খােলা বাজার২৪। শনিবার, ১৩ জানুয়ারি, ২০১৮: বড় হচ্ছে দেশে শ্রমবাজারের আকার। সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপেও ১৪ লাখের মতো নতুন মানুষ যোগ হয়েছে শ্রমবাজারে। যদিও বাড়েনি এ বাজারের সবচেয়ে অগ্রণী অংশ যুবশক্তির অংশগ্রহণ, উল্টো কমেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপের সর্বশেষ তথ্য বলছে, ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৫-১৬তে শ্রমবাজারে যুবশক্তির অংশগ্রহণ ১১ শতাংশের বেশি কমে গেছে।
শ্রমশক্তিতে যুবাদের অংশগ্রহণ কমার কারণ জানতে কথা বলা হয় পরিসংখ্যানবিদ, অর্থনীতিবিদের পাশাপাশি পপুলেশন সায়েন্টিস্ট ও সমাজবিজ্ঞানীদের সঙ্গে। তবে এর সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাননি তারা। নিম্ন জন্মহারের কারণে মোট জনসংখ্যায় যুবাদের (১৫-২৯ বছর বয়সী) অংশ কমে আসার কথা বলছেন কেউ কেউ। তবে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতির পক্ষে যুক্তি পরিসংখ্যান ব্যুরোর। শিক্ষায় অংশগ্রহণ বৃদ্ধির বিপরীতে ঝরে পড়ার হার কমে যাওয়া, অর্থাত্ শিক্ষাজীবন দীর্ঘায়িত হওয়াকে এর বড় কারণ হিসেবে দেখছে জরিপকারীরা।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞায় ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে কোনো ব্যক্তি যদি সপ্তাহে ১ ঘণ্টার জন্য কাজ না করেন এবং এক মাস কাজ খোঁজেন কিন্তু না পান, তাকে বেকার হিসেবে গণ্য করা হয়। আর ১৫ বছরের তদূর্ধ্ব কোনো ব্যক্তি এক সপ্তাহে ১ ঘণ্টার জন্য হলেও মজুরির বিনিময়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিলে তাকে কর্মক্ষম ধরা হয়।
বিবিএসের সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছর দেশে শ্রমশক্তির আকার বেড়ে হয়েছে ৬ কোটি ২১ লাখ। ২০১৩ সালে এ সংখ্যা ছিল ৬ কোটি ৭ লাখ। যদিও ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী যুবশক্তির অংশগ্রহণ ২৬ লাখ কমে গেছে। ২০১৩ সালে শ্রমশক্তিতে এ বয়সগোষ্ঠীর মানুষের অংশগ্রহণ ছিল ২ কোটি ২৪ লাখ। ২০১৫-১৬তে এসে তা ২ কোটি ৮ লাখে নেমে গেছে।
নিম্ন জন্মহার এর একটা কারণ হতে পারে বলে মনে করছেন পপুলেশন সায়েন্টিস্টরা। মোট জনসংখ্যায় ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের অংশ কমে গেলেও এমনটা হতে পারে বলে মন্তব্য তাদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আমিনুল হক বলেন, এখন যে ধরনের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড সুবিধা আমরা পাচ্ছি, তা আর বেশিদিন পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। পরিসংখ্যান ব্যুরোর এ তথ্য যদি সঠিক হয়, তাহলে তা বাংলাদেশের জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ হতে পারে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর স্যাম্পল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশনের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় মোট জনসংখ্যায় যুবশক্তির অংশ কমছে। ২০১০ সালে দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে ১৫-২৯ বছর বয়সীরা ছিল ২৮ দশমিক ২২ শতাংশ। ২০১৬ সালে তা সামান্য কমে ২৭ দশমিক ৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষারত অবস্থায় থাকলে তাদের শ্রমশক্তিতে হিসাবভুক্ত করা হয় না। এর বাইরে যারা শিক্ষা নিচ্ছে না বা শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ছে ১৫ বছর হলেই, তাদের শ্রমশক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় শিক্ষায় অংশগ্রহণ বেড়ে যাওয়া ও ঝরে পড়ার হার কমায় শ্রমশক্তিতে যুবাদের অংশগ্রহণ কমেছে বলে জানান বিবিএসের শিল্প ও শ্রম বিভাগের পরিচালক এবং শ্রমশক্তি জরিপের প্রকল্প পরিচালক কবির উদ্দিন আহাম্মদ।
বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, এক দশকের ব্যবধানে শিক্ষার্থী ভর্তির হার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ফলে আগে যারা ভর্তি হতে পারত না, তাদের শ্রমশক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা হতো। কিন্তু এরা এখন আসছে না। আবার যেসব শিক্ষার্থী বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ত, তাদের শ্রমশক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা হতো। কিন্তু শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হারও কমেছে। শিক্ষায় এ উন্নতি শ্রমশক্তিতে যুবকদের অংশগ্রহণ কমিয়ে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, স্কুলের শিক্ষা শেষ করে কলেজে ভর্তি বাড়ছে। ২০১৩ সালে স্কুল শেষ করে কলেজে ভর্তি হয়েছিল ৫ লাখ ৭৪ হাজার ৪০২ জন শিক্ষার্থী। ২০১৫ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬ লাখ ২৭ হাজার ১৬৭ জনে। অর্থাত্ ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত শিক্ষার এ স্তরে ভর্তি বেড়েছে ৯ দশমিক ১ শতাংশ বা সংখ্যায় ৫২ হাজার ৭৬৫ জন।
শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যর্থতায় সার্বিকভাবে একটা গলদ দেখা যাচ্ছে বলে জানান বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, কর্মে নিযুক্ত ও কর্মহীনদের বাইরেও বড় একটি অংশ শ্রমশক্তির বাইরে রয়েছে। চাকরি খোঁজার মধ্যে রয়েছে— এমন ডিসকারেজড মানুষকে শ্রমশক্তিতে হিসাবভুক্ত করা হচ্ছে না। এটির মূল কারণ শিক্ষা ব্যবস্থাটা চাকরি বাজারমুখী নয়। তবে বিশাল যুবশক্তিকে কোনো ধরনের শূন্যতায় রেখে দেশের উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করা সম্ভব নয়।
শ্রমবাজারে সার্বিকভাবে যুবশক্তির অংশগ্রহণ কমলেও সবচেয়ে বেশি কমেছে নারীর অংশগ্রহণ, যা ২২ লাখের বেশি। অন্যদিকে পুরুষ শ্রমশক্তি কমেছে প্রায় চার লাখ। একই কারণে মোট যুব শ্রমশক্তিতেও কমেছে নারীর অংশ। ২০১৩ সালে যুব শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ছিল প্রায় ৪০ শতাংশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা নেমে এসেছে ৩৪ শতাংশে।
দেশের যুবশক্তি নিয়ে কাজ করে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। শ্রমবাজারে যুবশক্তির অংশগ্রহণের বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীরেন শিকদার বলেন, শ্রমবাজারে যুবশক্তির অংশগ্রহণ বাড়ছে না কমছে, তা নিরূপণের দায়িত্ব পরিসংখ্যান ব্যুরোর। বিষয়টি জানলাম, এ নিয়ে ভেবে দেখব। তবে আমরা কাজ করি শ্রমবাজারে যারা যুক্ত হচ্ছে তাদেরকে নিয়ে।
শ্রমশক্তিতে যারা যুক্ত হচ্ছে তাদের জন্য সরকারের নানা উদ্যোগ চলমান আছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রশিক্ষণ ও অর্থায়নের মাধ্যমে তাদের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে দেশব্যাপী প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে মন্ত্রণালয়। ন্যাশনাল সার্ভিস প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষি ও ক্ষুদ্র প্রযুক্তিবিষয়ক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তাদের নিয়োজিত করা হচ্ছে, যার মাধ্যমে যুবসমাজের উল্লেখযোগ্য অংশকে প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের আওতায় আনা হয়েছে। যুব অধিদপ্তর থেকে বর্তমানে ৭৪টি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণের পর কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অর্থায়নের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া কর্মসংস্থান ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে। আর এ শ্রেণীর জনগোষ্ঠী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত রয়েছে বিধায় দেশের অর্থনীতি এখনো গতিশীল। কিছু তরুণের অলসতা ও একান্ত পারিবারিক কারণে প্রশিক্ষণ বা কর্মসংস্থানের আওতায় আনা যাচ্ছে না তাদের। এজন্য সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো হচ্ছে। বণিক বার্তা