Wed. May 7th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

 

খােলা বাজার২৪। শনিবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০১৮: দেশের আলেম ওলামা মশায়েখদের এ যেন মহাজাগরণ। সারাদেশের লক্ষাধিক আলেম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেত হয়ে আওয়াজ তুললেন শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য চলবে না। আলেম সমাজ ও মাদ্রাসার শিক্ষকদের অভুক্ত রেখে দেশের উন্নয়ন ও ডিজিটাল বাংলাদেশ টেকসই হতে পারে না। দেশের আলেমদের মধ্যে কে ছিলেন না?  টেকনাফ থেকে তেতুঁলিয়ার মাদ্রাসা অধ্যক্ষ, প্রিন্সিপাল, সুপার, উপাধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক, মসজিদের ঈমাম, পীর-মশায়েখ এবং নৈতিক শিক্ষার মধ্যমে সমাজকে যারা আলোচিত করছেন এবং সমাজ যাদের মুরুব্বী হিসেবে চেনেন তাদের প্রায় সবাই উপস্থিত ছিলেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। তাদের সবার কন্ঠে এক আওয়াজ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আলেম সমাজ ও মাদরাসা শিক্ষার জন্য অনেক কিছু করেছেন। এখন তিনি শিক্ষকদের বৈষম্য দূর করতে ইবতেদায়ী থেকে কামিল পর্যন্ত সকল মাদরাসার শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণ করবেন। দেশের মাদরাসা শিক্ষকদের নিয়ে গঠিতবাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অরাজনৈতিক এবং পেশাজীবী সংগঠন জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের এই মহাসমাবেশে তারা আলো বলেন, মাদরাসায় শুধু ধর্মীয় শিক্ষাই নয়; নৈতিকতার শিক্ষাও দেয়া হয়। যারা মাথায় কোরআন ধারণ করেন তারা কখনো সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদকে প্রশ্রয় দেন না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাস হয়, মাদকের হাট বসে, ছাত্ররা দাবি দাওয়ার নামে পিতৃতুল্য শিক্ষকদের অপমান-অপদস্ত করেন। কিন্তু মাদরাসা পড়–য়া ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে এ ধরণের কোনো অপকর্ম দেখা যায় না। কারণ মাদরাসায় সৎ মানুষ হওয়ার পাশাপাশি নৈতিকতার শিক্ষায় জোড় দেয়া হয়। 
ঐতিহাসিক সোরাওয়ার্দী উদ্যানে গতকাল এই মহাসমাবেশের আয়োজন করা হয়। সংগঠনের সভাপতি ও দৈনিক ইনকিলাব সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মহাসম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। মহাসমাবেশ উদ্বোধন করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি উন্নয়ন বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। জাতীয় সংসদের ধর্ম মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি বজলুল হক হারুন এমপি, মাদরাসা ও কারিগরি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ আলমগীর, ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যাঞ্চেলর ড. মোঃ আজহারুল্লাহ, বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানপ্রফেসর এ কে এম হাবিবুল্লাহ, মাওলানা মোসাদ্দেক আল মাদানী, অধ্যাক্ষ মাওলানা আবদুর রাজ্জাক, মাওলানা হুসামুদ্দিন (ফুলতলী), সৈয়দ মাহবুবুর রহমান জৈনপুরি,মাওলানা খলিলুর রহমান নেছারাবাদী,প্রিন্সিপাল মোকাদেসুল ইসলাম, প্রিন্সিপাল আবুল ফজল মোঃ শরিফউদ্দিন, অধ্যাক্ষ মাওলানা হাসান মাসুদ, মাওলানা এ কে এম মনওয়ার আলী, মাওলানা ইদ্রিস খান, অধ্যাপক শরাফত উল্লাহ প্রমূখ। মহাসমাবেশ পরিচালনা করেন জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের মহাসচিব মাওলানা শাব্বীর আহমদ মমতাজী। 
 সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেজমিয়াতুল মোদার্রেছীনের মহাসমাবেশের এই জনসমাগমকেজনসমুদ্র, জনতার মহাসমুদ্র, ওলামা মশায়েখের মিলনমেলা, শীর্ষস্থানীয় আলেমদেরঐকোতান সবগুলো উপমার সঙ্গে তুলনা করা যায়। বিশালাকৃতির মঞ্চ। অসংখ্য মাইক টানানো হয়েছে। জনসমাগম এতো বেশি যে দূর থেকে মঞ্চের বক্তাদের দেখা যায় না। দুই পার্শে বিরাটাকৃতির দু’টি প্রজেক্টর বসানো হয়েছে উপস্থিত মানুষ যাতে বক্তাকে দেখতে পারেন।শুধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই কি মানুষ? একদিকেমৎস ভবন থেকে শুরু করে শিশুপার্ক; অন্যদিকে টিএসসি, বাংলা একাডেমী, দোয়েল চত্বর পর্যন্ত মানুষ আর মানুষ। যেদিকে চোখ যায় শুধু ধবধবে সাদা টুপি পরিহিত মানুষের ঢল।
 খোলা মাঠেই আয়োজন করা হয়েছে মহাসমাবেশের।সুনীল আকাশ, নীচে ঘাঢ় সবুজ ঘাস। গতকাল শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবির মতো যেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সেজেছিল।সারাদেশের আলেমদের প্রায় সবারই একই ধরণের ‘পরিধান’ হওয়ায় এক মনোরমদৃশ্যের অবতারণা করে। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সুউচ্চ গাছ মাঝখানে অবস্থিত সান বাঁধানো লেক সত্যি অপূর্ব। কংক্রিটের ঢাকা শহরের মাঝখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গাছের ছায়া সুনিবিড় পরিবেশে লাখো মানুষেরউপস্থিতি সমাবেশকে আরও মনোমুগ্ধকর করে তোলে। কোথায় নেই মানুষ? যে যেখানে পেরেছেন ঘাসের ওপর বসেই বক্তৃতা শুনতে বসে গেছে। প্রায় সবার পরনে সাদা পায়জামা, গায়ে সাদা ধবধবে পাঞ্জাবী মাথায় টুপির অপরুপ দৃশ্য।এ যেন কোনো শিল্পী ক্যানভাসে জলরং, তেলরং, অ্যাক্রোলিক মাধ্যমেছবি একেঁছেন। 
সারাদেশ থেকে সকালেই গাড়ীতে করে আলেমরা সমাবেশ স্থলে হাজির হন। দোয়েল চত্বর থেকে টিএসসি রাস্তার দুই ধারে সারিবদ্ধভাবে বাস রাখা হয়েছে। অনেকেই সকাল বেলায় মঞ্চের সামনে গিয়ে বসেন। বেলা বাড়ার সাথে সাথে আসতে থাকে জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সারাদেশ থেকে আসা নেতারা। অন্য আর দশটা সভা সমাবেশের মতো মিছিল নিয়ে আসতে দেখা যায়নি। মিছিলের দৃশ্য ছিল না। পুলিশের প্রহরায় সারাবদ্ধভাবে উদ্যানের সমাবেশস্থলে হাজির হন।বিভিন্ন দাবি দাওয়ার প্লাকার্ড, ব্যানার দেখা যায় সমাবেশে অংশগ্রহনকারীদের হাতে। মাঠেও বিভিন্ন ব্যানার লাগানো হয়েছে। বিভিন্ন সময় উপস্থিত তৌহিদী জনতা ‘নারায়ে তকবির–আল্লাহু আকবর’সহনানা রকম শ্লোগানও দেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তৈরি বিশাল মঞ্চ থেকে বক্তৃতা করেন বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মাদরাসা শিক্ষক ও আলেম ওলামারা। সকাল ৯ টায় সমাবেশ শুরু হলেও ১১ টার মধ্যেই সোরাওয়ার্দী উদ্যান এবং আশপাশের বিশাল এলাকা এক বিশাল জনসমূদ্রে পরিণত হয়। প্রেসক্লাব থেকে শাহবাগ এবং কাকরাইল থেকে রাস্তাগুলো ছিল মানুষের ভিড়ে ঠাসা। উদ্যান ঘিরে আশে-পাশের রাস্তাগুলোতেও ছিল মানুষের ¯্রােত। পথে পথে যানজট ছিল। 
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, এদেশে কোরআর বিরোধী কোনো আইন হবে না। শিক্ষকদের দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, আপনাদের দাবি আমি কখনো ভুলিনি। ইতোমধ্যেই ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যায়, মাদরাসা অধিদপ্তর, বেতনসহ অন্যান্য অনেক দাবি পুরণ করা হয়েছে। এখন চাকরি জাতীয়করণ ছাড়াও যে দাবিগুলো রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরবো। আশা করি তিনি সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে কথা বলে বিবেচনা করবেন। মাদরাসা শিক্ষকদের হতাশ না হওয়ার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী সব সময় মাদরাসা ও ইসলাম শিক্ষার প্রতি আন্তরিক। যার দৃষ্টান্ত আপনারা অতীতে পেয়েছেন আগামীতেও পাবেন। আমি গোনাহগার বান্দা। কিন্তু ভাগ্যবান। কারণ দেশের বিপুল সংখ্যা আলেম সমাজের সঙ্গে চলাফেরা করি। তিনি মাদরাসা শিক্ষার জন্য সরকারের নানা উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে বলেন,সারাদেশে আমি যাই। কিন্তু এতো বড় সমাবেশ দেখিনি। 
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, এ দেশের মানুষ ধর্মভীরু কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। মানুষ জঙ্গীবাদ পছন্দ করে না; প্রশ্রয় দেয় না। আজান পড়লেই মানুষ মসজিদের পথ ধরে। মাদ্রাসার শিক্ষকরা ধর্মের কথা বলেন নবীর কথা বলেন। তারা ইসলামী শিক্ষা ছড়িয়ে দিয়ে দেশকে আলোকিত করছেন। যারা মাথায় কোরআন ধারণ করেন তারা কখনো সন্ত্রাসী হতে পারেন না। তিনি বলেন, সারা পৃথিবীতে মুসলমানদের নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রকাগা-া প্রচার করা হচ্ছে। আমি স্পষ্ট করে বলছি মাদরাসায় ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষা দেয়া হয়। যারা জঙ্গীপনা করছেন তারা ইসলাম ধর্মের ওপর কালিমা লেপন করতেই এসব করছেন।
সালমান এফ রহমান বলেন, আলেম-ওলামাদের উদ্দেশ্যে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময় মাদ্রাসা শিক্ষা ও আলেম ওলামাদের প্রতি সন্মান দেখান। বর্তমান সরকার সব সময় মাদরাসার উন্নয়নে আন্তরিক। আশা করি আপনাদের দাবীগুলো পর্যায়ক্রমে তিনি পুরণ করবেন। আমিও আপনাদের কথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সামনে তুলে ধরবো।
এ এম এম বাহাউদ্দীন বলেন, দেশের  মাদ্রাসাগুলোতে প্রায় ৮০ লাখ ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করছেন। তারা ইসলামী শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষা দেন। সমাজের অনগ্রসর এলাকা থেকে উঠে আসা ছাত্রছাত্রীরা মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহণ করে সমাজকে আলোকিত করছেন। মাদক নিয়ে একটি জরীপ করা হয়। সেখানে দেখা যায় পুলিশ সদস্য, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, রাজনীতিকসহ নানা ধরণের মানুষ মাদক সেবন ও ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু কোনো মাদরাসার ছাত্রকে মাদকের সঙ্গে যুক্ত থাকার তথ্য পাওয়া যায়নি। শিক্ষায় নৈতিকতার অভাব ও মাদকের কারণে সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে। নতুন প্রজন্মকে সঠিক পথে আনতে চাইলে মাদরাসা শিক্ষার বিকল্প নেই। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ইসলাম চিন্তা চেতনার কারণে শিক্ষামন্ত্রী সুযোগ পেলেই মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে কাজ করেন।  স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও মাদরাসা শিক্ষার প্রতি সহানুভুতিশীল। এ জন্য তাদের অভিনন্দন জানাই। ইবতেদায়ী থেকে কামিল পর্যন্ত সকল মাদরাসার শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, সরকার যদি মাদরাসা শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণ করে তাদের রুটি রুজির সহায়তা করেন তাহলে আলেমরা সুন্দর সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। আমরা সব সময় বলছি সরকারের ভাল কাজের সঙ্গে আমরা ছিলাম-আছি- থাকবো।মনে রাখতে হবে মাদরাসা ছাত্র শিক্ষকদের ভোটের সংখ্যা দেড় কোটি। রাজনীতি না করলেও এই ভোট রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। 
বি এইচ হারুন বলেন, সত্য ন্যায় ও সঠিক ভাবে সুন্দর সমাজ গঠনে মাদরাসাগুলো ভূমিকা পালন করছে। এদেশে কওমী মাদরাসা অবহেলিত ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের মূল্যায়ন করেছেন। এ এম এম বাহাউদ্দীনের নের্তৃত্বে দেশের মাদ্রাসার শিক্ষকরা ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় মাদরাসার শিক্ষকদের মধ্যে বিভক্তির চেস্টা করা হয়। কিন্তু মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) সুযোগ্য পুত্র বাহাউদ্দীনের যোগ্য নের্তৃত্বের কারণে তারা সফল হতে পারেননি। দেশের আলেমদের মনে করি এটাই সত্যিকারের মানুষ গড়ার কারিগর। মাওলানা সাব্বীর আমমেদ মমতাজী বলেন,আমরা শেখ হাসিনার উন্নয়নের সঙ্গে আছি। প্রধানমন্ত্রী আমাদের কা-ারী হিসেবে কাজ করতে পারেন। আমাদের নেতা এ এম এম বাহাউদ্দীন মাদরাসা শিক্ষক ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করছেন। শিক্ষা মন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাদরাসা শিক্ষার জন্য যে আন্তরিকতা দেখাচ্ছেন তাতে তাদের সবার পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।