Wed. Mar 12th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

খােলা বাজার২৪। সোমবার,৮ জানুয়ারি, ২০১৮: ব্যাংকগুলোয় চলছে নগদ অর্থের তীব্র সংকট। এ অবস্থায় ব্যাংকিং খাতের জীবন সঞ্জীবনী হিসেবে তারল্য জোগান দিয়ে যাচ্ছে সোনালী ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি থেকে তারল্য পাচ্ছে অব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও (এনবিএফআই)।

বণিক বার্তার খবরে জানা গেছে, বিদায়ী বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সোনালী ব্যাংকের মেয়াদি আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। একই সময়ে কলমানিতে ধার দিয়েছে ২ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা। ২ হাজার কোটি টাকার বেশি বন্ড কিনে বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংকে মূলধনও জোগান দিয়েছে সোনালী ব্যাংক। এর বাইরে ব্যাংকটি সরকারি ট্রেজারি বন্ড ও বিলে বিনিয়োগ করেছে ২৮ হাজার কোটি টাকার মতো।

যদিও হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে বড় ধরনের বিপর্যয়ে পড়েছিল সোনালী ব্যাংক। বিপর্যয় কাটাতে ব্যাংকটি ঋণ বিতরণে সংযত হওয়ার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এটাই সোনালী ব্যাংকের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে।

দীর্ঘদিন অলস পড়ে থাকা নগদ অর্থকে নতুন বছরে সোনালী ব্যাংকের জন্য আশীর্বাদ মনে করছেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ওবায়েদ উল্লাহ্ আল্ মাসুদও।  তিনি বলেন, দেশের অধিকাংশ বেসরকারি ব্যাংকের এডি রেশিও (ঋণ-আমানত অনুপাত) এখন নির্ধারিত সীমা ছাড়িয়েছে। ব্যাংকগুলোকে ঋণ বিতরণ করতে হলে অবশ্যই আমানত সংগ্রহ করতে হবে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বেসরকারি খাতের বেশ কয়েকটি ব্যাংক অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ বেসরকারি ব্যাংকের তুলনায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে টাকা রাখা নিরাপদ মনে করছে।

সোনালী ব্যাংকের তথ্যমতে, গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকে জমা হয়েছে জনগণের ১ লাখ ৬ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকার আমানত। এ আমানত থেকে ব্যাংকটি একই সময়ে ৪২ হাজার ১৫৪ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। চলতি বছরের প্রথম দিন ব্যাংকটির হাতে নগদ তারল্য ছিল ৫৪১ কোটি টাকা। বাকি ৬৩ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা সরকারি-বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হিসেবে রয়েছে।

বণিক বার্তার প্রতিবেদনে আরো জানা যায়, সোনালী ব্যাংক থেকে মেয়াদি আমানত নিয়ে বিনিয়োগ করেছে দেশের ২৭টি ব্যাংক ও ২০টি এনবিএফআই। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এসব ব্যাংক ও এনবিএফআইয়ের নেয়া আমানতের পরিমাণ ৬ হাজার ২৫৫ কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংক থেকে ধার নেয়া ব্যাংকগুলোর ২৫টিই বেসরকারি খাতের। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে কেবল রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) ও আনসার-ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক সোনালী ব্যাংক থেকে আমানত নিয়েছে। গড়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ সুদে এ ঋণ নিয়েছে ব্যাংক ও এনবিএফআইগুলো। তবে কোনো কোনো ব্যাংক ৮-১০ শতাংশ সুদেও সোনালী ব্যাংক থেকে বিভিন্ন মেয়াদে টাকা ধার নিয়েছে।

বিদায়ী বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩ হাজার ১৪০ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতিতে ছিল সোনালী ব্যাংক। অথচ গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বেসরকারি খাতের ২১টি ব্যাংকে ২ হাজার ১৩৪ কোটি টাকা মূলধন জোগান দিয়েছে ব্যাংকটি। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ছাড়া বিভিন্ন মেয়াদি বন্ড কিনে এ মূলধন জোগান দেয়া হয়েছে। এ তালিকায় থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে— ব্যাংক এশিয়া, ইস্টার্ন, প্রাইম, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, যমুনা, ইউসিবি, এসআইবিএল, স্ট্যান্ডার্ড, ওয়ান, আইএফআইসি, ন্যাশনাল, ঢাকা, ট্রাস্ট, সাউথইস্ট, এবি, প্রিমিয়ারসহ ২১টি ব্যাংক।

নিজে মূলধন ঘাটতিতে থাকলেও সোনালী ব্যাংক দেশের অর্ধেক বেসরকারি ব্যাংকের মূলধন জোগানদাতা দাবি করে মো. ওবায়েদ উল্লাহ্ আল্ মাসুদ বলেন, ২০০৭-১৬ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে সোনালী ব্যাংক নিট মুনাফা করেছে ১ হাজার ২০ কোটি টাকা। কিন্তু এক হলমার্ক কেলেঙ্কারিতেই আমাদের প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে গেছে। লুট হওয়া এ টাকাই সোনালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি।

নগদ তারল্য সংস্থানের জন্য আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেয় ব্যাংকগুলো, যা কলমানি হিসেবে পরিচিত। ছয় মাস ধরে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোয় নগদ অর্থ সংকটের কারণে কলমানি বাজার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। এ বাজারের নিয়ন্ত্রণ এখন অনেকটাই সোনালী ব্যাংকের হাতে। গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি থেকে ১ হাজার ৮০৯ কোটি টাকা ধার নিয়েছে ১৯ ব্যাংক। একই সময়ে সোনালী ব্যাংক থেকে ৪২৫ কোটি টাকা ধার করেছে দেশের ২৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। সব মিলিয়ে চলতি বছরের শুরুর দিন পর্যন্ত কলমানি বাজারে সোনালী ব্যাংকের বিনিয়োগ ২ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে সোনালীসহ রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য প্রধান তিনটি ব্যাংকের কলমানির ওপরই ভরসা করছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধিনিষেধের কারণে কলমানির বাজার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তার পরও গড়ে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ সুদে কলমানিতে বিনিয়োগ করেছে সোনালী ব্যাংক। নতুন বছরে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বিদ্যমান তারল্য সংকট আরো বাড়বে বলে মনে করছেন অনেকে। সে হিসাবে চলতি বছরও কলমানির বাজারের নিয়ন্ত্রণ থাকবে সোনালী ব্যাংকের হাতেই।

সোনালী ব্যাংকের বিতরণকৃত ৪২ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৩৩ হাজার ৪৪ কোটি টাকা গেছে বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিখাতে। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিতরণ করা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার ঋণ। বাকি টাকা বিতরণ করা হয়েছে সরকারি-বেসরকারি অন্যান্য খাতে।

গত বছর পরিচালন মুনাফায়ও উন্নতি করেছে সোনালী ব্যাংক। ২০১৭ সালে ব্যাংকটি ১ হাজার ১৭৮ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করতে সক্ষম হয়েছে। ২০১৬ সালে পরিচালন মুনাফা হয়েছিল মাত্র ৪২৫ কোটি টাকা। বিদেশে অবস্থিত দুটি শাখাসহ ডিসেম্বর শেষে সোনালী ব্যাংকের শাখা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২১০টিতে। এর মধ্যে লোকসানি শাখার সংখ্যা ১৭০। হিসাবায়ন শেষ না হওয়ায় বিদায়ী বছরের ডিসেম্বরের খেলাপি ঋণের পরিমাণ এখনো চূড়ান্ত হয়নি সোনালী ব্যাংকের। তবে গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। একই সময় পর্যন্ত ব্যাংকটির প্রায় ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। সব মিলিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৯ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা বলছেন, হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর কয়েক বছর আতঙ্কে ছিলেন সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তারা। দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্পরতার কারণে ঋণ বিতরণে অতিমাত্রায় সাবধানী ছিলেন তারা। এতে ব্যাংকটির ঋণ বিতরণ প্রবৃদ্ধি প্রায় থমকে গিয়েছিল।

সোনালী ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মো. ইউসুফ আলী এ প্রসঙ্গে বলেন, হলমার্ক কেলেঙ্কারি ছিল সোনালী ব্যাংকের জন্য বড় ধরনের বিপর্যয়। এত বড় একটি ঝড়ের পর কর্মকর্তারা আতঙ্কিত হবেন, এটাই স্বাভাবিক। ধীরে ধীরে আমরা সে আতঙ্ক কাটিয়ে উঠেছি। আশা করছি, চলতি বছর আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারব।

একই আশাবাদ ব্যাংকটির এমডিরও। মো. ওবায়েদ উল্লাহ্ আল্ মাসুদ বলেন, ২০১৭ সাল ছিল সোনালী ব্যাংকের জন্য ‘ঘুরে দাঁড়ানোর বছর’। আর চলতি বছরকে আমরা ‘এগিয়ে যাওয়ার বছর’ ঘোষণা করেছি। এ বছর আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারব বলে মনে করছি।

স্বাধীনতাপূর্ব ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, প্রিমিয়ার ব্যাংক ও ব্যাংক অব বাহাওয়ালপুরকে অধিগ্রহণ করে প্রতিষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক অধ্যাদেশ ১৯৭২ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকটি বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক।

দেশের যেসব স্থানে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো শাখা নেই, সেখানে সোনালী ব্যাংক বাংলাদেশের সরকারি কোষাগারের দায়িত্ব পালন করে। ব্যাংকটি স্ট্যাম্প শুল্ক, খাজনা, নিবন্ধীকরণ ফি আদায়, সঞ্চয়পত্র বিক্রি, সরকারি কর্মচারীদের পেনশন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকদের বেতন পরিশোধসহ সরকারি বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করে।