপ্রিল নাগাদ নিউইয়র্কে একটি দেওয়ানি মামলা করার প্রাথমিক পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। ২০১৮ সালের মার্চ-এপ্রিলের দিকে আরসিবিসির বিরুদ্ধে নিউইয়র্কে মামলা দায়েরের লক্ষ্য রয়েছে। বাংলাদেশ আশা করছে, ফেডারেল রিজার্ভ ও সুইফট কর্তৃপক্ষও সেখানে বাদী হবে।
এর পরদিন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এক অনুষ্ঠানে জানান, ‘টাকা উদ্ধারের ব্যাপারে এর আগে ফিলিপাইন সরকারের সঙ্গে একাধিকবার আলোচনা হয়েছে। তাদের পক্ষ থেকে আমাদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা এখন গড়িমসি করছে। এ কারণে মামলার কথা ভাবছি। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। রিজাল ব্যাংককে পৃথিবী থেকে বিদায় করতে চাই।
এর পর ১২ ডিসেম্বর অর্থমন্ত্রীর কথার জবাব দেয় আরসিবিসি। বিবৃতিতে ব্যাংকটি জানায়, আইনত যেসব তথ্য প্রকাশ করা সম্ভব, তার সবই ফিলিপিনসের সিনেট ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে দিয়েছে আরসিবিসি। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক সম্ভাব্য সবই লুকিয়েছে। ওই ঘটনায় অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংকের দায় আছে। স্বচ্ছতার ব্যাপারে তাদের যে আপত্তি, তথ্য চেপে রাখার যে চেষ্টা, তা সাইবার ক্রাইমের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে লড়াইকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। আরসিবিসি বাংলাদেশ ব্যাংকের গাফিলতির শিকার হয়েছে বলেও তারা দাবি করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র বলছে, আরসিবিসি কর্তৃক অর্থমন্ত্রীর কথার জবাবের পরই রিজার্ভের অর্থ উদ্ধারে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার পদক্ষেপ নিতে গভর্নরকে এই চিঠি দেয়া হয়েছে। ওই চিঠির অনুলিপি আইন ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও পাঠানো হয়েছে। সূত্র : আলোকিত বাংলাদেশ