Thu. May 8th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

খােলা বাজার২৪। মঙ্গলবার, ২ জানুয়ারি, ২০১৮:  আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধন পেতে তৎপর হয়ে উঠেছে সম্প্রতি আত্মপ্রকাশ হওয়া নতুন রাজনৈতিক দলগুলো। নিবন্ধন পেতে নির্ধারিত সময়ে ৭৬টি রাজনৈতিক দল আবেদন করেছে।

এ নিবন্ধন পেতে দলগুলোর নেতারা সংশ্লিষ্ট মহলে নানা কৌশলে তদবির করছেন। পাশাপাশি পুরনো কয়েকটি দলও একই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের লক্ষ্য আগামী নির্বাচনে অংশ নেয়া। আর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে হলে ইসিতে নিবন্ধন নেয়া বাধ্যতামূলক।

তবে নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও ইসি কর্মকর্তাদের অভিমত, দলগঠনের বিষয়ে সংবিধান বা আইনে কোনো রূপরেখা না থাকায় যে কেউ যে কোনো সময় রাজনৈতিক দল গঠন করছে। নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা অধিকাংশ দল ও নেতারা সাধারণ মানুষের কাছে একেবারেই অপরিচিত। তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে জনমনে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। নির্বাচনের আগে বড় দল বা জোটের সঙ্গে দরকষাকষিসহ নানা সুবিধা নিতেই মূলত নতুন দলগুলো নিবন্ধনের চেষ্টা চালাচ্ছে বলে মন্তব্য তাদের।

এদিকে ইসির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিপুলসংখ্যক (৭৬টি) রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করায় তারা বিস্মিত। ইসিতে আবেদন করা বেশির ভাগ দলই নাম ও প্যাডসর্বস্ব বলেও মনে করছেন তারা। কারণ আবেদনের সঙ্গে নিবন্ধনের শর্ত পূরণ করা সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত জমা দেয়নি অনেক রাজনৈতিক দল।

এমনকি নিবন্ধনের জন্য ফি জমা দিয়েছে এমন ব্যাংক স্লিপ নেই অনেকগুলোর। তবে সবগুলো দলের আবেদন সতর্কতার সঙ্গে যাচাই-বাছাই করতে ইসি একটি কমিটি গঠন করেছে। প্রয়োজনে মাঠ পর্যায়ের দলীয় কার্যালয় ও কমিটির বিষয়ে অনুসন্ধান চালাবে কমিশন। পাশাপাশি খোঁজ নেয়া হবে নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দল সম্পর্কেও। এতে যদি দেখা যায়, কোনো রাজনৈতিক দল নিবন্ধন শর্ত প্রতিপালন করছে না, সেক্ষেত্রে ওই দলগুলোর নিবন্ধন বাতিল করবে কমিশন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, আবেদনকৃত দলগুলো নিবন্ধন শর্ত পূরণ করেছে কিনা তা যাচাই করা হবে। প্রয়োজনে মাঠ পর্যায়ে তদন্ত করা হবে। এরপর যেসব নাম নিবন্ধনযোগ্য বলে বিবেচিত হবে, সেগুলোর নাম কমিশনে সুপারিশ করা হবে।

কোন দল নিবন্ধন পাবে সে বিষয়ে কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে। নতুন নিবন্ধন পাওয়া দলগুলো আগামী জাতীয় ও স্থানীয় সব নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে বলে জানান তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দলের বিষয়েও খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। যেসব দল নিবন্ধন শর্ত প্রতিপালনে ব্যর্থ সেগুলোর নিবন্ধন বাতিল করা হবে।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নতুন দল নিবন্ধনের জন্য ৩০ অক্টোবর গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। আবেদনপত্র সংগ্রহ ও জমা দেয়ার সময় ৩১ ডিসেম্বর শেষ হয়। শেষ দিনেই অর্ধশতাধিক রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন জমা দিয়েছে। ইসি কর্মকর্তারা জানান, নিবন্ধন পেতে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ও রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধিমালা, ২০০৮-এর এ সংক্রান্ত শর্ত পূরণ করতে হবে।

শর্তগুলো হল- দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে কোনো জাতীয় নির্বাচনের আগ্রহী দলটিতে যদি অন্তত একজন সংসদ সদস্য থাকেন। যে কোনো একটি নির্বাচনে দলের প্রার্থী অংশ নেয়া আসনগুলোয় মোট প্রদত্ত ভোটের ৫ শতাংশ পায় এবং দলটির যদি একটি সক্রিয় কেন্দ্রীয় কার্যালয়, দেশের কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ (২১টি) প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর কমিটি এবং অন্তত ১০০টি উপজেলা বা মেট্রোপলিটন থানায় কমপক্ষে ২০০ ভোটারের সমর্থন সংবলিত দলিল থাকে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা দলগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে ‘সাধারণ জনতা পার্টি’। ১২ নভেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে এ দলটি আত্মপ্রকাশ করে। এ দলটির নেই কোনো কেন্দ্রীয় কার্যালয়। দলের সভাপতি ড. ছরোয়ার হোসেনের হাতিরঝিলের দক্ষিণ বাড্ডাস্থ বাসভবনে পরিচালনা করা হচ্ছে দলীয় কার্যক্রম। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ড. ছরোয়ার হোসেন বলেন, নিবন্ধন পাওয়ার পর কেন্দ্রীয় কার্যালয় নেব। আপাতত আমার বাসাই কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করছি। তিনি দাবি করেন, বর্তমানে ২১টি জেলা ও ২৪টি উপজেলায় কমিটি রয়েছে।

ইসির এক কর্মকর্তা বলেন, নভেম্বরে আত্মপ্রকাশ করা দলটি কীভাবে এত অল্প সময়ে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠন করতে পারে, তা বোধগম্য নয়। এ দলটি নিবন্ধন শর্ত পূরণ করেনি। রহস্যজনক কারণে প্রতি নির্বাচনের আগে অনেক দল এভাবে গঠিত হয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ইসিতে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে আরেক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ ইউনাইটেড ইসলামী পার্টি। ২০১৪ সালের পহেলা মার্চ আত্মপ্রকাশ করে বলে দাবি দলটির চেয়ারম্যান মাওলানা মো. ইসমাইল হোসোইনের। তিনি বলেন, ৪২/১ সেগুনবাগিচায় আমার কেন্দ্রীয় কার্যালয় রয়েছে। এছাড়া ২৪টি জেলা ও ১১১টি উপজেলা/থানায় দলের কমিটি রয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি। আমরা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছি। আমি মনে করি, নিবন্ধন শর্ত পূরণ করেছি। ইসি আমার নিবন্ধন দেবে।

চলতি বছরের সেপ্টম্বরে জাতীয় প্রেস ক্লাবে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে বাঁচাও- স্লোগান নিয়ে ‘বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টি’ (বিএমজেপি) আত্মপ্রকাশ করে। এ দলটিও নিবন্ধন পেতে নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছে। দলটির আত্মপ্রকাশের সময়ে সাধারণ সম্পাদক সুকৃতি কুমার মণ্ডল বলেছিলেন, আমরা এককভাবে নির্বাচন করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হতে চাই না। নির্বাচনের আগে সুবিধা মতো কোনো জোটের সঙ্গে গিয়ে নির্বাচন করতে পারি। তবে কোন জোটে যাব, তা এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। একই মাসে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আত্মপ্রকাশ করেছিল বাংলাদেশ জনতা পার্টি। এ নামে নির্বাচন কমিশনে ৫টি রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে।

দ্বিতীয়বারের মতো নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে বাংলাদেশ গণশক্তি দল নামে একটি রাজনৈতিক দল। এর আগে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিল এ দলটি। এবার নিবন্ধন পাবে বলে আশা করছে দলটি। গণশক্তির প্রেসিডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার আবদুল মজিদ ফকির বলেন, ২০১২ সালের পুরানা পল্টনে আমরা রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলাম। গত নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিতে না পারায় আমার দলের নিবন্ধন দেয়নি ইসি। এবার সব শর্ত পূরণ করে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছি। তিনি বলেন, স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করতেই নিবন্ধন চেয়েছি। কোনো জোটে যাওয়ার ইচ্ছে নেই।

নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা আরেকটি রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ ফরায়েজী আন্দোলন। এ দলের সভাপতি ফকীর আবদুল্লাহ মোহাম্মদ হাসান বলেন, হাজী শরীয়ত উল্যাহ দলটি প্রতিষ্ঠা করেন। আমরা নতুন দল নই, অনেক পুরনো দল। আরেক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয় লীগের কো-চেয়ারম্যান শাহরিয়ার ইফতেখার ফুয়াদ দাবি করেন, ১৯৬২ সালে তার দলের প্রতিষ্ঠা। এ দলটি ১৯৭০, ১৯৭৩ ও ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে। তিনি বলেন, ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগেও নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিলাম, কিন্তু ইসি আমাদের নিবন্ধন দেয়নি। আশা করি এবার নিবন্ধন পাব।

নির্বাচন এলেই নতুন নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দল কীভাবে গঠিত হবে, তাদের কার্যক্রম কী হবে, সে বিষয়ে সংবিধান বা আইনে কোনো রূপরেখা নেই। এ কারণে নির্বাচন এলেই দুই, চার বা পাঁচজন মিলেই একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে। বিভিন্ন কারণ ও দরকষাকষির জন্যই মূলত এসব দল জন্ম নেয়।

ইসিতে নিবন্ধনের জন্য আবেদন জমা দেয়া দলগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকজন পরিচিত রাজনীতিবিদও রয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্য এবং জাসদের একাংশের নেতা মইন উদ্দীন খান বাদলের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (বাংলাদেশ জাসদ)। এছাড়া বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের কয়েকটি শরিক দলও নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে।

ইসি সূত্র জানায়, দশম সংসদ নির্বাচনের আগেও ৪৩টি রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের আবেদন করেছিল। এর মধ্যে ৪১টিই নির্বাচন কমিশনের কাছে নিজেদের ‘যোগ্যতার’ প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়। তখন দুটি দল শর্ত অনুযায়ী মাঠপর্যায়ে কার্যালয় ও কমিটি থাকার তথ্য দিয়েছিল। এরপর তাদের নিবন্ধন দেয় কমিশন। দল দুটি হল- বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) ও সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট।

এর আগে ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন প্রথা চালু করে ইসি। প্রথম বছরে ১১৭টি আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে শর্ত পূরণ সাপেক্ষে ৩৯টি দল নিবন্ধন পায়। এর মধ্যে স্থায়ী সংশোধিত গঠনতন্ত্র দিতে না পারায় ২০০৯ সালে ফ্রিডম পার্টির নিবন্ধন বাতিল করে ইসি। আর আদালতের আদেশে ২০১৩ সালে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ হয়। এছাড়া ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল) নামে নতুন একটি দলের নিবন্ধন দেয়া হয়। বর্তমানে ইসির নিবন্ধনে ৪০টি রাজনৈতিক দল রয়েছে।