খােলা বাজার২৪। শনিবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০১৮: চারটি লক্ষ্য নিয়ে গঠিত একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল অপারেটর টেলিটক। কার্যক্রম শুরুর পর এক দশকের বেশি সময় পার করেছে টেলিটক। দিন দিন টেলিটক রুগ্ন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে। যদিও রাষ্ট্রায়ত্ত সেলফোন অপারেটরটির আর্থিক ভিত এখনো দুর্বল। সন্তোষজনক নয় সেবার মানও। ফলে প্রতিষ্ঠানটি ব্যর্থ হচ্ছে গ্রাহক আকর্ষণে। সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা দেয়ার পরও অপারেটরটিকে টিকিয়ে রাখাই এখন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। তাই টেলিটককে কিভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায় এখন সে উপায় খোঁজা হচ্ছে। “টেলিটকের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় সরকার”। অনিয়ম, দুর্নীতি আর অদক্ষতার কারণে প্রতিষ্ঠানটির এ অবস্থা বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কেউ কেউ টেলিটককে নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলেও মনে করছেন। এসবের মধ্যেও টেলিটককে যেভাবেই হোক টিকিয়ে রাখতে হবে বলে জানান নীতিনির্ধারকরা।
বাংলাদেশে সরকারি মালিকানায় টেলিটক প্রতিষ্ঠা করা হয় মূলত চারটি লক্ষ্য সামনে রেখে। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে সেলফোন সেবা প্রদান, সরকারি ও বেসরকারি খাতের সেলফোন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার মাধ্যমে জনগণের সেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা, সেলফোন সেবার উচ্চ চাহিদার একটি অংশ পূরণ ও রাজস্ব আয়ে সরকারের একটি নতুন উৎস তৈরিই ছিল এর লক্ষ্য। তবে অদূরদর্শী নানা নীতির কারণে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে অপারেটরটি। আর্থিকভাবেও সবল হতে পারছে না। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে লোকসানি হিসেবে টেলিটকের অবস্থান তৃতীয়। অপারেটরটির সীমিত পরিসরের যে গ্রাহক, তার বড় অংশই আবার সরকারি কর্মকর্তা। বিশেষ সুবিধা নিয়ে সবার আগে দেশে থ্রিজি সেবা চালু করলেও সাফল্য আসেনি তাতেও। উল্টো নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে নাম এসেছে বারবার। এ অবস্থায় সেলফোন অপারেটরটির ভবিষ্যৎ কী— সে প্রশ্ন উঠছে
সরকারের এসব দুশ্চিন্তা নিয়ে টেলিটকের পক্ষ থেকে স্ব-বিরোধী বক্তব্য দেয়া হয়েছে। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় কমিটির কার্যবিবরণীতে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। ওই বৈঠকে টেলিটক নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনা করেন কমিটির সদস্যরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেসরকারি খাতের সঙ্গে প্রতিযোগিতার কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত সেলফোন অপারেটরের ধারণা থেকে অনেক দেশই সরে আসছে। প্রতিবেশী ভারতেও টেলিযোগাযোগ খাতের দুই প্রতিষ্ঠান এমটিএনএল ও বিএসএনএল একীভূতকরণের বিষয়ে আলোচনা চলছে। যে দু-একটি দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত সেলফোন অপারেটর সাফল্য পেয়েছে, তার সবই বেসরকারি খাতের সঙ্গে যৌথ কোম্পানি গঠনের মাধ্যমে।
টেলিটকে মূলত প্রকল্পের ভিত্তিতে অর্থায়ন করা হচ্ছে। থ্রিজি প্রযুক্তি চালু ও বিদ্যমান টুজি নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণের জন্য ২০১০ সালের ডিসেম্বরে চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি অ্যান্ড ইকুইপমেন্ট ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশনের সঙ্গে চুক্তি করে টেলিটক। ২১ কোটি ১০ লাখ ডলারের এ প্রকল্পে সহায়তা দিচ্ছে চীনের এক্সিম ব্যাংক। প্রকল্পের আওতায় টুজি ও থ্রিজি সেবার সম্প্রসারণ করছে টেলিটক। এর মাধ্যমে দেশব্যাপী ৬৫ লাখ গ্রাহককে টেলিটকের নেটওয়ার্কে যুক্ত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করে প্রতিষ্ঠানটি। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সর্বশেষ তথ্য বলছে, গত বছরের নভেম্বর শেষে টেলিটকের গ্রাহক দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪৪ লাখ ১৯ হাজার। গত বছরের অক্টোবর থেকে নারীদের জন্য বিশেষ সিম অপরাজিতা চালুর পর এক মাসে ১০ লাখ গ্রাহক বাড়ে প্রতিষ্ঠানটির।
২০১২ সালের ১৪ অক্টোবর দেশে প্রথম থ্রিজি প্রযুক্তির সেবা চালু করে টেলিটক। বাণিজ্যিক পরীক্ষণের ভিত্তিতে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে টেলিটককে এ সেবার অনুমতি দেয়া হয়। অন্য অপারেটরদের চেয়ে এক বছর আগে থ্রিজি সেবা শুরু করলেও বেসরকারি খাতের অন্য অপারেটরদের চেয়ে এক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে টেলিটক। বিনিয়োগ সীমিত হওয়ায় প্রত্যাশিত মাত্রায় থ্রিজির নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করতে পারছে না অপারেটরটি। এর মধ্যেই ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের বিভাগীয় শহরগুলোয় ফোরজি সেবা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে টেলিটক। আগামী মে মাসে এ সেবা চালুর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, নেটওয়ার্ক অবকাঠামো বিনির্মাণ ও সম্প্রসারণে প্রাথমিকভাবে সেলফোন সেবা খাতে প্রচুর বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়। বেসরকারি খাতের অন্য পাঁচ সেলফোন অপারেটরের তুলনায় টেলিটকের বিনিয়োগ সামান্যই। বিনিয়োগ কম হওয়ায় অন্য অপারেটরদের মতো নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। ফলে গ্রাহক প্রত্যাশা অনুযায়ী সেবা দিতেও পারছে না তারা। সেবা নিয়ে অপারেটরটির বিরুদ্ধে গ্রাহকদের রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। ফলে ব্যবসায়িকভাবে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর যেমন দাঁড়াতে পারেনি, তেমনি গ্রাহকসেবার ক্ষেত্রেও পেছনের সারিতেই অবস্থান টেলিটকের।
অপ্রতুল বিনিয়োগ টেলিটকের অন্যতম সমস্যা বলে মনে করেন টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। তিনি বলেন, নেটওয়ার্ক উন্নয়নসহ অন্যান্য খাতে প্রতিষ্ঠানটি ন্যূনতম বিনিয়োগ নিয়ে চলছে। এতে বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছে না টেলিটক। পাশাপাশি ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতাও রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে লাইসেন্স ফি ও অন্যান্য বকেয়া পরিশোধের ক্ষেত্রে ছাড় পেয়েছে টেলিটক। লাইসেন্স ফি বাবদ ১০ কোটি টাকা দিলেও তরঙ্গ ফি বাবদ পাওনা ১ হাজার ৭১৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকার মধ্যে তারা পরিশোধ করেছে মাত্র ৫০ কোটি টাকা। অন্যান্য পাওনাও নিয়মিত পরিশোধ করছে না প্রতিষ্ঠানটি।
২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে টেলিটক। প্রতিষ্ঠানটির অনুমোদিত মূলধন ২ হাজার কোটি টাকা। পরের বছরের ৩ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে টেলিটকের সেলফোন সেবাদান কার্যক্রম শুরু হয়।
যাত্রার এ সময় থেকেই বিতর্কের শুরু টেলিটকের। প্রতিষ্ঠানটির কাজ পেতে বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের ৫৩ লাখ ডলার ঘুষ দেয় জার্মান কোম্পানি সিমেন্স। এতে সিমেন্সের সঙ্গে যুক্ত ছিল চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। অবৈধ ভিওআইপিতেও টেলিটকের নাম এসেছে বারবার। অবৈধ ভিওআইপি বন্ধে কারিগরি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার পাশাপাশি অভিযান পরিচালনা করছে বিটিআরসি। উভয় ক্ষেত্রেই অবৈধ ভিওআইপিতে ব্যবহূত সিমের মধ্যে সবচেয়ে বেশি টেলিটকের।
বিটিআরসির সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের নভেম্বর শেষে সেলফোন অপারেটরদের গ্রাহক সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪ কোটি ৩১ লাখ। এর মধ্যে গ্রামীণফোনের গ্রাহক সংখ্যা সাড়ে ছয় কোটি। দ্বিতীয় বৃহৎ সেলফোন অপারেটর রবির নেটওয়ার্কে গ্রাহক রয়েছে ৪ কোটি ১৪ লাখ। এছাড়া বাংলালিংকের গ্রাহক সংখ্যা ৩ কোটি ২৩ লাখ। আর রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিটক এখনো অর্ধকোটি গ্রাহকও টানতে পারেনি। বণিক বার্তা, প্রিয়, গুগল